কলকাতা: করোনা, লকডাউন, মৃত্যুর হার, কোমর্বিডিটি, গত প্রায় ৬ মাস ধরে এই শব্দগুলোই জাঁকিয়ে বসেছে মানুষের মনে। কোনওদিন আক্রান্তের হার ছাপিয়ে যাচ্ছে সুস্থতার অঙ্ককে, কোনওদিন আবার উল্টোটা। তবে কেবল শরীরে নয়, মানুষের মনেও গভীর প্রভাব ফেলেছে কোভিড ১৯। লকডাউনে বেড়েছে অবসাদ, আত্মহত্যা, ঘরোয়া হিংসার প্রবণতাও। মাস্ক, স্যানিটাইজারের নিউ নর্মালে কতটা অভ্যস্ত হলাম আমরা? সামাজিক দূরত্ববিধির রেশ দৈনন্দিন জীবনে কতটা পড়ল? বর্তমান প্রেক্ষাপটকে এবার পর্দায় তুলে ধরছেন পরিচালক পারমিতা মুন্সি। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেতে চলেছে তাঁর নতুন ছবি 'ভালোবাসা পজিটিভ'। মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন দেবলীনা দত্ত ও দেবদূত ঘোষ। নতুন শর্টফিল্ম নিয়ে এবিপি আনন্দ-র সঙ্গে আড্ডা দিলেন পরিচালক ও কলাকুশলীরা।

করোনা আবহে সমস্ত সুরক্ষাবিধি মেনে মাত্র একদিনেই ছবির শ্যুটিং শেষ করেছেন পরিচালক পারমিতা। করোনাকে মাথায় রেখে ছবি তৈরির পরিকল্পনা এল কীভাবে? এবিপি আনন্দকে পরিচালক বললেন, 'সিনেমা সময়ের দলিল। আমরা যে অডিও-ভিস্যুয়াল কাজগুলো করি তার মধ্যে দিয়ে বর্তমান সময়কে তুলে ধরা খুব প্রয়োজন। আমার কাছে যখন স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি করার প্রস্তাব আসে, সিদ্ধান্ত নিই করোনা পরিস্থিতির উপরেই ছবি তৈরি করব। এই বিষয়টা সাধারণ মানুষের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য ও সময়োপযোগী।'

ভিন্ন ধারার এই ছবিতে কাজ করতে পেরে খুশি ছবির নায়ক দেবদূত ঘোষ ও নায়িকা দেবলীনা দত্ত। ছবিতে তাঁদের চরিত্রের নাম সুমন ও দ্বৈতা। 'ভালোবাসা পজিটিভ' নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মোবাইল ফোনের ওপার থেকে দেবদূত বললেন, 'এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ছবি। করোনাকালের প্রেক্ষাপটে দেখানো একটি সফল বিয়ের গল্পও বটে। ছবিতে আমি আর দেবলীনা স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছি। প্রথম থেকেই দেখা যাবে, সুমনের জীবনের সবটা ঘিরেই দ্বৈতা রয়েছে। ছবিতে নিউ নর্ম্যাল পরিস্থিতিকেও তুলে ধরা হয়েছে। তবে ছবির একেবারে শেষে একটা চমক রয়েছে।'

সেই 'শেষের চমক'-এর আভাস পাওয়া গেল দেবলীনার কথাতেও। শ্যুটিং শেষ করে মোবাইল ফোনে এবিপি আনন্দকে বললেন, 'করোনা আবহে লকডাউনে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতির ওপর নির্মিত 'ভালোবাসা পজিটিভ'-এর মধ্যে একটা থ্রিলার এলিমেন্ট আছে, আবার সাসপেন্সও আছে। আর শেষে একটা সারপ্রাইজ আছে, সেটা বলা যাবে না!' দেবলীনা আরও যোগ করলেন, 'আমার চরিত্র দ্বৈতা হল করোনা পরিস্থিতির একজন ভিকটিম। এই চরিত্রটার মধ্যে দিয়েই তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে মানুষ কোভিড পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। আরেকটা দিক থেকে এটা একটা আদ্যপান্ত প্রেমের গল্পও বটে। দ্বৈতা খুব শান্ত, নরম স্বভাবের একজন গৃহবধূ। আমায় দর্শক পর্দায় স্পষ্টবক্তার ভূমিকাতেই দেখে অভ্যস্ত। এমন একটা চরিত্র করে আমার বেশ ভালো লেগেছে। আর পারমিতা আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। ওর সঙ্গে কাজ করার একটা আলাদা কমফোর্ট জোন রয়েছে।'

সিনেমার পর্দায় ধরা থাক করোনা পরিস্থিতি, পরিচালকের মতো চেয়েছিলেন দেবদূতও। বললেন, 'একজন সাংস্কৃতিক কর্মী যে পরিস্থিতিতে কাজ করছে সবসময় তার একটা দলিল থাকা উচিত। আর আমি নিজে আর্টিস্ট ফোরামের একজন প্রতিনিধি। একটা সময়ের পর আমরা বুঝতে পারছিলাম যে শ্যুটিং শুরু না করলে করোনার বদলে মানুষ খেতে না পেয়ে, ইএমআই দিতে না পেরে আত্মহত্যা করবে বা মারা যাবে। হাজার হাজার কর্মী আমাদের ওপর নির্ভরশীল। কেবল অভিনেতা-অভিনেত্রী বা পরিচালক নন, এত বড় ইন্ডাস্ট্রির গোটাটাই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা ভাবতে হবেই। তবে সাবধানতা মেনেই শ্যুটিং করছি। ক্রুরা সবাই মাস্ক, স্যানিটাইজার ব্যবহার করেছেন। আমারও কিছু দৃশ্য মাস্ক পরেই শ্যুট হয়েছে। তবে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কিছু জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিতে হবেই। যদিও করোনা আক্রান্ত শিল্পীর সংখ্যা এখনও পর্যন্ত খুবই সামান্য।'

দেবদূত জানালেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়েই আরও একটি ছবির কাজ হাতে রয়েছে তাঁর। সেই ছবিতে তুলে ধরা হবে মা ও ছেলের গল্প। তবে সব ছবিই আপাতত ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাবে। আর 'ভালোবাসা পজিটিভ' এত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে মানবিকতা ও ভালোবাসার বার্তা দেবে বলেই আশা দেবদূতের। বললেন, 'ইন দ্য টাইম অফ ব্রেকিং অফ নেশনস- এ যেমন যুদ্ধের মধ্যেও প্রেমের গল্প বলা হয়েছিল, তেমনই করোনাকালেও সুমন আর দ্বৈতার ভালোবাসার কথাই বলা হয়েছে ‘ভালোবাসা পজিটিভ’-এ। কোভিড আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এটাকে আমাদের হয় মেনে নিতে হবে না হয় মুখ ঘুরিয়ে থাকতে হবে। আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়েই তো শ্যুটিং শুরু করেছি।'

গোটা ছবির বেশিরভাগ অংশের শ্যুটিং হয়েছে একটাই বাড়ির মধ্যে। পারমিতা ও দেবলীনা জানালেন, গোটা সেটই স্যানিটাইজ করা হয়েছে বারবার, পালন করা হয়েছে সমস্তরকম সুরক্ষাবিধিও। কেবল শ্যুটিং শুরুর আগে বিমা সংক্রান্ত কিছু সমস্যা হয়েছিল। তাও কাটিয়ে ওঠা গিয়েছে বলে জানান পারমিতা। বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের জন্য কী বার্তা থাকবে ছবিতে? দেবলীনা বললেন, 'কোভিড নিয়ে আমাদের মনে একটা অযথা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সেটা এই ভাইরাসের থেকেও বেশি ক্ষতিকারক।' একই সুর পরিচালকের কথাতেও। বললেন, 'কোভিড আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষই সেরে উঠছেন। কিন্তু বদলে যাচ্ছে কোভিজজয়ীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। আতঙ্কে প্রায় একঘরে করে রাখা হচ্ছে তাঁদের। এতে মনের জোর হারিয়ে ফেলছেন অধিকাংশ মানুষ।'

পরিচালক জানালেন, ছবি মুক্তির ব্যাপারে আপাতত বঙ্গ ইন্ডিয়ার কথা হয়েছে। আরও কিছু ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবিটির স্ক্রিনিং করার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। সেই সঙ্গে প্রযোজক সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ছবির রেভিনিউ-এর অংশ মুখ্যমন্ত্রীর করোনা ত্রাণ তহবিলে অনুদান দেওয়া হবে।

দেবলীনা ও দেবদূত ছাড়াও ছবিতে রয়েছেন সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবজিৎ কুণ্ডু, ও ইন্দ্রাণী ঘোষ। ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অভিমুন্য চট্টোপাধ্যায়, গান গেয়েছেন মিতুল দত্ত। শিল্প নির্দেশনায় সুদীপ ভট্টাচার্য্য ও নৃত্য পরিচালনায় রয়েছেন ইন্দ্রাণী গঙ্গোপাধ্যায়।