কলকাতা: সাল ২০১৪। প্রথমবারের জন্য দিল্লির মসনদে বসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তারপর নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে গিয়েছে ৬ বছর। দ্বিতীয়বারের জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে মোদি সরকার। করোনা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতে দেওয়া চাকরির প্রতিশ্রুতি, পরিযায়ী শ্রমিক থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা, নারী সুরক্ষা, শিক্ষা-শিল্প, বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কী কী প্রত্যাশা? মোদি সরকারের দ্বিতীয় দফার প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রধানমন্ত্রীকে বার্তা পাঠালেন বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের কলাকুশলীরা।





  • সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়:


পর্দায় তিনি কখনও ফেলুদা, কখনও অপু আবার কখনও ক্ষিদ্দা। যদিও মন ভাল নেই তাঁর। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশায় ব্যথিত। তিনি, কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দ্বিতীয় মোদি সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির লগ্নে এবিপি আনন্দকে সৌমিত্র বললেন, ‘করোনা মোকাবিলায় লকডাউন কেন্দ্রের ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানোর জন্য সঠিক ও সময়োপোযোগী ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। ওঁদের দুর্দশা দেখে আমি মর্মাহত। আগাম পরিকল্পনা করার প্রয়োজন ছিল।’ সৌমিত্র যোগ করলেন, ‘ভবিষ্যতে সরকারের উচিত দেশের মানুষের স্বার্থে আরও ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রয়োজনে সরকার বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে পারে।’





  • দেবশঙ্কর হালদার:


নাটকের মঞ্চ থেকে রুপোলি পর্দা, তাঁর সাবলীল অভিনয় মন কেড়েছে দর্শকদের। বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে, সামাজির দূরত্ব মেনে তিনি, দেবশঙ্কর হালদার, টেলিফোনেই এবিপি আনন্দকে জানালেন মোদি সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিতে তাঁর প্রতিক্রিয়া। বললেন, ‘করোনা ভাইরাস আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে সমস্ত লড়াই গুলি-গোলা, বন্দুক-কামানের নয়। কেবল শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী থাকলেই দেশকে রক্ষা করা যায় না। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেবল ধনীদের জন্য নয়, একেবারে প্রান্তিক মানুষের কাছেও সমানভাবে পৌঁছে দিতে হবে স্বাস্থ্য পরিষেবা। তাই সরকারের উচিত প্রতিরক্ষা খাতের সমান অর্থ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করা। প্রয়োজন হলে প্রতিরক্ষা খাতে কাটছাঁট করতে হতেও পারে, কিন্তু আপোস করা যাবে না দেশবাসীর স্বাস্থ্যের সঙ্গে। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে এই পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত সরকারের।’ সম্প্রতি ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। দেবশঙ্কর বলছেন, ‘আত্মনির্ভরতার জন্য যেমন প্রয়োজন শিক্ষার, তেমনই মানসিকতা বা চিন্তাভাবনা তৈরির জন্য প্রয়োজন শিল্পচর্চা। মোদি সরকার যদি আত্মনির্ভর হওয়ার কথাই বলেন তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে তাঁকে মান্যতা দিতে হবে সমস্তরকম শিল্পচর্চায়। হতে পারে তা নৃত্য বা সঙ্গীত বা অভিনয় বা অন্য যে কোনও মাধ্যম। আত্মনির্ভরতার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সৃষ্টিশীল হওয়া। তাই আমার প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ একজন আদর্শ দেশনায়কের মতো তিনি যেন সমস্তরকম শিল্পচর্চায় উৎসাহ দেন।’





  • স্মরণজিৎ চক্রবর্তী


তাঁর লেখা ‘ঝরাপাতার মরসুম’ থেকে শুরু করে ‘ফিঙে’, ‘বৃত্ত’, ‘বুদ্বুদ’, ‘আলোর গন্ধ’, ‘ক্রিসক্রস’ পাঠক-পাঠিকাদের মন ছুঁয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় মোদি সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিতে সেই স্মরণজিৎ চক্রবর্তী এবিপি আনন্দকে বললেন, ‘বর্তমানে যে অতিমারী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে দেশের অর্থনীতির ভিত নিয়ে মানুষের মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সবাই আর্থিকভাবে ভীষণ অসহায় বোধ করছেন। তবে কেবল এই অতিমারী পরিস্থিতি নয়, দেশের মানুষকে সার্বিকভাবে আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়া খুব জরুরি। বেশ কিছু আর্থিক সুবিধা সরকার দেয় যেগুলির সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকার জন্য সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হন। সাধারণ মানুষের কাছে সমস্ত সরকারি প্রকল্পের তথ্য সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমানে সরকারের স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেওয়া উচিত। অন্যদিকে এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয় যা দেশের আর্থিক স্থিতাবস্থাকে নষ্ট করে।’





  • ঋতাভরী চক্রবর্তী


কেবল অভিনয় বা মডেলিং নয়, ঋতাভরী চক্রবর্তীর পরিচিতি রয়েছে সুবক্তা হিসাবেও। মোদি সরকারের দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বর্ষপূর্তিতে এবিপি আনন্দকে টেলিফোনে ঋতাভরী বললেন, ‘ভারতে ক্রমেই বেড়ে চলা ধর্ষণ, গার্হস্থ্য হিংসা নির্মূল করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজন হলে আরও কড়া সাজা ঘোষণা করতে হবে। বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এগুলি সামাজিক ব্যাধি। সরকারের কাছে আর্জি জানাব এই বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হোক।’ মোদি সরকারের প্রতি তাঁর বার্তা, ‘ভারত কোনও ধর্মরাষ্ট্র নয়। তাই কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ কোনও ধর্মের প্রচার করতে পারে না। বরং সরকারের উচিত ধর্ম নির্বিশেষে আইনকে রক্ষা করা।‘ পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে বিচলিত ঋতাভরীও। বললেন, ‘পরিযায়ী শ্রমিকদের ন্যূনতম প্রয়োজনগুলির ওপর নজর দিন। আমরা এতদিন জানতামই না এত মানুষ এত কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।’





  • অনির্বাণ ভট্টাচার্য:


থিয়েটারের মঞ্চ থেকে তাঁর উত্থান। পরে রুপোলি পর্দায় প্রবেশ, জনপ্রিয়তা অর্জন। অভিনয়ের মতো কথাবার্তাতেও বলিষ্ঠ, অকপট। তিনি অনির্বাণ ভট্টাচার্য। দ্বিতীয় মোদি সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিতে মোবাইল ফোনে এবিপি আনন্দকে বললেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করলে সবার আগে যা নজরে পড়ে, তাতে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বেড়েছে, কিন্তু তার প্রভাব সরকারের ওপর কমেছে। আমি জানতে চাই তা কেন হল? একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েও সরকার এত অবিচল থাকে কীভাবে? বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকরা দিনের পর দিন হাঁটছেন। করোনায় মৃতের সংখ্যা ও ঘরমুখো শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় সমান হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার পরেও সরকার কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন?’ পাশাপাশি দেশের মানুষের মানসিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অভিনেতা। অনির্বাণ বলছেন, ‘মানুষের মধ্যে এখন খুব সামান্য কারণেই জন্ম নিচ্ছে ঘৃণা, বিদ্বেষ। একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে। ধর্ম নিয়ে হানাহানি কঠিন হাতে প্রতিরোধ করতে হবে সরকারকেই। অবশ্য এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে গেলে কেবল সরকার নয়, দেশের মানুষকেও সচেতন হতে হবে।’





  • রুদ্রনীল ঘোষ


কেন্দ্রীয় চরিত্র হোক বা পার্শ্বচরিত্র, টলিপাড়ায় অন্যধারার অভিনেতা হিসাবে জনপ্রিয় রুদ্রনীল ঘোষ। মোদি সরকারের দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বছরের শেষে এবিপি আনন্দের মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানালেন। পাশাপাশি বললেন, ‘আমি বর্তমান পরিস্থিতি দিয়ে এই সরকারকে বিচার করব না। মোদি খুবই স্পষ্ট সমর্থন পান একটা বড় অংশের জনগণের থেকে। সেই সমর্থনকে মনে রেখে তিনি যেন দেশবাসীর বিভিন্ন স্বার্থে পদক্ষেপ করেন। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার আগে তিনি প্রতিশ্রুতির যে লম্বা তালিকা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল কর্মসংস্থান। সেই বিষয়ে সরকার আরও বেশি করে নজর দিক। কেবল এই করোনা পরিস্থিতি নয়, দেশের মানুষের আর্থিক স্বনির্ভরতা ভীষণ জরুরি। তাই দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা সরকারের অবশ্য কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। প্রধানমন্ত্রীকে বলব, ভারতের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও বাস্তব ছবি বিচার করে প্রতিশ্রুতি দিন। দেশবাসীকে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখাবেন না।’