নয়াদিল্লি: 'ওদের (প্রযোজক) টাকাপয়সা নিয়ে কিছু বলতে হবে না। আমার ওদের সঙ্গে ঝগড়া আছে, তোমার সঙ্গে নেই। আমি এটা তোমার জন্য গাইছি, 'ফিল্মিস্তান'-এর (প্রযোজনা সংস্থা) জন্য নয়।' হেমন্ত কুমার (Hemant Kumar) যখন 'আনন্দ মঠ' (Ananda Math) ছবিতে তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় গান গাওয়ার জন্য লতা মঙ্গেশকরকে (Lata Mangeshkar) বলেন তখন এমনটাই ছিল তাঁর উত্তর।


হেমন্ত কুমার, যিনি শুধু একজন সঙ্গীত পরিচালকই ছিলেন না, লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে অসংখ্য গান গেয়েও ছিলেন, তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে এই প্রতিভাবান গায়িকা তাঁর জন্য কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ১৯৫২ সাল, প্রযোজক সুধাংশু মুখোপাধ্যায় হেমন্ত কুমারকে বলেন তাঁর আগামী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে তৈরি 'আনন্দ মঠ' ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করার কথা। হেমন্ত চেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর কণ্ঠ দিন, কিন্তু সুধাংশু বাবুই জানিয়েছিলেন যে 'ফিল্মিস্তান'-এর সঙ্গে তাঁর সমস্যা আছে এবং তাই তিনি গাইবেন না।


হেমন্ত কুমার ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে লতা মঙ্গেশকরই গান গাইবেন, অন্যথায় গানের সেই আবেদন থাকবে না। তিনি সুধাংশু মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করেন যে তিনি একবার চেষ্টা করতে পারেন কি না। সুধাংশু বলেন, 'যদি লতা মঙ্গেশকর গান গাইতে রাজি হন তাহলে তো কোনও কথাই নেই, কিন্তু আমার মনে হয় না ও গাইবে বলে', লিখছেন হেমন্ত।


হেমন্ত কুমার তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, 'মুম্বইয়ের নানাচকের এক ভাড়া বাড়িতে তখন তিনি থাকছিলেন। একদিন সকালে আমি গেলাম ওঁর কাছে। কুশল বিনিময় করার পর আমি আসল কথায় এলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি গাইতে রাজি হয়ে গেলেন। এরপর যখন আমি ওঁকে পারিশ্রমিকের কথা জিজ্ঞেস করলাম যাতে আমি প্রযোজককে বলতে পারি, উনি বললেন যে টাকাপয়সা নিয়ে কোনও কথা আমাকে বলতে হবে না। "ফিল্মিস্তানের সঙ্গে আমার ঝগড়া আছে এবং আমি গইতে রাজি হয়েছি শুধু তোমার জন্য"। এটা অকল্পনীয় ছিল।'


এই সঙ্গীত গুরুর সঙ্গে যে হেমন্তের আজীবন সাহচর্য ছিল, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি নন, বাংলার গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালকদের প্রতি লতা মঙ্গেশকরের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা গভীরভাবে প্রোথিত ছিল এবং তা পেশাদারিত্বের পরিধি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। 'কোকিলকণ্ঠী' লতা মঙ্গেশকর বাংলা জানতেন না কিন্তু তাঁর এই ভাষার প্রতি ভালবাসা এত গভীর ছিল যে তিনি বিখ্যাত পরিচালক বাসু ভট্টাচার্যের থেকে শিখেছিলেন বাংলা।


বিখ্যাত বাঙালি সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর প্রতি তাঁর অটুট শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল এবং প্রায়ই জনসমক্ষে তাঁকে বলতে শোনা গেছে যে সলিল চৌধুরী একজন বিরল প্রতিভা। লতা মঙ্গেশকর ও সলিল চৌধুরী একসঙ্গে প্রায় ৩৫টি গান তৈরি করেছেন যেগুলির মধ্যে অন্যতম হল 'সাত ভাই চম্পা', 'না যেও না', 'আর কিছু তো নাই', 'কী যে করি', 'আজ তবে এইটুকু থাক'। 


একবার লতা মঙ্গেশকর বিথোভেনের নাইন্থ সিম্ফনির কিছু এলপি রেকর্ড বিদেশ থেকে এনে সলিল চৌধুরীকে উপহার দেন। 'দাদা, তোমাকে ছাড়া আর কাকেই বা এগুলো দিতে পারি?' সলিল চৌধুরীকে বলেন লতা মঙ্গেশকর। যখনই কাউকে ওই উপহার তিনি দেখাতেন , গর্ব করে বলতেন লতার কথাগুলো।


আরও পড়ুন: Lata Mangeshkar last Rites: পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তোপধ্বনি করে অন্তিম শ্রদ্ধা, চিরবিদায় সুর-সম্রাজ্ঞী


বেশ অনেক পরে, বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন মুম্বইয়ের এক স্টুডিওয় লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে সুচিত্রা সেনকে বাংলায় কথা বলতে অনুরোধ করেন লতা। 'আমি ভাল বলতে পারি না কিন্তু আমি বুঝতে পারি', এমনটাই না কি লতা মঙ্গেশকর বলেছিলেন সুচিত্রা সেনকে। সঞ্জীব কুমার অভিনীত ছবি 'আঁধী'তে সুচিত্রা সেনের গলায় গেয়েছিলেন লতা।


লতা মঙ্গেশকর প্রায় ৩৬টি ভারতীয় ও বিদেশী ভাষায় গান গেয়েছিলেন। তার মধ্যে বাংলার একাধিক প্রথম সারির সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। যেমন শচিন দেব বর্মন, হেমন্ত কুমার, সলিল চৌধুরী। লতা মঙ্গেশকর বাংলায় প্রায় ১৮৫টি গান গেয়েছেন। বাংলার শ্রোতাদের কাছে তাঁর 'আকাশ প্রদীপ জ্বলে' (সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনা) এবং 'প্রেম একবার এসেছিল নীরবে' (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।