কলকাতা: পর্দায় আর কোনও মুখ নেই। কখনও ছাদের বাগানে, কখনও রান্নাঘরে কখনও জানলার ধারে। গোটা 'তাসের ঘর' জুড়ে রইলেন একজনই, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। আর তাঁর বন্ধু? ক্যামেরার ওপারে থাকা দর্শকরা। ওয়েব প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেল সুদীপ্ত রায়ের পরিচালনায় নতুন ছবি 'তাসের ঘর'। সুশান্তকাণ্ড থেকে বাবার স্মৃতি, ফিরে দেখা ২০ বছরের অভিজ্ঞতা, তাসের ঘরের গল্প, এবিপি আনন্দে অকপট স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়।


দেখুন সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার

https://bengali.abplive.com/videos/entertainment/exclusive-actress-swastika-mukherjee-unplugged-in-abp-live-734817/amp



প্রশ্ন: ছোটবেলায় কখনও তাসের ঘর বানিয়েছেন?

স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়: হ্যাঁ। ওই প্রথমে ৯টা, তারপর ৮টা, ৭টা। কিন্তু কোনওদিন একেবারে শেষ অবধি পৌঁছতে পারিনি। প্রত্যেকবারই পড়ে যেত। এই নিয়ে আমার আর বোনের মধ্যে খুব ঝগড়া হত যে তুই কেন জোরে নিঃশ্বাস নিলি তাই ঘর ভেঙে গেল। তারপর আর ধৈর্য্য থাকত না।



প্রশ্ন: যখন প্রথম তাসের ঘরে অভিনয় করার প্রস্তাব পেলেন, সুজাতা-র চরিত্র কেন আকর্ষণীয় লেগেছিল বা মনে হয়েছিল এটা করা উচিত?

স্বস্তিকা: আমাকে মে মাসে অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্য়ায় ছবির স্ক্রিপ্টটা পাঠান। আমায় লিখেছিলেন, 'আমরা একটা আকর্ষণীয় কাজ করব ভাবছি, একটু পড়ে দেখিস'। তখন সবে 'পাতাল লোক' মুক্তি পেয়েছে। খুব ব্যস্ত ছিলাম। তারপর সময় পেয়ে স্ক্রিপ্টটা পড়ে দেখে আমি পাগল হয়ে যাই। তখন ফোন করে বলি, তুমি আর কারোও সঙ্গে কথা বলবে না। আমি কলকাতা ফিরি তারপর এটা নিয়ে আলোচনা করব। তাসের ঘর-এর ফরম্যাটের মতো কাজ বাংলা ছবিতে আর হয়নি। পুরো ছবিটায় আর কেউ নেই, শুধুই সুজাতা। আমি অভিনেত্রী হিসাবে খুব লোভী। সবসময় মনে হয় নতুন কী করতে পারি। সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়েছিল ছবিটা করতেই হবে। আর মহিলারা সবসময় লড়াই করছেন নিজেদের কথা বলার জন্য। লকডাউনের মধ্যেও বিচ্ছেদ বা গার্হস্থ্য হিংসার প্রচুর তথ্য আমরা পেয়েছি। সিনেমা একটা ভীষণ শক্তিশালী মাধ্যম মানুষের কাছে পৌঁছনোর। ভালো ছবি হলে সেটা মানুষের মনে ছাপ ফেলে যায়।



প্রশ্ন: ক্যামেরাকে ভুলে অভিনয় করাটাই রীতি। কিন্তু ক্যামেরার সঙ্গে কথা বলে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ঠিক কতটা অন্যরকম?

স্বস্তিকা: খুব ভয়ঙ্কর! ২০ বছর কাজ করে এসেছি এটা ভেবেই যে ক্যামেরা সামনে নেই। কিন্তু তাসের ঘরে আমায় ক্যামেরার সঙ্গেই কথা বলতে হল। এখন মনে হচ্ছে আমি প্রো হয়ে গেছি। গোটা ইন্টারভিউ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দিয়ে দিতে পারব।



প্রশ্ন: ২০০১ সালে 'হেমন্তের পাখি' দিয়ে টলিউডে পা রাখেন, ২০০৪ সালে প্রথম প্রধান চরিত্র, ২০০৮ সালে বলিউডে পাড়ি, ফিরে দেখলে কেমন লাগে?

স্বস্তিকা: খুব ভয় লাগে।(হাসি) মাঝে মাঝে মনে হয় পথটা আর একটু মসৃণ হতে পারত। তবে ভালো লাগে এটা ভেবে যে আমি এতরকম কাজ করেছি। আগে অভিনয়টা এত খারাপ করতাম পরিচালকের কাছে চড়ও খেয়েছি। একজন পরিচালক আউটডোরে ফুলের টব ছুড়ে মেরেছিলেন। সেখান থেকে এখন পুরো একটা ছবির দায়িত্ব আমার কাঁধে। নিজের এই সাফল্যটা উপভোগ করি।



প্রশ্ন: আমাদের চারপাশের যে কোনও সুজাতার কাছে আপনি আদর্শ হতেই পারেন, আপনার নিজের সুজাতা হয়ে কেমন লাগল?

স্বস্তিকা: মন খারাপ হল খুব। আবার মনে হয়, আশেপাশের সুজাতারা আমায় খুব সাহস যোগায়। ভালোলাগাগুলোকে মানুষের সামনে ব্যক্ত করতে শেখায়। নিজের মত করে বাঁচতে শেখায়। আমাদের মা মাসিদের দেখেছি সবার খাওয়ার শেষে বিকেলবেলা খাবার খেতেন। রবিবার মাছ বা মাংসের সবচেয়ে ছোট পিসটা নিতেন। কিন্তু কখনও তাঁদের মধ্যে বিরক্তি দেখিনি। অথচ তাঁরাও লড়াই করে এসেছেন আমাদের জন্য। আমার মা সবসময় আমায় বলতেন, আমি এটা করে নিলাম, তুমি কিন্তু করবে না। তোমার মেয়েকেও এমন শেখাবে না। সেই সাহসটা তাঁরা সবসময় দিয়েছেন। মায়েরা একটা থ্যাঙ্কলেস চাকরি করে যান। এখন মা নেই তাই বুঝতে পারি সংসার চালানোটা কত কঠিন।



প্রশ্ন: স্বজনপোষণ নিয়ে সবসময় সরব আপনি। নিজে একজন নামী অভিনেতার মেয়ে, কাকা জনপ্রিয় অভিনেতা। পরিবারের পরিচিতি কি আপনাকে কখনও সাহায্য করেছে নাকি কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?

স্বস্তিকা: আমার বাবার পরিচিতিতে যদি সত্যিই আমার খুব সুবিধা হত, তাহলে আমি প্রথমেই বাংলা ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতাম। আমার প্রথম ছবি উড়িয়া ভাষায় ছিল। আমি চার বছর টেলিভিশন করেছি। আমি কমার্শিয়াল ছবিতে বোধহয় প্রধান চরিত্রে কখনই অভিনয় করিনি। সোশ্যাল মিডিয়া হওয়ায় মানুষ এখন খুব সহজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। যেন সন্তু মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে জন্মেই স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় হয়ে গিয়েছেন। এটা নিয়ে বাড়িতে প্রচুর অশান্তিও হয়েছে। একটা ঘটনা মনে পড়ে, কমার্শিয়াল ছবির যুগে তখন হরনাথ চক্রবর্তীর রাজত্ব। আমি ওনার কাছে একটা ছবির জন্য অডিশন দিতে গিয়েছিলাম। সেই ছবিতে আমায় কাস্ট করা হয়নি। অরুনিমা আর অনু চৌধুরী অভিনয় করেছিলেন। তখন বাবা হিরো হিসাবেও হরদার ছবিতে কাজ করছেন, খুব ভাল সম্পর্ক। আমি বাড়ি এসে কান্নাকাটি করে বাবাকে বহুবার বলেছিলাম, একবার হরদাকে একটা ফোন করতে। মাকেও বলতে বলেছিলাম। বাবা কিন্তু ফোনটা করেনি। তার প্রমাণ হল ছবির কাজটা আমি পাইনি। নেপোটিজিম, ফেবারিটিজম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছে কিন্তু সেটাকে জেনারালাইজড করা উচিত নয়। অভিনয় না জানলে আমি ২০ বছর ধরে ইন্ডাস্টিতে টিকে রইলাম কী করে! সব ক্রেডিট কেন বাড়ির বা বাইরের মানুষকে দেব? একটু তো নিজেকেও নিতে হবে!



প্রশ্ন: সুশান্তকে কীভাবে মনে রাখতে চান?

স্বস্তিকা: মিষ্টি স্বভাবের মানুষ। কাজ নিয়ে খুব আবেগপ্রবণ ছিল। গতানুগতিক ছবি ও কখনওই করতে চায়নি। ৭-৮টা ছবির মধ্যেও প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। ওর মধ্যে অভিনয় শেখার ক্ষিদেটা ছিল। আর খুব শিশুসুলভ ছিল সুশান্ত। শ্যুটিং-এর সময় ওর কাজকর্মের জন্য বকুনিও খেত। 'দিল বেচারা' নিয়ে ভেবেছিলাম কত আনন্দ করব।  ওটা আমার কেরিয়ারেরও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছবি। কিন্তু এখন ওই ছবির কথা উঠলেই মন খারাপ হয়ে যায়।



প্রশ্ন: সুশান্তের মৃত্যুর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত হচ্ছে। পাশাপাশি বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক সমীকরণ কাজ করছে এর নেপথ্যে। আপনি কী বলবেন?

স্বস্তিকা: পুরো বিষয়টাই এখন বিচারাধীন। এখনই এটা নিয়ে কোনও বক্তব্য রাখা উচিত নয়। আমি যা বলব সেটা সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর ভিত্তি করে বলা হবে। সিবিআই, পুলিশ সবাই যখন তদন্ত করছে তাঁরা আমাদের থেকে ভালো বিষয়টা বোঝেন। মানুষের একটু ধৈর্য্য ধরা উচিত। তবে সারা বিশ্বের মানুষের মতো আমিও ন্যায়বিচার চাই। জানতে চাই সেদিন ঠিক কী হয়েছিল। এতরকম তথ্য রোজ উঠে আসছে আর সেগুলো নিয়মিত বদলে যাচ্ছে, কোনটাকে বিশ্বাস করব!

প্রশ্ন: মিসেস বসুর চোখে কিজি বসু অর্থাৎ সঞ্জনা সঙ্ভি কেমন ছিলেন?

স্বস্তিকা: খুব পরিশ্রমী, ভদ্র, নম্র একটা মেয়ে। আমার সঙ্গে ওর বন্ডিংটা খুব ভালো। এখনও সেই যোগাযোগটা রয়ে গিয়েছে। সেটে ও আমায় নাম ধরে ডাকত বলে খুব বকা খেত। শ্যুট শুরু হলেই একটা মা মেয়ের সম্পর্ক আর সিন কাট হলেই ও বলত, স্বস্তিকা.. আমি বলতাম 'প্লিজ সঞ্জু তুই আমায় এইরকম করে ডাকিস না আমার শরীর খারাপ লাগে'।



প্রশ্ন: মাঝরাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাবার কথা লেখেন। কোন সময়টা বেশি করে মনে হয় বাবা থাকলে ভাল হত?

স্বস্তিকা: সবসময় মনে হয়। যখন আমার ছবি মুক্তি পায় তখন মনে পড়ে, বাবার ইচ্ছা না থাকলেও আমি জোর করে সব জায়গায় নিয়ে যেতাম। বলতাম, 'ছবিটা খুব বাজে হয়েছে কিন্তু তুমি আমার কাজটা দেখার জন্য চলো।' আমি জানতাম বাবা আমায় একদম সঠিক উত্তরটা দেবে। সেই টিউশান দেওয়ার লোকটা এখন নেই। আর জোয়ানের কৌটো থেকে চশমা, ওষুধ, বাবার সব জিনিস যেখানে থাকার সেখানেই আছে। সবসময় সেগুলো দেখলেই মনে পড়ে। মাঝে মাঝেই মনে হয়, এই বাড়িটা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাব। আমি বাবাকে কতবার বলতাম, আমি অনেক বুড়ি হওয়া অবধি প্লিজ থেকে যাও। কিন্তু আমার মা-বাবা দুজনেরই এত চলে যাওয়ার তাড়া ছিল..



প্রশ্ন: তাসের ঘর-এর সুজাতা গাছ ভালবাসে। অবসরে স্বস্তিকার শখ কী?

স্বস্তিকা: লকডাউনে অনেকটা অবসর পেয়েছি। যদিও বাড়ির কাজকর্ম ছিল। তবু অবসরে গান শুনি, সিনেমা দেখি, বই পড়ি আর প্রচুর খাই। আমি মেনে নিয়েছি তথাকথিত ছবির নায়িকাদের যতটা রোগা হওয়া উচিত ততটা আমি হতে পারব না। এই যেমন গতকালই সকাল থেকে প্রচুর ফল খেলাম। তারপরে রাত্রে চুনোমাছ দিয়ে ভাত খেয়ে ফেললাম। কোনওদিন মাংস, কোনওদিন বিরিয়ানি, রোজই কিছু না কিছু এরকম একটা হয়েই যায়। আর হ্যাঁ ফুলকি, আমার সারমেয়কেও প্রচুর সময় দিতে হয়।

প্রশ্ন: আর মেয়ের সঙ্গে?

স্বস্তিকা: মেয়ে আমার সঙ্গে মুম্বই থেকে ফিরেছিল। তারপর শেষ ২ মাস আমার বোনের বাড়ি শিফট হয়েছে। বাড়ি আসার কোনও নামই নেই। বললেই বলছে, 'তিনমাস তোমার মুখটা দেখেছি মা, আর সহ্য করতে পারছি না।' আর বোনকে যখন বলছি ওকে একটু পাঠা না, বলছে, 'ভেবে দেখছি'। মনে হয় না মেয়ে আর এই বছর ফিরবে (হাসি)।



প্রশ্ন: ২০০১ থেকে ২০২০, সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী?

স্বস্তিকা: এই পুরো জার্নিটা করে যে ২০ বছর টিকে আছি এটাই তো প্রাপ্তি।



প্রশ্ন: সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র?

স্বস্তিকা: অনেক প্রিয় চরিত্র রয়েছে। তবে মনে হয় তাসের ঘরের সুজাতা আমার সমস্ত কাজের মধ্যে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে থেকে যাবে। এই ছবিতে আমার একার কাঁধে সবটা দায়িত্ব রয়েছে। বাবা একটা কথা বলতেন, এই পেশাটা তারাবাজির মতো। খুব তাড়াতাড়ি আকাশে উঠে ঝলমলিয়ে সব সুন্দর লাগে, কিন্তু ততটাই তাড়াতাড়ি নিভে যায়। অস্ত্বিত্ব রক্ষাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর হ্য়াঁ, আমি নেড়া যেতে পেরেছি হিরোইন হয়ে। এটার পুরো ক্রেডিট তো আমি কলার তুলে নিয়ে নেব!

কথাটা বলেই প্রাণখোলা হাসি স্বস্তিকার!