পুরুষোত্তম পণ্ডিত, কলকাতা: এল ডোরাডো কি সত্যিই কোথাও আছে? নাকি সেই সোনার শহর শুধুই কাল্পনিক? ষোড়শ শতকে কলম্বিয়া, ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা সহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রত্যন্ত অঞ্চল, আমাজনের গভীর অরণ্যে বহু অভিযান হয়েছে। বহু প্রাণ গিয়েছে। কিন্তু সোনার ধূলোয় ঢাকা শহর এল ডোরাডোর হদিশ মেলেনি। কিন্তু তাতে কী? কল্পনার উড়ান তো থামতে পারে না। কল্পনায় সেই এল ডোরাডোকেই দক্ষিণ ভারতের কোলার গোল্ড ফিল্ড-এ খুঁজে পেলেন পরিচালক প্রশান্ত নীল। কেজিএফ-এর পর কাহিনি এগোল নতুন পথে। আর সেই পথে চলতে চলতেই বক্স অফিসে ইতিহাস তৈরি করল ‘কেজিএফ-চ্যাপ্টার টু’ (KGF Chapter 2)। অধিরার সঙ্গে রকি ভাইয়ের ধুন্ধুমার অ্যাকশন শোরগোল ফেলে দিল আসমুদ্র-হিমাচলে। 


কেজিএফ-এর কাহিনি যিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন, সেই আনন্দ ইঙ্গালগির স্ট্রোক হওয়ার দরুন তিনি শয্যাশায়ী। কিন্তু কাহিনিকে তো এগিয়ে নিয়ে যেতেই হবে। সেই দায়িত্ব নিতে হল আনন্দের ছেলে বিজয়েন্দ্রকে। আনন্দের লাইব্রেরি তোলপাড় করে ফেলে খুঁজে বের করা হল 'কেজিএফ-চ্যাপ্টার টু'র পাণ্ডুলিপি। শুরু হল নতুন পর্ব।


কেজিএফ চ্যাপ্টার টু-র প্রেক্ষাপট-


কেজিএফের ফ্ল্যাশব্যাক থেকেই কেজিএফ-টুয়ের কাহিনি শুরু হয়েছে। ছোটবেলায় মাকে কথা দিয়েছিল রকি। একদিন পৃথিবীর সব সোনা সে মাকে এনে দেবে। সেই প্রতিজ্ঞা রাখতেই রকি কেজিএফের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে আসে। তবে তার এই সফর মসৃণ ছিল না। এক এক করে নিজের প্রতিপক্ষকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিয়েছে সে। বিরাটকে মেরে ফেলার পর কেজিএফের অধিকার সে নিজের মুঠোয় এনেছে। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে সারা ভারতের অপরাধ জগতের অধিপতি হয়ে উঠেছে। গুরু পান্ডিয়া, অ্যান্ড্রুজ, কামাল, রাজেন্দ্র দেশাইকে সে বাধ্য করে নিজের অধীনে কাজ করার জন্য। পরিস্থিতি রকির পক্ষে থাকলেও, আকাশের এক কোণে মেঘ ঘনাচ্ছিল। রকির বিরুদ্ধে মুখ খুলে মরতে হয় কামালকে। রীনাকে রকি কেজিএফে নিজের প্রাসাদে এনে রাখে। তলে তলে রকির হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। সিবিআই আধিকারিক রাঘবন যে কোনও মূল্যে রকির সাম্রাজ্য ধ্বংস করার পরিকল্পনা করতে থাকে। সরকারি ক্ষমতার অলিন্দে নানা ঘুঁটি সাজানোর খেলাও চলতে থাকে। এরই মাঝে অধিরার প্রত্যাবর্তন। কেজিএফের শ্রমিকেরা জানত অধিরার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সেই খবর সত্যি ছিল না। অধিরা ফিরে এল নিজের বিশাল বাহিনী নিয়ে। রকিকে নিজের বন্দুকের নিশানায় এনে ঘায়েল করল। কিন্তু মারল না। সন্ত্রাসের ছায়ায় সবাইকে ত্রস্ত করে রাখতেই রকিকে ছেড়ে দিল অধিরা। ছেড়ে দিল, যাতে গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত রকিকে দেখে মনোবল ভেঙে যায় তাঁর অনুগামীদের। অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে রকির অনুগামীদের খুন করে সোনার চোরাচালান সহ অপরাধমূলক ব্যবসার রাশ নিজের হাতে নিয়ে নেয় শেট্টি। সবাই ভাবে...রকির দিন শেষ। কিন্তু রকি তো সাধারণ গ্যাংস্টার নয়। সে তো মনস্টার। সাধারণ বুদ্ধিতে রকিকে মাপা একেবারেই বোকামি। হাতেনাতে সেই প্রমাণ মেলে। ছুটি কাটাতে যাচ্ছে বলে রকি নিজের হেলিকপ্টারে চলে যায় দুবাই। অপরাধ জগতের বাদশা ইনায়াত খলিলের মুখোমুখি হয় সে। মুহূর্তে পাশা পাল্টে ফেলে রকি। খলিলকে বাধ্য করে তাঁর সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি করার জন্য। তারপর দেশে ফেরে রকি। অধিরার সঙ্গে আবার মুখোমুখি হয় সে। এবার একে ফর্টিসেভেনের গুলিবৃষ্টিতে মুছে যায় অধিরার বাহিনি। বিস্ফোরণে অধিরাও গুরুতর জখম হয়। কিন্তু রকি ছেড়ে দেয় অধিরাকে। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর রমিকা সেন রকির সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন। রমিকার মুখোমুখি হয়ে রকিও নিজের বুদ্ধিতে তাঁর ক্ষমতা বুঝিয়ে দেয়। পাশাপাশি রকি এটাও বলে যে কোনও নারী যখন ক্রোধান্বিতা হন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে লড়তে নেই। কপালে তিলক কেটে হাত জোড় করে তখন তাঁর পুজো করাই শ্রেয়। এভাবেই কাহিনি এগোয়। অধিরার সঙ্গে লড়াইয়ে জীবনের চরম মূল্য চোকাতে হয় রকিকে। যে কেজিএফের আকাশপথ দিয়ে বিমান চলাচলের অনুমতি দেয় না রকি, সেই কেজিএফের অস্তিত্বই ধূলিস্মাৎ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন রমিকা সেন। ২ ঘন্টা ৪৮ মিনিটের ছবি ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছোয়। আর তারপর সুপার-ক্লাইম্যাক্সে পরিচালক জানিয়ে দেন কাহিনি এখানেই শেষ নয়, বইপত্র-ফাইলের স্তুপের মাঝেই খোঁজ মেলে ‘কেজিএফ-চ্যাপ্টার থ্রি’-র পাণ্ডুলিপির। যে কাহিনি ইঙ্গিত দেয়, ভারতে নয়, ভারতের বাইরেও নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছিল রকি।


কন্নড় ছবির ইতিহাসে 'কেজিএফ চ্যাপ্টার টু' সবচেয়ে বড় বাজেটের ছবি-


'লার্জার দ্যান লাইফ' একটা ছবি। কন্নড় ছবির ইতিহাসে 'কেজিএফ চ্যাপ্টার টু' সবচেয়ে বড় বাজেটের ছবি। ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে কেজিএফ চ্যাপ্টার টু বানাতে। আর মুক্তির পর মাত্র চারদিনে পৃথিবী জুড়ে ৫৫১ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকার ব্যবসা করেছে ছবিটি। অভিনয়ে, সংলাপে, অ্যাকশনে, সিনেম্যাটোগ্রাফিতে মুগ্ধ করে রাখে কেজিএফ-চ্যাপ্টার টু। রকির চরিত্রে যশের কোনও তুলনা নেই। খলনায়ক অধিরাকে যে ভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন সঞ্জয় দত্ত, তা এক কথায় অনবদ্য। রমিকা সেনের চরিত্রে রবীনা ট্যান্ডন আলাদা করে নজর কেড়েছেন। সিবিআই অফিসার রাঘবনের চরিত্রে দুরন্ত অভিনয় করেছেন রাও রমেশ। তবে বলতেই হয়, এই ছবি রকি ভাইয়ের ছবি। রকির চরিত্রের উচ্চতা, ব্যপ্তি এতটাই যে অন্যান্য চরিত্রগুলি তার চরিত্রের ছায়ায় কিছুটা হলেও ঢাকা পড়ে যায়। পরিচালক প্রশান্ত নীল অত্যন্ত যত্ন নিয়ে ছবিটির কাহিনি লিখেছেন। আর বলতেই হয়, সেট ডিজাইন থেকে ছবির কালারটোন, সবেতেই একটা নিজস্বতার ছাপ রেখেছে এই ছবি। রবি বাসরুর সঙ্গীত পরিচালনায় এই ছবির গান, থিম সং এবং আবহসঙ্গীত দুর্দান্ত। ভুবন গোডার সিনেম্যাটোগ্রাফিও অসাধারণ। কেজিএফ চ্যাপ্টার ওয়ানেও তিনিই সিনেম্যাটোগ্রাফির দায়িত্ব সামলেছিলেন। প্রভাসের আগামী ছবি সালার-এও তিনিই সিনোম্যাটোগ্রাফির দায়িত্বে। যশের মুখে অসাধারণ সব সংলাপ বসিয়েছেন এম চন্দ্রমৌলি।


আরও পড়ুন - London Files Review: টান-টান উত্তেজনা, অর্জুন রামপালের অভিনয়ই বড় প্রাপ্তি 'লন্ডন ফাইলস' সিরিজের


'কেজিএফ-চ্যপ্টার টু'-র প্রেক্ষাপটটাই সুবিশাল। এমন বড়মাপের একটি ছবি হওয়ার কারণেই চিত্রনাট্য কোথাও দীর্ঘায়িত করা হয়েছে বলে মনে হয় না। অ্যাকশন কোরিওগ্রাফিও নিখুঁত। রকির চরিত্র নির্মাণে যে সূক্ষ্ণ বিষয়গুলিতে নজর রাখা হয়েছে, তার জেরেই আমজনতার বিপুল ভালবাসা কুড়িয়েছে ছবিটি। রকি অপরাধ জগতের মানুষ হয়েও মহিলাদের প্রতি সে শ্রদ্ধাশীল। মায়ের প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা। নিজের মদ্যপ বাবাকে তার অজান্তেই মায়ের সমাধির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে সে বুকের ভার হাল্কা করার চেষ্টা করে। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে রমিকা সেনের কোনও ক্ষতি করে না। বরং নিজের মৃত্যুবাণ নিজেই যেন তুলে দেয় তাঁর হাতে। চরিত্রের এই গুণগুলোই অন্ধকার জগতের রকিকে মনুষ্যত্বের আলোয় আলোকিত করে রাখে। 'কেজিএফ চ্যাপ্টার টু' শেষ হওয়ার পর হল থেকে একথাই ভাবতে ভাবতে বেরোতে হয় যে চ্যাপ্টার থ্রি’র জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?