তাঁর নাম সাহেবি কায়দায়। চেহারাতেও রয়েছে কিছুটা বিদেশি ছাপ। সাহেবদের পছন্দের তালিকাতেও বরাবরই প্রথমের দিকে থেকেছেন তিনি। রুপোলি পর্দায় একাধিক নজরকাড়া চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। ফের বড়পর্দায় ফিরছেন তিনি। ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। পুজোর সপ্তাহেই মুক্তি পেতে চলেছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায় পরিচালিত নতুন থ্রিলার ধর্মী ছবি 'রক্তবীজ'। সেখানেই অন্যতম মুখ্য চরিত্রে দেখা যাবে বর্ষীয়ান অভিনেতাকে। সব মহলেই কানাঘুষো শোনা যায় ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়কে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম তাঁর সহকারীকে যোগাযোগ করা। অভিনেতা নিজে মোটেই ফোন ধরেন না। এমনকি পাহাড় ছেড়ে (বর্তমানে বাস মুসৌরি) শ্যুটিং করতেও যেতে চান না পাহাড়প্রেমী ভিক্টর। তবে 'রক্তবীজ'- এর স্ক্রিপ্ট পছন্দ হওয়ায় কলকাতা এসে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে শ্যুটিং করেছেন তিনি। অনুরাগীরাও অনেকদিন পর অভিনেতাকে সিলভার স্ক্রিনে দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে রয়েছেন। মৃণাল সেনের 'মহাপৃথিবী'- র পর ফের একবার পর্দায় একসঙ্গে দেখা যাবে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অনসূয়া মজুমদারকে।
জমিদার পরিবারের বংশধরের টান বরাবরই থিয়েটারে
মালদার চাঁচোলের রাজা বাহাদুর এবং হুগলির উত্তরপাড়ার রাজার বংশধর অভিনেতা ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। স্কুলের পাঠ শেষ করেছিলেন শিলংয়ে। তারপর কলকাতা এবং পরবর্তীতে পাড়ি দেন বিদেশে। কলকাতায় থাকাকালীনই ব্রিটিশ কাউন্সিলের নাটকে অভিনয় করেছিলেন ভিক্টর। বম্বের মাটিতেও থিয়েটারে নজর কেড়েছিলেন তিনি। বম্বে থিয়েটারের প্রথম মিউজিক্যাল প্রোডাকশনে যিশুর চরিত্রে দেখা গিয়েছিল অভিনেতাকে। সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রেও দেখা গিয়েছে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সত্তরের দশকের শেষের দিকে ক্যালাকাটা আর্ট গ্যালারির নির্মাতাও ছিলেন তিনিই। এশিয়ার প্রথম বাসিন্দা হিসেবে ব্রিটিশ থিয়েটারে অভিনয় করার খেতাবও রয়েছে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়েরই সাফল্যের ঝুলিতে।
খেলাধুলো থেকে সেবামূলক কাজ- আজও একইভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন অভিনেতা
১৯৬০- এর দশলে সিনিয়র ডিভিশনে বাংলার হয়ে হকি এবং ফুটবল (বেঙ্গল লীগ) খেলেছিলেন ভিক্টর। বয়স ৭০ পেরিয়েছে অনেকদিন আগেই। এখনও যথেষ্ট ফিট তিনি। শোনা যায় শ্যুটিং চলাকালীন নাকি কিছুই মুখে তোলেন না তিনি। বাড়ি থেকে খেয়ে আসেন। ফের বাড়ি ফিরে খাবার খান। মাঝে শ্যুটিংয়ে যতক্ষণ সময়ই লাগুক না কেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেউ কিছুই খাওয়াতে পারেন না। অথচ অসম্ভব ভোজনরসিক তিনি। রান্নাবান্না নিয়ে আলোচনা হলে সবার আগে বসে পড়েন কার সাথে কোন জিনিসের কম্বিনেশন সেরা হবে তা নিয়ে আলোচনায়। তাঁর বাড়িতে কেউ গেলেও থাকে ঢালাও আপ্যায়নের বন্দোবস্ত। জমিদারি প্রথার কিছু জিনিস যে রক্তে রয়েছে তা বোঝাই যায়।
১৯৯১ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল উত্তরকাশীতে। সেই সময় সক্রিয় ভাবে ত্রাণ পৌঁছনোর কাজে যোগ দিয়েছিলেন অভিনেতা। শোনা যায়, ভিক্টর একাই প্রচুর ত্রাণোসামগ্রী নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন দুর্গতদের গ্রামে। সরকারি সাহায্য পৌঁছনোর আগেই দুর্গতদের হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন খাবার, ওষুধ। ১৯৯৯ সালে সাইক্লোন বিধ্বস্ত ওড়িশাতেও সক্রিয় ভাবে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর জীবনসঙ্গীও। অসমে মোরান ব্লাইন্ড স্কুল তৈরি করেছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা। সেই স্কুলের তত্ত্বাবধানের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছেন অভিনেতা। বর্তমানে এটি একটি পুরোদস্তুর আবাসিক বিদ্যালয়। এখানকার পড়ুয়ারা নর্থ-ইস্ট ব্লাইন্ড ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপেও অংশগ্রহণ করেছে। একাধিক সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর তিনি। এই তালিকায় রয়েছে অসমের শ্রীমন্ত শঙ্করদেব সোসাইটি, উত্তরাখণ্ডের বার্ড ওয়াচার সোসাইটি, নর্থ-ইস্ট হিল ট্র্যাক্টের দিমাসা উপজাতির জন্য গুডউইল অ্যাম্বাসেডরও তিনিই।
ভিক্টরের বাংলা ছবির কালজয়ী গান
অভিনয় দক্ষতায় বরাবরই নজর কেড়েছেন ভিক্টর। অনেক ছবিতে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন অপর্ণা সেনের সঙ্গে। তার মধ্যে অন্যতম 'একান্ত আপন'। এই ছবির গান একসময় দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল মাতিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। 'তোলো ছিন্নবীণা', 'ও তোমারই চলা পথে' কিংবা 'এমন মধুর সন্ধ্যা'- এগুলি ছিল বাঙালির বড় পরিচিত গান। আজকাল দোলের সময় বাংলা গান বড় কমই শোনা যায়। তবে একসময় ভিক্টর-অপর্ণা অভিনীত 'খেলবো হোলি'- ই ছিল আট থেকে আশির গুনগুন করার সবচেয়ে পছন্দের গান।
জাতীয় সম্মান থেকে পদ্ম পুরস্কার- অধরা নেই কিছুই
ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ই ভারতের একমাত্র ব্যক্তি যিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনটি বিভাগে। তাঁর ডকুমেন্টারি 'Where No Journeys End '- র জন্য সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। ২৭টি দেশ থেকে ৩১০০ ডকুমেন্টারি এসেছিল প্রতিযোগিতায়। এই ডকুমেন্টারি হিউস্টন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল গোল্ড অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিল। এছাড়াও ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ডকুমেন্টারি 'The Splendour of Garhwal and Roopkund'- র জন্য পরিচালক হিসেবে জিতে নিয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। আর অভিনেতা হিসেবে (সেরা পার্শ্ব অভিনেতা) সত্যজিৎ রায়ের ছবি 'ঘরে বাইরে' জাতীয় পুরস্কারের সাফল্য এনে দিয়েছিল ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাংলা ছবির পাশাপাশ শুধু বলিউড নয় হলিউডেও বেশ দাপিয়ে অভিনয় করেছেন এই অভিনেতা। ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মভূষণ পুরস্কারেও সম্মানিত করা হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৭ সালে সত্যজিৎ রায়ের 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি' ছবির হাত ধরেই সেলুলয়েডে আত্মপ্রকাশ করেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। একাধিক জনপ্রিয় পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। আদ্যন্ত কমার্শিয়াল ছবি 'লাঠি'- তে প্রভাত রায়ের পরিচালনায় ভিক্টরের স্কুল শিক্ষকের চরিত্র আজীবন মনে রাখবে দর্শকমহল।
আরও পড়ুন- মুকেশ মানে শুধু 'বেদনা' নয়, তাঁর গান আম-আদমির রূঢ় বাস্তবের কথা বলে, প্রেমেও পড়ায়