পুরুষোত্তম পণ্ডিত, কলকাতা: ‘পাগলপনকে হদসে না গুজরে তো ও পেয়ার ক্যায়সা, হোশ মে তো রিস্তে নিভায়ে যাঁতে হ্যায়।’ হাসিন দিলরুবার ক্লাইম্যাক্সের শেষে এই সংলাপেই যেন ছবির সারাংশ বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিচালক বিনিল ম্যাথিউ। নেটফ্লিক্সে শুক্রবার মুক্তি পেল তাপসী পান্নু, বিক্রান্ত মেসি, হর্ষবর্ধণ রাণে, আদিত্য শ্রীবাস্তব অভিনীত ছবি হাসিন দিলরুবা।


সাদামাটা, মধ্যবিত্ত পরিবারের উঠোন, বাড়ির চার দেওয়াল আর জ্বালাপুরের মতো গঙ্গাতীরের ছোট্ট এক শহরের প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে এই ছবির কাহিনি। দুই নারী-পুরুষের মধ্যে ভালবাসা, প্রতিহিংসা, ঘৃণার এক আবর্তে ঘুরপাক খায় হাসিন দিলরুবার চিত্রনাট্য। ছবিতে তাপসী পান্নুর চরিত্রের নাম রানি। বিক্রান্তের চরিত্রের নাম ঋষভ। সম্বন্ধ করে বিয়ে হয় তাঁদের। প্রথম আলাপেই স্বল্পবাক ঋষভের মন জিতে নেয় রানি। হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল রানিকে নিয়েই জীবনের রঙিন স্বপ্ন বুনতে শুরু করে ঋষভ। স্বভাবে, আচার-আচরণে তাঁদের দু’জনের মধ্যে কোনও মিল নেই। এই বৈপরীত্যকেই অতিক্রম করে নিজেদের দাম্পত্য জীবন সাজানোর চেষ্টা করতে থাকে তারা।


কিন্তু সম্পর্কের সমীকরণে কাঁটা তো থাকবেই। সেই কাঁটাতেই রক্তাক্ত হয় ঋষভের হৃদয়। ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে। দু’জনের মাঝে তৈরি হয় এক শীতল দেওয়াল। আর এই পরিস্থিতি থেকেই কাহিনি নতুন মোড় নেয় ঋষভের তুতো ভাই নীল তাঁদের বাড়িতে আসার পর। নীলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন হর্ষবর্ধন। ডাকাবুকো, স্বাস্থ্যবান নীল খরস্রোতা নদীতে রাফটিং করে। নীলের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে রানির। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে যেখানে বনিবনা হচ্ছে না, সেখানে নতুন পথে হাঁটার স্বপ্ন দেখে সে। এরপর এই তিন চরিত্রকে ঘিরেই তৈরি হয় রহস্যের ঘূর্ণাবর্ত।


ছবিতে দেখা যায়, রহস্য উপন্যাস লেখক দীনেশ পন্ডিতের বই গোগ্রাসে গেলে রানি। বইয়ের পাতায় রহস্য যে ভাবে দানা বাঁধে, ছবির চিত্রনাট্যেও সেই ভাবেই রহস্যের স্বাদ গাঢ় করার চেষ্টা করেছেন চিত্রনাট্যকার কণিকা ধিঁলো। কিন্তু তাঁর প্রয়াস ছবিটিতে গতি আনার বদলে কিছুটা স্থুলতাই যোগ করেছে। কোথাও কোথাও বাস্তবের সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়েছে ছবিটি। কাহিনি বলার ঢঙে রানির চরিত্রটির ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেও ঋষভের চরিত্রটিকে কিছুটা ঝাপসা কাচের ওপার থেকেই যেন দেখতে হয়। চিনেও চেনা যায় না তাঁকে।


একথা বলতেই হয়, ‘হাসিন দিলরুবা’-র নির্মাণগত খামতি ঢেকে ছবিটিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাপসী এবং বিক্রান্তের দুর্দান্ত অভিনয়। সংলাপের সাবলীলতায় তো বটেই, শুধু চোখের ভাষাতেও তাঁরা যা উপহার দিয়েছেন, তা নজরকাড়া। বিয়ের পর সংসার করতে হলে মেয়েদেরই কেন ঘরের কাজ জানতে হবে? ঘরোয়া শব্দের অর্থ কি? এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে রানি আর তাঁর শাশুড়ির সম্পর্ক ছবিতে কমেডির অক্সিজেন যোগায়। অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক ধ্যানধারণার চেনা ছক ভেঙে এগিয়ে যায় রানির চরিত্রটি। থাপ্পড়-এ তাপসীর চরিত্রটি যেমন প্রতিবাদী নারীকন্ঠ হয়ে উঠেছিল, রানির চরিত্রের মধ্যেও যেন সেই আভাস মেলে। রানি দিল্লির মেয়ে। বিয়ের পর ছোট শহরে এসে সেখানকার মানসিকতার সঙ্গে তাঁর লড়াইটাও প্রকট হয়। কাহিনির প্রথম দিকে রানির প্রতি ঋষভের সম্মানসূচক একটা ভালবাসা দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে তাঁর ভিতরে লুকিয়ে থাকা সেই পুরুষতান্ত্রিক চেহারা বেরিয়ে আসে।


রানির শাশুড়ির চরিত্রে যামিনী দাসের অভিনয় অনবদ্য। তাঁর কমেডি টাইমিংও নজর কাড়বে। পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় আদিত্য শ্রীবাস্তবও ভাল অভিনয় করেছেন। তবে সামগ্রিক বিচারে এই ছবিটি পরিপক্কতার অভাব রয়েছে। কাহিনি যতটা টানটান ভাবে এগোতে পারত, তা হয়নি। পরিচালক কাহিনির মধ্যমণি হিসেবে যে  ফুলদানিতে গোলাপটি রেখেছেন, সেই ফুলদানির চিড়গুলোই প্রকট হয়েছে ছন্দপতন ঘটিয়েছে।