কলকাতা : কথায় বলে বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। আর সেই ১৩ পার্বণে সবথেকে সেরা পার্বণ হল দুর্গা পুজো। তা সেই দুর্গা পুজো ছোটবেলায় কেমন কাটিয়েছেন, এটা বলার জন্য যদি এমন একজন মানুষ মুখ খোলেন, যাঁকে মানুষ চিনেইছিল 'তেরো পার্বণ' দিয়ে? সত্যিই তাহলে তো সোনায়-সোহাগা। হ্যাঁ, এটুকুতেই ঠিক ধরেছেন। আজ নিজের ছোটবেলার পুজোর স্মৃতি নিয়ে এবিপি লাইভে মুখ খুললেন বাঙালির বড় ভালবাসার এবং গর্বের সব্যসাচী চক্রবর্তী। 


সেই ১৯৮৭ সালে কলকাতা দূরদর্শনের 'তেরো পার্বণ' থেকে উত্থান তাঁর। আজ অভিনয় জগতে চার-চারটে দশক কাটিয়ে সেদিনের ওই রোগা মতো মানুষটা আমাদের মনে ঠিক কতটা জায়গাজুড়ে বিরাজ করেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শরতের পরিবেশে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, আজকের মানুষের কাছে পর্দার ফেলুদা নিজের ছোটবেলার দুর্গা পুজোগুলো কীভাবে কাটাতেন? ফেলুদা হয়েই? নাকি পাড়ার বা আত্মীয় কোনও ফেলুদা-র তোপসে হয়ে? বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বেণু দা যেন চকিতে ডুব মারলেন নিজের জীবনের সোনার সেই উঠতি বয়সের দিনগুলোয়। তারপর বলা শুরু করতে গিয়েই যেন মুহূর্তে ডেস্টিনেশন পাল্টে ফেলে বললেন, ''তাহলে আজ বরং, দিল্লির কথাই বলি। দিল্লিতে গিয়েছিলাম আমার দশ বছর বয়সে। তখন অবশ্য পুজো খুব একটা উপভোগ করতাম না। একেবারে ছোট ছিলাম। তাই বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরে চলে আসতাম। কিন্তু পুজোটা উপভোগ করা শুরু করলাম কলেজে পড়তে গিয়ে। তখন আমরা চিত্তরঞ্জন পার্কের কাছে কৈলাস কলোনিতে থাকতাম। সেখানেই দায়িত্ব নিয়ে পুজো করা শুরু করেছিলাম। লোকে বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা হয়েছিল যেন, চণ্ডী সেলাই থেকে জুতো পাঠ। চণ্ডী সেলাই বলছি তার কারণ, বইটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। আমায় সেলাই করে দিতে হয়েছিল। যেহেতু তখন আমায় পুজোর দায়িত্ব দেওয়া হল। তাতে আমি পুজোর নানা কাজে জড়িয়ে পড়লাম। সত্যিই পুজোটা উপভোগ করা শুরু করলাম। প্রসাদের ফল কাটা থেকে শুরু করে ভোগের আনাজ কাটা এসব তো ছিলই। আরও ভাল লাগতো সন্ধেবেলার নাটক বা যাত্রা কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। তার মঞ্চ বাঁধা। পর্দা তৈরি করা। যাঁরা নাটক করতে আসবেন তাঁদের জন্য গ্রিনরুম তৈরি করা। অডিও সিস্টেম চেক করে নেওয়া। এসব করতে। ঠাকুর আনা থেকে আরম্ভ করে বিসর্জন পর্যন্ত আমায় অনেক কাজের দায়িত্ব নিতে হতো। এর পাশাপাশি রিহার্সালও করতাম। নাটকও করতাম। পুজোর ঠাকুর আনা তো বটেই, তারও এক সপ্তাহ আগে আমার কাজ শুরু হতো। আর শেষ হতো বিসর্জন দিয়ে এসে সবাই মিলে কোলাকুলি করে। খুব-খুব উপভোগ করতাম দিনগুলো। কিন্তু, বয়স, জীবনের অভিজ্ঞতা, পরিবেশ, পরিস্থিতি সেই আমাকেই আজ পুজো থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে।''


আরও পড়ুন - ১২ বছরেই মাতৃহারা, সাবেকি দুর্গা প্রতিমার মুখে এখনও মা-কে খুঁজি: চিরঞ্জিত


কেন? কেন বলছেন এমন কথা? এখনকার পুজো কি তাহলে তাঁকে আর টানে না? যে সব্যসাচী চক্রবর্তি ক্ষনিক আগেও ছিলেন ১৮-১৯ বছরের উঠতি তরুণ। তিনিই যেন মুহর্তে নিজেকে গলিয়ে ফেললেন, ষাটোর্ধ্ব পরিণত মানুষের নতুন এক চরিত্রে। এখন মানুষটার অনুভূতিগুলোতে শুধু নিজের খুশি আর আনন্দ ধরা পড়ে না। বরং, সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের মনন জাঁকিয়ে বসেছে তাতে। বলছিলেন, ''বয়স এবং অভিজ্ঞতায় মানুষের তো একটা অন্যরকম মত তৈরি হয়, সেইভাবে ভাবলে মনে হয়, আজকের দিনে পুজো মানে টাকার অপচয়। আমাদের দেশটায়, রাজ্যটায় অনেক-অনেক গরিব মানুষ। তাঁদের দুটো খাওয়ার ব্যবস্থা করা। তাঁদের একটু নতুন জামা-কাপড় কিনে দেওয়া। তাঁদের একটু গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে এসে শহরের ঠাকুর দেখানোর ব্যবস্থা করা, এগুলো বেশি করে হলে মনটায় ভাল লাগতো বেশি।''


আরও পড়ুন - Durga Puja 2021 Exclusive: মায়ের পুজোয় আবার সাধারণ কিংবা ভিআইপিদের আলাদা আলাদা গেট হয় নাকি : তরুণ মজুমদার


বেশ লাগছিল কথাগুলো শুনতে। পর্দার ফেলুদা যেন কোনও তদন্তে নয় 'সামাজিক ময়না তদন্তে' নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছেন। আর তাই সব্যসাচী চক্রবর্তী বললেন, সেই কথাটা। যা কানে শোনা হল না ঠিক। সরাসরি বুকে এসে লাগলো। তিনি বললেন, ''আসলে কী জানেন? আমরা তো পুজো করি মা দুর্গাকে। কিন্তু, নিজের মাকে দেখি না। আমাদের সমাজের যত বঞ্চিত মা রয়েছেন, তাঁদেরকে দেখা উচিত। আমার কাছে এখন পুজো মানে ঠাকুর দেখা নয়। আমার কাছে এখন পুজো গরিব মায়েদের দেখা। ছোটবেলার দিনগুলোর দিকে পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় ওই সময়টায় বড্ড বেশি স্বার্থপর ছিলাম। পুজোয় নিজের আনন্দের কথাই ভাবতাম। কী আর করা যাবে। সব বোধ কিংবা মূল্যবোধই তো আর মানুষের ছোট থেকে তৈরি হয়ে যায় না। বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে এগুলো আমরা ভাবতে শিখি। এখন ভাবি, পুজোয় কোটি-কোটি টাকা বৃথা অপচয় হয়। তাই নিজেকে পুজো থেকে সরিয়ে নিয়েছি বটে। কিন্তু, জীবনে জুড়ে নিয়েছি অন্তত গোটা সাতেক NGO-কে। যাঁরা গরিব মানুষগুলোকে জামা-কাপড় কিনে দেয়। তাঁদের সন্তানদের খেলনা কিনে দেয়। আমিও এখন আর সেই দিল্লির ছেলেটি নেই। যে পুজোটা একসময় ওভাবে উপভোগ করতো। আজ আমার কাছে পুজো মানে এগুলোই। এখন আমাদের বোঝার দিন এসেছে, আজ আমাদের দেশের পরিস্থিতি এমন নয় যে, আমরা বিলাসিতা করতে পারি। বরং, যাঁদের নেই। তাঁদের জন্য ভাবি। বড় খারাপ লাগে যখন দেখি রিকসাওয়ালা আর যাত্রীর মধ্যে পাঁচ টাকা আর আট টাকা নিয়ে বিবাদ হয়। ওই তিনটে টাকা বেশি দিলে, মনে হয় না কেউ গরিব হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবটা হল, -ওই তিনটে টাকা পেলে হয়তো রিকশাওয়ালা মানুষটা দুপুরবেলায় দুটো শুকনো মুড়ির পরিবর্তে দুটো গরম ভাত খেতে পাবে। লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচ করে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে কী লাভ, যদি নিজের মাকে খেতে না দেওয়া হয়?' কথপোকথন শেষ হল। গর্বের সব্যসাচী চক্রবর্তীর উঠতি বয়সের পুজোর দিনগুলোর গল্প শোনাও শেষ হল। কিন্তু, নটে গাছটি মুরোলো না। বরং, এক নতুন ভাবনার অঙ্কুরোদ্গম হল...।