কলকাতা: মামা আলেক পদমসি চলে গিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। আর এবার চলে গেলেন ভারতীয় নাটকের আরও এক লেজেন্ড তাঁর পিতা ইব্রাহিম আলকাজি। স্বাভাবিক কারণেই মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত পুত্র ফয়জল আলকাজি। আলকাজি সাহেবের নাট্যজগতে আসা, দলগঠন, এমএফ হুসেনের মতো শিল্পী-বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক, এনএসডি-র দায়িত্ব নেওয়া ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর কথা শুনলেন ইন্দ্রনীল শুক্লা

প্রশ্ন- মামাবাড়ি আর বাবা, সব মিলিয়ে তো মারাত্মক একটা নাটকের পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন আপনি। এই বিরল অভিজ্ঞতা তো কম মানুষের জীবনেই ঘটে। যদি শেয়ার করেন..
ফয়জল আলকাজি-একটা কথা কিন্তু অনেকেই জানেন না। আমার বাবা ইব্রাহিম আলকাজি কিন্তু নাটক শিখেছিলেন আমার মামাবাড়ি অর্থাৎ পদমসি পরিবার থেকে। বাবা যখন মুম্বইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তেন তখন আমার মামা এবং অন্যান্য নাট্যচর্চাকারী তরুণদের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। সকলেই খুব পড়াশোনা করা মানুষ। তাই গল্প-আড্ডার মধ্য দিয়ে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হতে বিশেষ সময় লাগেনি। আমার মামা বাড়িতে তখনই থিয়েটারের কাজ হতো। নিয়মিত রিহার্সাল হতো দলের। এই পরিবেশ, পরিমন্ডলটাই প্রাথমিকভাবে ইব্রাহিম আলকাজিকে মঞ্চের দিকে আকৃষ্ট করে। পরে ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে আরও অনেক পরিপুষ্ট করে তুলেছিলেন চর্চার মধ্য দিয়ে।
প্রশ্ন- আপনার বাবা তো পরে নিজের দল তৈরি করেছিলেন?
ফয়জল- হ্যাঁ। আসলে বাবা পদমসি পরিবারের থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন। সেসব আত্মীকরণ করেছিলেন। আবার পাশাপাশি অন্যান্য নানা ইনফ্লুয়েন্সও তাঁর মধ্যে কাজ করতে শুরু করল। একটা সময় তাঁর মনে হয় যে নিজের স্টাইল, নিজের প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা দরকার। সেই ভাবনা থেকেই নিজের দল তিনি তৈরি করেন।তার মধ্য দিয়েই ইব্রাহিম ঘরানার প্রকাশ ঘটান তিনি।
প্রশ্ন-বাবাই কি আপনাকে নাটকে নিয়ে আসেন, নাকি আপনি নিজের থেকেই নাটকের মধ্যে প্রবেশ করেন?
ফয়জল- সত্যি কথা বলতে কী, এই দুটোর কোনওটাই সঠিক নয়। আবার দুটোই আংশিকভাবে সত্যি। আমি মামাবাড়িতে নাটকের চর্চা তো দেখেইছি। আবার বাবা যখন নিজের দল গড়লেন, তখন তো ব্যাপারটা ঘরে ঢুকে পড়ল। বাবা সারাদিন লিখছেন স্ক্রিপ্ট, এডিট করছেন, অনেকে আসছেন বাবাকে নানা পরামর্শ দিতে, বাবাও তাঁদের নতুন নতুন আইডিয়ার কথা বলছেন। সব মিলিয়ে ঘরের হাওয়ায় কেবলই নাটক। এই ভাইরাস থেকে তো রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই।
প্রশ্ন-বাবা আপনাকে প্রথম কেমন চরিত্রের জন্য মনোনীত করেন, বা কিভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সে চরিত্র?
ফয়জল-আমি তো ছোট্ট থেকেই অভিনয় করেছি বাবার দলে। খুব আলাদা করে ব্রিফিং আমায় দিতে হত না, কারণ আমি তখন তেমন কোনও রোল তো করতাম না। নতুন কোনও নাটক হবে শুনলেই আমি উৎসাহ নিয়ে ঘুরঘুর করতাম। স্ক্রিপ্ট পড়ার সময়ে শুনতাম। ভালো লাগতো। আর প্রত্যেক নাটকেই এক-আধটা শিশু চরিত্র থাকতো। আমি তো সামনেই বসে থাকতাম। ফলে অবভিয়াস চয়েস!
প্রশ্ন- আপনাদের বাড়িতে তো বিরাট বড় বড় মানুষজনের আনাগোনা ছিল। একটু তেমন স্মৃতি যদি শোনান...
ফয়জল- কাকে ছেড়ে কার কথা বলব। আমাদের বাড়ির টেরেসে রিহার্সাল হত। নাটক আস্তে আস্তে যখন পূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে শুরু করত, তখন একে একে বাবার বিদগ্ধ বন্ধুরা আসতেন। বাবার ভীষণ বন্ধু ছিলেন এমএফ হুসেন। ইব্রাহিম নতুন নাটক বাঁধছে শুনলেই তিনি হঠাৎ করে চলে আসতেন রিহার্সাল দেখতে। তারপর সারাদিন কাটিয়ে দিতেন। ছবি, নাটক, সাহিত্য কত কিছু নিয়ে যে তাঁদের কথা হত, তার ইয়ত্তা নেই।
প্রশ্ন-ইব্রাহিম আলকাজির সঙ্গে এমএফ হুসেনের সম্পর্ক কেমন ছিল?
ফয়জল- ওঁরা ভীষণ ভালো বন্ধু ছিলেন। আর ওঁদের মধ্যে মারাত্মক মতের অমিল হতো। বাবা ডানদিক বলেন, তো হুসেন সাহেব যান বাঁদিকে।পরে বড় হয়ে মনে হয়েছে পরস্পরের মতের অমিলগুলো উভয়েই এনজয় করতেন। একে অপরের মতের দ্বারা সমৃদ্ধ হতেন। সেজন্যই দুজনে ঝগড়া করতেন, কিন্তু কেউ কাউকে ছেড়ে যেতেন না। অনেকটা অল্টার ইগোর মতো। বাবা যখন ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’ করলেন, হুসেন সাহেবই তো সেট ডিজাইন করলেন। আর একটা কথা খুব মনে পড়ছে, একদিন বাবা আর হুসেনের খুব ঝগড়া হলো। মনে হল সম্পর্ক বুঝি শেষ। তবুও পরদিন ‘মেদেয়া’ নাটকের শো দেখতে হুসেন এলেন। শো শেষ হওয়ার পর দেখা না করে সোজা বাড়ি ফিরে গেলেন। কিন্তু পরদিনই সকাল সকাল আমাদের বাড়ি চলে এলেন।হাতে রোল করে এনেছেন বেশ কয়েকটা ছবি। বললেন, কাল তোমার নাটক দেখে রাতে এঁকেছি। দ্যাখো! এই ছিল ওঁদের সম্পর্ক।
প্রশ্ন- আলকাজি সাহেব ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়টা কেমন করে ঘটল?
ফয়জল- একটু হঠাৎ করেই বলতে পারেন। লেট ফিফটিজের সময়ে বাবা নিয়মিত ‘ইডিপাস’ নাটকটা মঞ্চস্থ করছেন। আবার একই সময়ে দাঁড়িয়ে শম্ভু মিত্রও একই নাটক করছেন। দুজনেরই প্রোডাকশনই মারাত্মক। একই নাটক অথচ সারা দেশের মানুষ দুটো প্রোডাকশন নিয়েই উন্মাদ। দুজনের আলাদা আলাদা স্টাইল, প্রেজেন্টেশন। এ বলে আমাকে দেখ, ও বলে আমাকে। তো এই রকম একটা সময়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু-ও দুটো প্রোডাকশন দেখে ফেললেন। তখন এনএসডি-কে মজবুত ও উন্নত করে গড়ার বিষয়টি তাঁর মাথায় ঘুরছে। ইব্রাহিম আলকাজি আর শম্ভু মিত্র উভয়ের সঙ্গেই তিনি কথা বললেন এবং এনএসডি-র দায়িত্ব নিতে বললেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে দুজনেই না বললেন।
প্রশ্ন- সে কী, কেন? কীসে সমস্যা হল?
ফয়জল- শম্ভুবাবু তখন বাংলার নাট্য আন্দোলন নিয়ে মারাত্মক ব্যস্ত ছিলেন। নিজের দলের প্রোডাকশন নিয়েও তাঁর দম ফেলার সময় ছিল না। বাংলা ছেড়ে তিনি দিল্লিতে এনএসডি-র জন্য সময় দিতে রাজি হলেন না। আর বাবা-র হিন্দি তেমন মজবুত ছিল না। সেটা নিয়ে তিনি দ্বিধায় ছিলেন। শেষটায় বাবা রাজি হলেন।কিন্তু পন্ডিত নেহরুর থেকে তিন-চার বছর সময় চেয়ে নিলেন। এই সময়টায় তিনি বাড়িতে রীতিমতো শিক্ষক রেখে হিন্দি চর্চা করলেন। যখন মনে করলেন এবার তিনি প্রস্তুত, তখন এনএসডি-র দায়িত্ব নিলেন।
প্রশ্ন- অন্য রকম স্পেসে নাটক করা নিয়ে আলকাজি সাহেবের বিভিন্ন রকমের নতুন নতুন আইডিয়া ছিল বলে শুনেছি।
ফয়জল- আসলে হল পাওয়া ইত্যাদি নিয়ে বহু দলেরই নাটক করতে সমস্যা হয় দেখেছি। কিন্তু ব্যাপার হল, নাটক তো আর সিনেমা নয়। নাটক কিন্তু চাইলে একটা লাইব্রেরি, হলঘর, এমনকী মাঠের মাঝে বড় বটগাছের তলাতেও সাফল্যের সঙ্গে করা সম্ভব। নাটক মঞ্চস্থ করার সময় আমি বাবার থেকে শেখা এই কথাগুলো আজও মনে রাখি। একই নাটক প্রসেনিয়ামে যেমন করা যায়, তেমনই অন্যভাবে ডিজাইন করলে অন্য স্পেসে করা যায়, এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন ইব্রাহিম আলকাজি। নিজে করে দেখিয়েওছিলেন। আমাদের বাড়ির টেরেসে উনি অভিনয় করছেন আর চারপাশ থেকে মানুষ তন্ময় হয়ে নাটক দেখছে, এটা তো ছেলেবেলায় আমার নিজের চোখে দেখা। অমন সহজ করে নাটকের ব্যাকরণ আর কে শিখিয়ে দেবেন!