কলকাতা: এ যেন কেবল ছবি নয়। ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিট জুড়ে দর্শকদের ঘিরে থাকল রিল আর রিয়েল লাইফের অদ্ভুত টানাপোড়েন! হলিউড থেকে বলিউড, মাত্র ৪ দিনের মধ্যেই সমস্ত রেকর্ড ভেঙে সাফল্যের শীর্ষে প্রয়াত সুশান্ত সিং রাজপুত অভিনীত শেষ সিনেমা, ‘দিল বেচারা’। সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে কেবলই ‘ম্যানি-ম্যানিয়া’। প্রশংসায় ভাসছেন অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে পরিচালক, সকলেই। কিন্তু একরাশ মনখারাপ ঘিরে ধরেছে ‘দিল বেচারা’-র ‘মিস্টার বসু’, ওরফে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়-কে। শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে সুশান্তকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি, কেরিয়ার, করোনা-আবহে আটকে থাকা ছবি - এবিপি আনন্দ-কে মোবাইল ফোনে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে অকপট অভিনেতা।
প্রশ্ন: মুক্তির মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে ‘দিল বেচারা’। কেমন উপভোগ করছেন এই সাফল্য?
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: একদিকে যেমন ভালো লাগছে, অন্যদিকে আক্ষেপও রয়ে যাচ্ছে। সুশান্ত ছবিটার এই সাফল্য দেখতে পারল না। আর ছবিটা এমন একটা পরিস্থিতিতে মুক্তি পেল, দর্শকরা হলে গিয়ে দেখার সুযোগ পেলেন না। সেই আফশোসও রয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনার কেরিয়ারে ‘দিল বেচারা’ প্রথম বলিউড ফিল্ম যেটা ওটিটি-তে মুক্তি পেল। এই নতুন অভিজ্ঞতাটা কেমন?
শাশ্বত: এখন যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, মনে হচ্ছে, ওটিটিই ভবিষ্যৎ। একটা সুবিধা রয়েছে, সেটা হল মানুষ নিজের সময় সুযোগ অনুযায়ী ছবিটা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। হলের সময়ের ওপর দর্শকদের নির্ভর করতে হচ্ছে না। এটা একদিক থেকে ভালো। মানুষ নিজের সুবিধা মতো, সময় মতো যে ছবিটা দেখতে চাইছেন ঠিক সেইটাই দেখতে পাবেন। ৬টার সময় সিনেমা দেখতে যাব বলে যা ছবি চলছে, আমায় সেটাই সেখতে হবে, এমনভাবে আমরা কাউকে বাধ্য করতে পারি না। সেদিক থেকে ওটিটি বেশ সুবিধাজনক।
প্রশ্ন: কিজি বসুর বাবার চরিত্রে আপনার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। তবে কেবল এই ছবি নয়, প্রত্যেক ছবিতেই দর্শক শাশ্বতকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পেয়েছেন। চরিত্র নিয়ে এত পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে কখনও ভয় লাগেনি?
শাশ্বত: যে কোনও ছবির শ্যুটিং শুরুর প্রথম দিনটাতে একটু নার্ভাসনেস থাকে। সবার একটা প্রত্যাশাও তো থাকে। একবার প্রথম দিনটা ঠিকঠাক পেরিয়ে যেতে পারলে আর চিন্তা হয় না।
প্রশ্ন: মুক্তির পর ‘দিল বেচারা’ ছবিটা নিশ্চয়ই দেখেছেন...
শাশ্বত: হ্যাঁ, একেবারে সেই দিনই দেখেছি।
প্রশ্ন: ছবির শেষ দৃশ্যে ম্যানির চলে যাওয়ার পর সবাই দাঁড়িয়ে যখন ম্যানির সিনেমা দেখছে, সুশান্তের মৃত্যুর পর সেই ক্ল্যাইম্যাক্সটা আপনার কাছে কেমনভাবে ধরা দিল?
শাশ্বত: ছবিটা গল্পের মতো করেই দেখলাম। গল্পটা তো আমি জানতাম। যতক্ষণ ছবিটা দেখলাম, একজন দর্শকের মতো সিনেমাটার মধ্যেই ছিলাম। শেষ হয়ে যাওয়ার পরে হঠাৎ কেমন মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হল, এটাও হয় জীবনে!
প্রশ্ন: গোটা ছবির মধ্যে সুশান্তের সঙ্গে শ্যুট করা আপনার সবচেয়ে কাছের দৃশ্য কোনটা?
শাশ্বত: আমার কাছে সবচেয়ে আবেগের দৃশ্য ওই দোলনায় বসে আমার আর সুশান্তের বিয়ার খাওয়াটা।
প্রশ্ন: সেইদিনকার কথা মনে পড়ে?
শাশ্বত: একটা সন্ধেতেই শ্যুটিং শেষ হয়েছিল দৃশ্যটার। আমরা একবার ভিজছি, আবার অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে গায়ের জল শুকোচ্ছি, আবার ভিজছি। তার মধ্যেই বারবার রিহার্সাল চলছে। ফেসবুকের ছবিগুলো দেখে আবার সেই দিনটার কথা মনে পড়ে গেল। শট রেডি করার সময় তো অনেক চিৎকার চেঁচামেচি হয়। আলো ঠিক কর, বৃষ্টি চালু কর... সেখানে দেখেছিলাম, ওই সবকিছুর মধ্যে সুশান্ত একজন স্টার হয়েও কতটা মন দিয়ে প্রত্যেকবার রিহর্সাল দিচ্ছে। আমাদের ২ জনের মধ্যে যদি কেমিস্ট্রিটা ভালো না হত, তাহলে দৃশ্যটা দাঁড়াত না। কেমিস্ট্রি শুধু হিরো হিরোইনের মধ্যেই তো আর হয় না (হাসি)।
প্রশ্ন: ফ্লোরে কেমন ছিলেন সুশান্ত?
শাশ্বত: একজন পেশাদার অভিনেতার ঠিক যেমন হওয়া উচিত, তেমনই ছিল সুশান্ত। তাই বলে সব সময় হাতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে পায়চারি করত না। সকালবেলা সবাই মিলে বসে চা খাওয়া হল, গল্প হল। তারপর যখন সিন নিয়ে বসলাম, সেখানে কেবল পরিচালক আর অভিনেতা। তৃতীয় ব্যক্তি আর কেউ নেই। সুশান্ত যথেষ্ট মনোযোগী আর কঠিন পরিশ্রম করা একটা ছেলে। দিল বেচারা যে গানটা আছে, সেটা যদি খেয়াল করে দেখা যায়, গানটা একটা শটে শ্যুট করা। তার আগে রিহার্সাল করে নেওয়া। এটা ইয়ার্কি না। অনেক নন ডান্সারকে শট কেটে কেটে অন স্ক্রিন ডান্সার বানানো যায়। কিন্তু একটা ছেলে কতটা মনোযোগী হলে একসঙ্গে নাচও করছে, লিপ সিঙ্গ করছে আবার এক শটে শ্যুটও করছে, এটা অবিশ্বাস্য। কেবল মঞ্চে নাচ নয়, কখনও আবার দর্শকদের মধ্যে নেমে আসছে, সিটের ওপর দিয়ে টপকাচ্ছে। আমি হাঁ হয়ে গিয়েছি। এটা বিরল প্রতিভা। আমি সিনেমাটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি। এর আগে আমি সুশান্তকে মঞ্চে পারফর্ম করতে দেখেছি। সেটা ম্যাকাও আইফা অ্যাওয়ার্ডসে। আমার মনোনয়ন ছিল। সেই সময় ওর নাচ দেখে মনে হয়েছিল কী দারুণ এনার্জি, কী নমনীয়তা। পরিশ্রম ছাড়া এই জায়গায় যাওয়া যায় না।
প্রশ্ন: সুশান্তের সঙ্গে আলাপ কি সেই সময় থেকেই?
শাশ্বত: না, তখন সুযোগ হয়নি। ও ছিল মঞ্চে। আমি দর্শকাসনে। সুশান্তের সঙ্গে আলাপ এই জামশেদপুরেই। শ্যুটিং করতে এসে। একই হোটেলে থাকতাম। একসঙ্গে আড্ডা মারতাম। এখনও মনে পড়লে খারাপ লাগে।
প্রশ্ন: অফ-স্ক্রিন কোন স্মৃতিটা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
শাশ্বত: অফ স্ক্রিন ও খুব মজার ছেলে, শিক্ষিত ছেলে। আমরা সবাই একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতাম। ও একদম ছেলেমানুষের মতো। হয়তো পাশের চেয়ারে বসে আড্ডা দিচ্ছে। অনেকসময় চেয়ারে পাশাপাশি বসলে যেমন মাথা ঘুরিয়ে দেখতে হয়, ওইভাবেই কথা চলছে। হঠাৎ, ‘দাদা, মু নহী দেখ পা রাহাহুঁ’, বলে উঠে ধপ করে সামনে একেবারে মাটিতে বসে পড়ল। তারপর ওইভাবেই আড্ডা চলল। এই ব্যবহারগুলো ভালো লাগত। আমি একজন ফিল্মস্টার, এই ব্যাপারটাই ওর মধ্যে ছিল না। আমার ছোট ভাইয়ের মত ছিল সুশান্ত।
প্রশ্ন: আপনি আগে একবার বলেছিলেন, সুশান্ত ক্রিকেট খেলত শ্যুটিংয়ের ফাঁকে..
শাশ্বত: (হাসি) শ্যুটিংয়ের ফাঁকে নয়। রোজ ভোরবেলা ৫টার সময় ছাদে ক্রিকেট খেলত। শ্যুটিংয়ে যাওয়ার আগে।
প্রশ্ন: আপনি কখনও যোগ দিয়েছেন?
শাশ্বত: আমায় বলত। কিন্তু অত ভোরে উঠে ক্রিকেট খেলা আমার হয়ে ওঠেনি!
প্রশ্ন: ছবিতে কিজি আর তার বাবার এত ভালো বোঝাপড়া ছিল। বাস্তব জীবনে সঞ্জনার সঙ্গে কতটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক?
শাশ্বত: ছবিতে এই রসায়নের কৃতিত্ব চিত্রনাট্য আর পরিচালকের। আমাদের মধ্যে চরিত্রগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে আমরা বাবা-মেয়ে। আর একসঙ্গে অনেকদিন থাকতে থাকতে, শ্যুটিং করতে করতে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। দু তিন দিন পর থেকে সেটাকে বাবা-মেয়ে বলে আলাদা করে প্রমাণ করতে হয় না। ব্যবহারটাই তেমন হয়ে যায়। আর একটা হলিউড ছবি থেকে এত সুন্দরভাবে গল্পটা দেশীয় রূপে লেখা, সেটাই ছবির শিরদাঁড়া। শেষবার সবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ডাবিং করতে গিয়ে। তখন সঞ্জনাকে মজা করে সুশান্ত বলেছিল, সাবধান, বেশি কাছে যাস না। এখন বাবা বলে মনে হচ্ছে না কিন্তু। ইয়ং লাগছে।
প্রশ্ন: এর আগে সুশান্ত কলকাতায় এসেছেন, কাজ করেছেন। বাংলা নিয়ে সুশান্তের আগ্রহ ছিল?
শাশ্বত: এর আগে স্বস্তিকার সঙ্গে কাজ করেছে সুশান্ত। আমায় বলত, আপনার পরের কী কী ছবি আসছে? আমি অবশ্যই দেখব। সব বিষয়ে ওর আগ্রহ ছিল। ও খেতে খুব ভালোবাসত, বিশেষ করে মিষ্টি। আর সকলেরই একটা কমন আগ্রহ থাকে, বাংলার রসগোল্লা কেমন!
প্রশ্ন: দিল বেচারা দেখতে ডিজনি হটস্টার খুললে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ৩ জনের নাম দেখাচ্ছে। সুশান্ত সিং রাজপুত, সঞ্জনা সাঙ্ঘি আর সেফ আলি খান। কিজির মা বাবার মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের নাম নেই!
শাশ্বত: যাঁরা ছবি দেখে বেরচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু অন্য ধারণা নিয়ে বেরচ্ছেন। নামে কিছু যায় আসে না। চ্যানেলগুলোতে যখন সিনেমা দেখায় নাম দেখতে দেখতে মাথা খারাপ হয়ে যায়। যাঁদের দরকার তাঁরা ঠিক নাম জেনে নেবেন। এর থেকে বিতর্ক সৃষ্টি করার কোনও কারণ নেই।
প্রশ্ন: সুশান্তের মৃত্যুর পর স্বজনপোষণ নিয়ে যেমন কথা হয়েছে তেমনই আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে স্টারকিডদের কথা। তারকা শিল্পীদের সন্তানরাও তারকা হবেন এই আশা সবসময়ই থাকে। তারকা বাবার পুত্র হিসাবে সেই চাপটা আপনার ওপর কতটা ছিল?
শাশ্বত: ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখার প্রথম ১০ বছর তো আমি আমার নামটাই শুনতে পাইনি। সারাক্ষণ শুনেছি, শুভেন্দুর ছেলে। এটাই তো স্বাভাবিক। এই চাপটা সবাইকেই সামলাতে হয়। কেউ সেই চাপটা নিয়েই বড় হয়। কেউ পারে না। তারা শেষ হয়ে যায়।
প্রশ্ন: করোনা পরিস্থিতির জন্য কী কী কাজ আটকে রয়েছে?
শাশ্বত: এখনও শ্যুটিং শুরু করিনি। তবে ছবি মুক্তি আটকে রয়েছে। রাজকুমার সন্তোষীর ব্যাড বয় ছবিটা রিলিজ হতে পারেনি এখনও। ছবির কাজও রয়েছে হাতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার কাজ শুরু হবে।