কলকাতা: বলিউডে বক্স অফিসে ছবির ব্যবসা দিয়েই মাপা হয় তারকাদের যশ, খ্যাতি। কিন্তু কেবল অভিনয়, গ্ল্যামার বা পেশাদারি সাফল্য নয়, মানবিকতা দিয়েও যে অনায়াসে মন জয় করা যায় তা শেখালেন সোনু সুদ। আসমুদ্র হিমাচল যাঁকে চেনে ‘দাবাং’-এর ছেদী সিং’ হিসাবে। তাঁর নিষ্ঠুর চাহনি, পেশিবহুল চেহারা আর খুনে মেজাজ দর্শকদের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বইয়ে দেয়। করোনা আবহে অবশ্য উলটপুরাণ হয়েছে। পর্দার খলনায়ক সোনু এখন জনতার চোখে ‘মসিহা’। লকডাউনে ভিনরাজ্যে আটকে পড়া শ্রমিকদের ফেরাতে তাঁর মহৎ উদ্যোগ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নিজে রাস্তায় নেমে শ্রমিকদের ফেরার ব্যবস্থা করেছেন। হাতে তুলে দিয়েছেন খাবারের প্যাকেট, জল।

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার ভাবনাটা এল কীভাবে? এবিপি আনন্দের প্রশ্ন শুনে হাসলেন সোনু। মুম্বই থেকে মোবাইল ফোনে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন, ''আমার মনে হয়েছিল ঘরে বসে কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় দুঃখপ্রকাশ করে কোনও লাভ নেই। রাস্তায় নেমেই একমাত্র পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্য করা সম্ভব। তবে প্রত্যেকের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কাজ করা জরুরি এমন নয়। ঈশ্বর হয়তো আমায় এইটুকু কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছেন। আমি শ্রমিকদের সাহায্য করতে পেরে খুশি।'' সোনু আরও বললেন, ''এই সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল ভরসার। এটা বোঝানো জরুরি ছিল যে, ওঁদের সাহায্যের জন্য কেউ রয়েছে, কেউ ওঁদের কথা ভাবছে। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে সাহায্য করছেন। আমি পথে নেমে সাহায্য করার পদ্ধতি বেছে নিয়েছি।''

প্রথমবার উদ্যোগী হয়ে মাত্র ৫০ জন শ্রমিককে বাড়ি পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন সোনু। বিভিন্ন দফতর থেকে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছিল তাঁকে। সোনু বলছেন, ''প্রথমে আমি পথে নেমে পরিযায়ীদের সঙ্গে কথা বলতাম, জানতে চাইতাম যে তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন, কী কী সমস্যা হচ্ছে। কেউ ওড়িশা যেতে চাইছিলেন তো কেউ রাজস্থান, কেউ ঝাড়খণ্ড তো কেউ কর্ণাটক। প্রচুর মানুষ হাহাকার করছিলেন বাড়ি ফেরার জন্য। প্রথমদিকের সীমিত ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ মানুষকে বাড়ি ফেরানো চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমার জুহুর হোটেলে স্বেচ্ছাসেবীদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। তাঁরা সেখানে খাওয়া ও সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজে যোগ দিচ্ছিলেন।''

বিশাল এই আয়োজন কীভাবে সম্ভব করলেন? এর নেপথ্যে পরিবারকে কৃতিত্ব দিলেন সোনু। বললেন, ''পরিবার সবসময়ই আমার সঙ্গে ছিল। মা-বাবা ছোট থেকে শিখিয়েছিলেন, সবসময় মানুষের পাশে থেকো, সাধ্যমতো সাহায্য কোরো। স্ত্রী সোনালি যথাসম্ভব সাহায্য করছে। বন্ধু নীতি গোয়েল বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলে সাহায্য করছে। আর্থিক ব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়েছে আমার চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট পঙ্কজ। আমরা সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করেছি কী করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরানো যায় পরিযায়ীদের। এছাড়াও রোজ প্রচুর মানুষ আমাদের দলে নিজে থেকেই যোগ দিয়েছেন। সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। প্রধানত তামিলনাড়ু, তেলঙ্গনা আর অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রমিকদের ফেরাবার চেষ্টা করছি আমি।''



বাবার কাজ নিয়ে কী বলছে দুই পুত্র ছোট্ট ইশান্ত আর আয়ান? সোনু হেসে বললেন, ''দুই ছেলে আমার কাজ নিয়ে খুব খুশি। আশা করব ওরাও যেন বড় হয়ে মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করে। তবে ওরা এখন খুব ছোট। ফিল্ডে প্রচুর মানুষের জমায়েতের জন্য বিপদের সম্ভাবনা থাকে। তাই আমি এখনই ওদের সঙ্গে নিয়ে কাজে যাই না।''

শুধু কি মুম্বই, তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল? বাংলার শ্রমিকদের দিকেও সমানভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সোনু। এবিপি আনন্দকে অভিনেতা বললেন, ''ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে দুটো ট্রেন পাঠিয়েছি। ৪০-৪২টি বাসে করে আমি প্রায় ৫০০০ পরিযায়ী শ্রমিককে বাংলায় নিজের বাড়ি পাঠিয়েছি।'' কেবল করোনা নয়, সোনুর কথায় উঠে এল পশ্চিমবঙ্গের উমপুন পরিস্থিতিও। বললেন, ''আমি জানি উমপুনে পশ্চিমবঙ্গের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আমি এও জানি, বাঙালিরা যথেষ্ট সাহসী। তাঁরা করোনা-উমপুন পরিস্থিতিকে খুব তাড়াতাড়িই কাটিয়ে উঠবেন।''

হাজার হাজার মানুষ ভগবানের আসনে বসিয়েছেন সোনুকে। কিন্তু কেবল কি নিজের উদ্যোগে পরিযায়ীদের বাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছেন সোনু? তাঁর কাজকে রাজনীতির রঙ লাগানোর চেষ্টা করে হয়েছে অনেকবার। বার বার অভিযোগ উঠেছে বিজেপি বা শিবসেনার থেকে সাহায্য পেয়েছেন তিনি। কিন্তু এই অভিযোগ উড়িয়ে সোনু বললেন, ''রাজনীতিতে আমার কোনও আকর্ষণ নেই। অভিনেতা হিসাবে এখনও আমার অনেক কিছু অর্জন করা বাকি।''

সিনে ইন্ডাস্ট্রির জুনিয়র আর্টিস্ট থেকে স্পটবয়, নৃত্যশিল্পী, আলোকশিল্পীদের পাশেও সাধ্যমতো দাঁড়িয়েছেন সোনু। বললেন, ''আমরা দরিদ্র শিল্পীদের সাহায্য পাঠাচ্ছি। এই করোনা পরিস্থিতিতে ওঁদের রেশন পাঠানো হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া অবধি আমরা এই সাহায্য পাঠাব।''



দেশ জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় পরিযায়ীদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন সোনু। কিন্তু ঘরে ফিরেও শান্তিতে নেই বহু মানুষ। করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে পেটের দায়ে কাজেই ফিরতে চাইছেন তাঁরা। তাঁদের জন্যেও পরিকল্পনা রয়েছে সোনুর। বললেন, ''অনেক মানুষ করোনা পরিস্থিতিতে কাজ হারিয়েছেন। আমি তাঁদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে কাজও। আশা করছি অনেক মানুষকেই অন্নসংস্থানের কিছু ব্যবস্থা আমরা করে দিতে পারব।''

একাই পরিযায়ীদের মধ্যে মিশে যান সোনু। তবে মুম্বইয়ের অবস্থার কথা মাথায় রেখে মেনে চলেন সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় সতর্কতা। শুধু তাই নয়, পরিযায়ীদেরও বার বার মনে করিয়ে দেন মাস্ক পরার কথা। বাড়ি ফেরার তাগিদে পথেই মৃত্যু হয়েছে অনেক পরিযায়ী শ্রমিকের। সেই সমস্ত পরিবারকেও ভুলে যাননি সোনু। শিশুদের পড়াশোনা থেকে বাড়ি তৈরি, গত দু’মাস ধরে প্রায় ৪০০ পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। ভবিষ্যতেও এই সাহায্য পাঠাবেন বলে জানিয়েছেন।



পরিযায়ীদের দুর্দশা যেমন স্পর্শ করেছিল সোনুকে, ঠিক তেমন ভাবেই আঘাত দিয়েছে সহ অভিনেতা, বন্ধু সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুও। সুশান্তের মতো বলিউডে কোনও পূর্ব পরিচিতি ছিল না সোনুরও।



মোবাইলের ওপার থেকে এবিপি আনন্দর কাছে তিনি বললেন, ''আমি চিরকাল সুশান্তকে মিস করব। তবে বলিউড এমন একটা জায়গা যেখানে বহিরাগতরাও সমান যশ-খ্যাতি অর্জন করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে অনেক তারকা নেপোটিজম বা স্বজনপোষণের সাহায্য পেয়েছেন সেকথা সত্যি। কিন্তু পরিচিতি ছাড়া বলিউডে এসেও নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন অনেক তারকা। শুধু নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে।''