পুরুষোত্তম পণ্ডিত, কলকাতা: ডায়েরির পাতায় লেগে রক্তের দাগ। ডায়েরির পাতায় কোথাও চোখের জলে লেখা মুছে গিয়েছে। তবুও ডায়েরিটা আছে, সযত্নে। পাতা ওল্টালে থাকলেই লেখাগুলো কী জীবন্ত হয়ে ওঠে এখনও! কানে তালা লেগে যায় একটানা গুলির শব্দে। তারই মাঝে কতজনের শেষ আর্তনাদ মিলে মিশে যায়। গুলি, পাল্টা গুলির লড়াইয়ের মাঝেই নিঃশব্দে আরও একটা লড়াই চলতে থাকে। জীবন বাঁচানোর লড়াই। মানবতাকে টিঁকিয়ে রাখার লড়াই।


আমাজন প্রাইম ভিডিওর ওয়েব সিরিজ ‘টোয়েন্টি সিক্স বাই ইলেভন - মুম্বই ডায়েরিজ’ এই লড়াইয়ের গল্পই শোনায়। নিখিল আডবাণী এবং নিখিল গনজালভেস পরিচালিত এই ওয়েব সিরিজটি ছাব্বিশ এগারোর মুম্বই হামলার সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর দলিল হয়ে উঠেছে। কল্পনার কিছু রঙ হয়তো মিশেছে কাহিনিতে, কিন্তু তা কোথাও অতিরঞ্জিত নয়। মোট আটটি এপিসোড রয়েছে সিরিজটিতে। প্রতিটি এপিসোডেই চিত্রনাট্যে টানটান উত্তেজনা ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন পরিচালক জুটি। আর বলতেই হয় সেই চেষ্টায় তাঁরা অনেকাংশেই সফল।


সন্ত্রাস কখনো জীবনের গতি রুখে দিতে পারে না। সন্ত্রাস কোথাও জয়ী হতে পারে না। সন্ত্রাসবাদীদের হামলার মুখে মুম্বইকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন যে অকুতোভয় পুলিশ আধিকারিকরা, তাঁদের পেশাদারিত্বকে কুর্নিশ জানায় মুম্বই ডায়েরিজ। আর কুর্নিশ জানায় সেই সব চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীদের যাঁরা নিজেদের সাধ্যকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন আর্ত-আহতদের চিকিৎসায়, জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে। 


আরব সাগরের নোনা জল ভেঙে মুম্বইয়ে ঢুকছে জঙ্গিরা। একে একে তারা ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণচঞ্চল শহরটার ক্যাফেতে, হোটেলে, স্টেশনে। এখান থেকেই কাহিনির শুরু। তারপর মুম্বইয়ের এক ব্যস্ত হাসপাতালের প্রেক্ষাপটে কাহিনি এগোতে থাকে। নানা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবের সঙ্গে লড়তে লড়তেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন সেই হাসপাতালের চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীরা। কৌশিক ওবেরয় এই হাসপাতালেরই নামকরা এক চিকিৎসক। মানুষের জীবন বাঁচানোটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালের নিয়মকানুনের ধার ধারেন না তিনি। জেনারেল ওয়ার্ডের মাঝেই হঠাৎ করে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। রুগীর জীবন বাঁচানোর তাগিদে তিনি যে কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি। কৌশিক ওবেরয়ের চরিত্রে মোহিত রায়নার অভিনয় অনবদ্য। সংযত, ধারালো অভিনয়ে সিরিজটির প্রতিটি এপিসোডে মোহিতের অভিনয় মুগ্ধ করে রাখে।


হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক-সমাজকর্মী চিত্রা দাসের ভূমিকায় কঙ্কনা সেনশর্মা তাঁর সপ্রিতভ অভিনয়ে নজর কেড়েছেন বরাবরের মত। চিত্রা দাস এমন একটি চরিত্র, যিনি হাসপাতালের নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে নিজের কর্তব্যে অবিচল থাকেন। বৈবাহিক জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে ভুলে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যেতে চান। সন্ত্রাসবাদীরা তাঁকে বোমা লাগানো জ্যাকেট পরিয়ে দিয়ে ঢাল বানিয়ে যখন বেরিয়ে যেতে চায় তখনও নিজের জীবন নিয়ে তিনি বিচলিত হন না। হাসপাতালে যোগ দিতে আসা তিন জুনিয়র চিকিৎসকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাতাশা ভরদ্বাজ, ম্রুন্ময়ী দেশপান্ডে এবং সত্যজিৎ দুবে। তাঁদের অভিনয়ও প্রশংসনীয়। টেলিভিশন সাংবাদিকের ভূমিকায় নজর কেড়েছেন শ্রিয়া ধন্বন্তরীও। কৌশিক ওবেরয়ের স্ত্রী, প্যালেস হোটেলের কর্মী অনন্যা ঘোষের ভূমিকায় টিনা দেশাইও ভাল অভিনয় করেছেন।


যে ভাবে কাহিনির পরতে পরতে উত্তেজনার রসদ ছড়িয়ে সিরিজটিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন নিখিল আদবাণী এবং নিখিল গনজালভেস তা সত্যিই তারিফ যোগ্য। সিরিজটি দেখতে দেখতে একটা প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু সর্বাত্মক সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর মেলে না। মানুষ কেন রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে? মানুষ কেন অস্ত্র হাতে তোলে নিরাপরাধ মানুষদের লক্ষ্য করে? কেন রক্তে মেশে হিংসার বিষ? উত্তর না মিললেও এই দগদগে ক্ষতয় প্রলেপ দেন কৌশিক ওবেরয়ের মত চিকিৎসকেরা। কানে বাজতে থাকে সেই সংলাপ। মানুষের চরিত্র বিচার করা চিকিৎসকের কাজ নয়। তাঁর কাজ শুধুই মানুষটিকে বাঁচানো। তাই যে সন্ত্রাসবাদীর বন্দুকের গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় প্রিয়জনের বুক, সেই সন্ত্রাসবাদী আহত হলে তাঁর জীবন বাঁচানোর দায়িত্বও চিকিৎসকেরই। 


বন্দুক, গুলি, রক্ত, চিৎকার সবকিছু ছাপিয়ে টোয়েন্টি সিক্স বাই ইলেভন মুম্বই ডায়েরিজ-এ এই মানবিক মুখই প্রকট হয়ে ওঠে। সচেতন ভাবে সিরিজের প্রতিটি পর্বের নামকরণ করেছেন পরিচালক জুটি। ডায়াগনসিস থেকে শুরু হয়ে কমপ্লিকেশনস, ম্যালিগন্যান্ট, অ্যানাটমি নানা ধাপ পেরিয়ে কাহিনি শেষ হয় রিকভারিতে এসে। ডায়েরির শেষ পাতা মনে করিয়ে দিয়ে যায় সেই মুখগুলোকে, যাঁরা নিজেদের প্রাণ দিয়েছিলেন একটা শহরের আত্মবিশ্বাস অটুট রাখতে, জীবনের স্পন্দন সচল রাখতে। সিরিজটিতে একটা দৃশ্যই মুম্বই স্পিরিটের সংজ্ঞা হয়ে রয়ে যায়, যখন সার্ভিস রিভলবার নিয়ে একে ফর্টি সেভনের গুলিবৃষ্টির মুখে দাঁড়িয়েও পুলিশ অফিসার বলে ওঠেন ‘ইয়ে মেরা শহর হ্যায়।’ এটা আমার শহর।