কলকাতা: অভিনয় জগতের কিংবদন্তি তিনি। সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে রুপোলি পর্দায় প্রবেশ ‘অপু’ হিসাবে। তারপর দশকের পর দশক কেটে গিয়েছে। কখনও উদয়ন পণ্ডিত, কখনও ফেলুদা তো কখনও ক্ষিদ্দা, পর্দায় বিভিন্ন চরিত্রের গল্প বলেছেন তিনি। তিনি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এবার ছবিতে তাঁর চরিত্রের নাম? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। কারণ, বাংলায় এই প্রথম কোনও অভিনেতার জীবন নিয়ে তৈরি হচ্ছে বায়োপিক। যে সিনেমার নাম রাখা হয়েছে ‘অভিযান’। আর সৌমিত্রের জীবনবৃত্তান্ত শোনানোর দায়িত্ব নিয়েছেন পরিচালক-অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। শ্যুটিং ফ্লোরে স্বয়ং সৌমিত্রের সঙ্গে আড্ডা থেকে শুরু করে নিজের প্রথম পিরিওডিকাল ছবি, নেপথ্য ভাবনা - মোবাইল ফোনে এবিপি আনন্দ-র কাছে অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করে দিলেন বায়োপিকের পরিচালক।
প্রশ্ন: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বায়েপিক ‘স্বপ্নের প্রোজেক্ট’! সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে, কেমন লাগছে?
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: এটা একটা কাজ। আর এই কাজটা আমার একার নয়। আরও ২-৩ জন মিলে ছবিটার পরিকল্পনা করেছিলেন। আমায় সিনেমাটি পরিচালনার প্রস্তাব দেওয়ার পর মনে হয়েছিল, এটা খুব জরুরি বা প্রয়োজনীয় একটা কাজ হতে পারে। আমার করতেও ভাল লাগবে। তবে আমি ছোটবেলা থেকে যে এই কাজটা নিয়ে স্বপ্ন দেখে আসছি, বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। এই ছবির কথা আমার মাথায় আসেনি। প্রযোজক আর সৌমিত্রবাবুর বন্ধু ডঃ শুভেন্দু সেন প্রথম এই পরিকল্পনা করেছিলেন। ওরাই নিজেরা আলোচনার পর আমায় বলেন। সবটা শুনে আমার মনে ধরেছিল। তারপর কাজটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি। তারপর প্রোজেক্টটা এখন আমারই হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি এর আগে একাধিক ছবি পরিচালনা করেছেন। ‘অভিযান’ পরিচালনা করার অনুভূতি কতটা আলাদা?
পরমব্রত: এই ছবির একটা বিশেষত্ব রয়েছে। যেটা আমি আগে কখনও করিনি, সেটা হল, পুরনো সময় নিয়ে কাজ করা। এই ছবিটা অনেকটা পিরিওডিকাল। এমন একটা সময়ের কথা বলা হবে, যখন আমি ছিলাম না। সেই সময়টাকেই বারবার রিক্রিয়েট করতে হয়েছিল। আমরা তো আর হলিউড বা বলিউড নই। আমাদের অতটা সুবিধা নেই। আমরা গোটা পাড়া বা গোটা স্টুডিও কিনে নিলাম, সেখানে ৪৫ দিন ধরে সেট বানানো হল আর শ্যুটিং হল ৬ দিন, সেটা আমরা করতে পারি না। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে হয়। এইটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। টাইম স্কেলটাকে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে, আবার তাও সাধ্যের মধ্যে। একেবারে অন্যরমক অনুভূতি ছিল। আরও একটা বিষয়। আমি যাঁকে নিয়ে এই ছবি বানাচ্ছি, তিনি এখনও স্বমহিমায় জীবিত। তিনি নিজে তাঁর নিজের ভূমিকায় অভিনয়ও করছেন। এইটাও একটা বেশ আলাদা অনুভূতি। একজন মানুষকে যখন আমরা দেখি, তাকে নিয়ে কথা বলি, তখন তার ভালো দিকের সঙ্গে সঙ্গে ধূসর দিকগুলো নিয়েও কথা বলতে হয়। সেইগুলো নিয়ে ছবিতে সৌমিত্রবাবুর সঙ্গেই কথা বলা আছে, অনেকটা তথ্যচিত্রের ধাঁচে। এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে অনেক সময় একজন শিল্পী রাজি হন না। প্রথমত, তাঁরা মানতে চান না তাঁদের ধূসর দিকগুলির কথা। আর মানলেও তা একেবারে বাড়ির অন্দরমহলে সীমাবদ্ধ রাখতে চান। এই ব্যাপারে সৌমিত্রবাবু ব্যতিক্রমী। আমি শুরুতেই ওনাকে বলে নিয়েছিলাম, আপনার ধূসর দিকগুলিও ছবিতে থাকবে। সেগুলো নিয়ে আপনার সঙ্গেই আমরা কথা বলব। উনি রাজি হয়ে যান, বলেন ‘কোনও অসুবিধা নেই।’ আমার মনে হয় সেটাও একটা বেশ অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
প্রশ্ন: সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে প্রথম যেদিন এই ছবিটা নিয়ে কথা বলেছিলেন, ওনার কী প্রতিক্রিয়া ছিল?
পরমব্রত: উনি খুব খুশি হয়েছিলেন। আমায় যথেষ্ট স্নেহও করেন। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে আমার বয়সটা যথাযথ কি না, সেটা নিয়ে ওনার একটু সন্দেহ ছিল। তারপর আমি দেখা করে ওনাকে যখন নিজের দৃষ্টিভঙ্গিটা বুঝিয়ে বলি, তখন বলেছিলেন, ‘আমার আর কোনও সন্দেহ নেই। আমি বুঝতে পেরেছি তুই কোথা থেকে ধরতে চাইছিস। আমার ভালো লাগছে কেউ ব্যাপারটা এইভাবে ভাবছে। এটা কেবল আমার জীবনগাথা নয়, আবার এর সম্পূর্ণ একটা অন্যদিকও রয়েছে।’ সেটা ছবিটা দেখলে বোঝা যাবে।
প্রশ্ন: সৌমিত্রবাবুর অংশের শ্যুটিং শেষ হয়েছে। আপনি এর আগেও ওনার সঙ্গে একাধিক কাজ করেছেন। কিন্তু পরিচালক হিসাবে অভিনেতা সৌমিত্রবাবুকে কেমনভাবে পেলেন?
পরমব্রত: সেটা এর আগে একবার পেয়েছি। সোনার পাহাড় ছবিতে অতিথি শিল্পী হিসাবে কাজ করেছেন উনি। সুতরাং এই সৌভাগ্য আমার আগেও হয়েছে। তবু বলব, এই অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা খুব মুশকিল। আজ প্রায় ৬০ বছর হল সৌমিত্রবাবু অভিনয় করছেন। অভিনয়টা ওনার দ্বিতীয় চামড়ার মতো হয়ে গিয়েছে। ওনার অভিনয়ের ধরনটাও ভীষণ ব্যবহারিক। অনেককে দেখেছি তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে যেমন, অভিনয় করার সময় একটা বড় পরিবর্তন হয়। সৌমিত্রবাবুর ঠিক সেটা নয়। উনি নিজের আর একটা এক্সটেনশন নিয়ে অভিনয় করেন, তাতেই বিশ্বাস করেন। ওনার অভিনয় ধরনের বিশেষত্বটাই হল শ্যুটিং চলাকালীন কখনও মনে হয় না বিশাল কিছু একটা তৈরি হচ্ছে। সমস্ত শ্যুটিং শেষ হবার পর যখন পুরো ছবিটা এডিট টেবিলে বসে গাঁথা হয়, তখন এর মাহাত্ম্য বা গুরুত্বটা বোঝা যায়। আমি সেটার অপেক্ষাতেই আছি। তবে এখনও আর কয়েকদিনের শ্যুটিং বাকি। সেটা করার পর এডিটে বসে আমি বুঝতে পারব।
প্রশ্ন: আপনি ঠিক কীভাবে রিসার্চ করেছিলেন সৌমিত্রবাবুর জীবন নিয়ে?
পরমব্রত: আমার কাছে মূল আধার ছিল ওনার লেখা গদ্যসংগ্রহ আর ওনার সঙ্গে গল্প করে কাটানো অনেকটা সময়। আমি সপ্তাহে ২ দিন বা অন্তত একদিন করে গল্প করতে যেতাম। সেখান থেকে ওনাকে বোঝার চেষ্টা করতাম। আর ডঃ শুভেন্দু সেন সৌমিত্রবাবুর গদ্যগুলিকে ইংরাজিতে অনুবাদ করার কথা ভাবছেন। সেই কারণে উনিও অনেকটা সময় কাটিয়েছেন সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে। ওনার বেশ কিছু নোটস রয়েছে। শুরুর দিকটা সেইগুলো আমায় সাহায্য করেছিল।
প্রশ্ন: রুপোলি পর্দায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন কিংবদন্তি। কিন্তু পর্দায় বাইরে তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেমন নাট্যজীবন ছবিতে কতটা উঠে আসবে?
পরমব্রত: আপাতত এইটুকুই বলতে পারি, অনেকটাই আসবে।
প্রশ্ন: সত্তরের দশকে উনি ‘এক্ষণ’ বলে একটি বামপন্থী ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই দিকে কতটা আলোকপাত করবে এই ছবি?
পরমব্রত: বামপন্থী নয়, ওটা একেবারেই একটা সাংস্কৃতিক ম্যাগাজিন ছিল। তবে সৌমিত্রবাবু ও তাঁর বন্ধুরা চিরকালই বাম ঘেঁষা ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবে লেখায় সেই আভাস থাকবে। তবে এক্ষণ-কে রাজনৈতিক ম্যাগাজিন একেবারেই বলা যায় না। আর.. আমি এক্ষণ সম্পর্কে জানি দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন... (হাসি)
প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায়, তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ এইসব বিখ্যাত পরিচালকদের কথা ছবিতে কতটা থাকছে?
পরমব্রত: সত্যজিৎ রায়কে বাদ দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হওয়াটা একটু মুশকিল। বলাই বাহুল্য উনি থাকবেন। ওনাকে তাই আলোচনা থেকে বাদ রাখছি। পরিচালক কিউ মানে কৌশিক মুখোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। কিন্তু ৬০ বছরের অভিনয় জীবনে উনি প্রায় সকলের সঙ্গেই কাজ করেছেন। অনেকের মতে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ। আমায় তার মধ্যে থেকেই বেছে নিতে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে যাঁদের প্রভাব ওনার জীবনে বেশি তাদেরকেই বেছে নিয়েছি। ছবিটা মোট ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের, তার মধ্যে কটাই বা লোককে রাখতে পারি!
প্রশ্ন: ছবির নাম ‘অভিযান’ কেন রাখলেন?
পরমব্রত: দুটি কারণ। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অভিযান’ ছবিটি আমার মনে হয় সৌমিত্রবাবুর জীবনে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু একটু আন্ডাররেটেড ছবি। সবাই অন্য অনেক ছবি নিয়ে কথা বলে, কিন্তু এই ছবি নিয়ে কম কথা হয়। আমার মনে হয় এটা ওনার কেরিয়ারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ছবি। সেটা উনি নিজেও বিশ্বাস করেন। সেই ছবিটার সূত্র ধরে সৌমিত্রবাবুর জীবনের অভিযানকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সেই অভিযানে কাজ আছে, অ্যাডভেঞ্চার আছে, ব্যক্তিগত জীবন আছে, আর সেটা এখনও প্রবহমান, এটা তো একটা উত্তেজনাময় যাত্রা। সেই কারণেই ছবির নাম অভিযান।
প্রশ্ন: এর আগে বাংলার কোনও নায়কের জীবন নিয়ে বড় পর্দায় কাজ হয়নি। উত্তমকুমারকে নিয়ে ছোট পর্দায় কাজ হয়েছে। সেই জায়গা থেকে এই কাজটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
পরমব্রত: চ্যালেঞ্জটা তখনই বুঝতে পারব যখন ছবিটা মুক্তি পাবে, সমালোচিত হবে, নানা মুনি নানা মত দেবে। বা আপনারা যখন বলবেন, এটা আপনি প্রথম করলেন, এটা হয়নি, ওটা হয়নি। আচ্ছা আপনি অমুকের অনুমতি নিয়েছিলেন? তখন বুঝব চ্যালেঞ্জ কতটা! (হাসি) কাজটা লেখা বা করার সময় আমি কখনওই আগে থেকে চ্যালেঞ্জ মাপি না। সেটা করতে গেলে কাজটাই করা যায় না। কাজটা করে নিই। তারপর দেখা যাবে।
প্রশ্ন: করোনা পরিস্থিতির জন্য শ্যুটিংয়ের গতিবেগ কি ধাক্কা খেল?
পরমব্রত: হ্যাঁ, অসুবিধা তো হলই। আমাদের মে মাসের মধ্যে পুরো শ্যুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেটা করা গেল না। শ্যুট চলাকালীন লকডাউন হল মার্চ মাসে। পরিকল্পনা ছিল মার্চ মাসের পর একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার ১০ দিন মতো শ্যুটিং করব। সেটা করা গেল না। লকডাউনে শ্যুটিং থামিয়ে দিতে হল। এই সবে মার্চ মাসের শ্যুটিংয়ের কাজটা শেষ হয়েছে। মে মাসের শ্যুটিংটা অগাস্টে হবে।
প্রশ্ন: ‘অভিযান’-এর সৌজন্যে সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে কাটানো সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কী?
পরমব্রত: উনি খুব অল্প সময় শ্যুট করতে পারেন। তাই শ্যুটিং ফ্লোরে মজা করার অবকাশ পাওয়া যায় না। ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যে অতটা কাজ শেষ করতে সবাইকে এমন তটস্থ থাকতে হয় যে, মজার সুযোগ থাকে না। তবে উনি সুযোগ পেলেই গল্প করতে ভালোবাসেন। গল্পের সঙ্গী পেলে ওনার মেজাজও ভালো থাকে। এত বছরের এত অভিজ্ঞতা ওনার রয়েছে তা অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েও যেন ফুরোয় না। উনি চান আরও কথা বলতে, শুনতেও। খুব মনোগ্রাহী আলোচনার থেকে বেশি আনন্দ ওনাকে আর কিছুই দেয় না। উনি সারাক্ষণ খুঁজে বেড়ান কোথায় একটু আকর্ষণীয় আলোচনা, ভাবাবেগ, শিল্প, সাহিত্য নিয়ে আড্ডা হচ্ছে। সেইটার সুযোগ যদিও খুব কম হয়েছে। তবে কোনও কোনও সময় সেটে গল্প করতে গিয়ে আমি আর সৌমিত্রবাবু ভুলে যেতাম যে তাড়া আছে। তখন আমার সহকারীরা এসে মনে করিয়ে দিত, ‘পরমদা এবার কিন্তু আমাদের প্রচণ্ড দেরি হচ্ছে। একটু পর তুমিই রাগ করবে। চলো কাজ করি। তোমরা কিন্তু গল্প করতে আরম্ভ করেছো’ (হাসি)। এমন বেশ কয়েকবার হয়েছে। ওনার সঙ্গে গল্প করাটা এমনিতেই একটা ভালো অভিজ্ঞতা।
প্রশ্ন: দর্শকরা কবে নাগাদ রুপোলি পর্দায় ‘অভিযান’-এ যাবেন?
পরমব্রত: ঠিক জানি না। আশা করি ২০২১ এর শুরুর দিকে।আমরা অবশ্য এপ্রিল মাস থেকেই ভাবছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সেটা এখনও পর্যন্ত হল না। দেখা যাক কী হয়