সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন ১৫ নভেম্বর চলে গেলেন, ভারতে এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, যাঁরা তাঁর কেরিয়ার পর্যবেক্ষণ করেছিলেন বা যাঁরা অন্তত সত্যজিত্ রায়ের সিনেমাটিক কৌশলের সঙ্গে একটু বেশি পরিচিত ছিলেন, তাঁদের অনেকের মতোই আমারও মনে হয়েছিল, আমার নিজের শৈশবেরও খানিকটা আকস্মিক চলে গেল।
সৌমিত্রদা খ্যাতি পেয়েছিলেন যুবক অপু হিসাবে, সত্যজিতের ট্রিলজির তৃতীয় ভাগ অপুর সংসার-এ, যে গ্রাম ও পুরোহিতের জীবন ছেড়ে বড় শহর কলকাতার আকর্ষণ, রোমাঞ্চ ও অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়িয়েছিল। শোনা যায়, সত্যজিত্ নাকি তাঁকে ট্রিলজির দ্বিতীয় ভাগ অপরাজিত-য় অপু হিসাবে চেয়েছিলেন। কিন্তু কমবয়সি অপুর চরিত্রের জন্য় সেই সৌমিত্র ছিলেন বেশি বয়স্ক। তবুও সৌমিত্র এতটাই আবেশ ছড়িয়েছিলেন যে, মনে হয় উনিই শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্ক অপুর চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ট্রিলজি দিয়ে অপুর জীবনে ইতি টানা হয়েছে,কিন্তু অপুর জীবনের সঙ্গে কত অসংখ্য অল্পবয়সির জীবন জুড়ে গিয়েছিল। কারও মনে হতেই পারে, সৌমিত্রই আগাগোড়া অপু ছিলেন, অপুর জীবন যেন তাঁরই।

আমাদের দেশের শিল্প, সংস্কৃতি, বৌদ্ধিক দুনিয়ার সেরা মানুষদের অনেকের ক্ষেত্রেই কথাটা যেমন সত্য়, বিশেষ করে যাঁরা পুরোপুরি অ্যাংলোফোন দুনিয়ার সংশ্লিষ্ট অহঙ্কারের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেননি, সৌমিত্রদা বাঙ্গালি সমাজের কাছে ছিলেন রেনেসাঁ-সম ব্য়ক্তিত্ব যা বাকি ভারতের কাছে তিনি যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। তিনি বাংলার বাইরের জগতে মোটেই অপরিচিত ছিলেন না, একের পর এক খ্যাতি-সম্মান পেয়েছিলেন, যার মধ্যে আছে পদ্মভূষণ (২০০৪), ভারতীয় সিনেমার সমৃদ্ধিতে সারা জীবনের অবদানের জন্য দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (২০১২)। ফরাসিরা বিশ্ব সংস্কৃতির সমঝদার হিসাবে নিজেরা গর্ব করে থাকে। সম্ভবত সৌমিত্রদাকে লিজিয়ন দ্য অনার (২০১৮) দিয়ে সম্মানিত করা তাঁরই প্রতিফলন। কলকাতায় সৌমিত্রদার লার্জার দ্যান লাইফ (মহামানব) ইমেজ, কেননা তিনি থিয়েটারের দুনিয়ায় একাধারে অভিনেতা, নির্দেশক আবার নাট্যলেখকও। তাঁর কমেডি ‘ঘটক বিদায়’ নাকি ৫০০ রাত শো হয়েছে। তিনি দারুণ প্রতিষ্ঠিত কবি, প্রাবন্ধিকও। ৩০টির বেশি বই লিখেছেন, ছবিও আঁকেন দারুণ। আর এটা যেন ভুলে না যাই ৩০০ ছবিতে অভিনয় করেছেন, কাজ করেছেন প্রায় সব শীর্ষ চিত্রপরিচালকের সঙ্গে, যাঁদের মধ্যে আছেন তপন সিংহ, মৃণাল সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন।



যা-ই হোক, সৌমিত্র নিজে যেমন স্বীকার করেছেন এবং গোটা বিশ্বও জেনেছে, তাঁর নাম সত্য়জিত্ রায়ের নামের সঙ্গে সমোচ্চারিত হয়ে ওঠে তিনি অপুর সংসার (১৯৫৯)-এ আত্মপ্রকাশ করতেই। সত্য়জিতের ১৪টি ছবিতে কাজ করেছেন, ঈর্ষণীয় অভিনয় ক্ষমতার বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন। অভিযান-এ (১৯৬২) তাঁকে দেখি মেজাজি ট্যাক্সিচালক নরসিংয়ের চরিত্রে, সে রাজপুত।আমেরিকান ওয়েস্টার্নে নায়ক বরং নারীর বদলে ঘোড়া নিয়ে চলে যায়, কিন্তু নরসিংয়ের নারীতে টান নেই। তাঁর সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ১৯৩০-এর সেই মডেলের গাড়িটা। আবার সত্য়জিতের অশনি সংকেত (১৯৭৬)-এ তাঁকে পাই আদর্শবাদী ডাক্তার গঙ্গাচরণ হিসাবে।১৯৪৩ এর বাংলার মন্বন্তর এই ছবির প্রেক্ষাপট। তারপর চারুলতা (১৯৬৪)। ছবিটি সত্যজিতের অন্য ছবির থেকে ভিন্ন। এখানে সৌমিত্র হয়েছেন অমল, যে এক তরুণ সুদর্শন, বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয় ভূপতির বাড়ি গিয়ে সে পায় তাঁর একাকিনী নিঃসঙ্গ স্ত্রী চারুকে। সাহিত্য, সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা সে ভাগ করে চারুর সঙ্গে। কোমল, তবে সমাজের চোখে নিষিদ্ধ ঘনিষ্ঠতার ভঙ্গুরতা তার চেয়ে ভাল করে ফুটে ওঠেনি কোথাও।
তবে সব বলার পর যেটা বলার বাকি থাকে, সেটা হল, যুক্তিসঙ্গত কারণেই অপুর সংসারকে সৌমিত্রের কেরিয়ারে সবচেয়ে বড় মাইলস্টোন বলা যায়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্য সেরা পন্ডিতদের অন্যতম, সত্যজিতের সমসাময়িক আকিরা কুরোসাওয়া তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, মানবজাতির প্রতি গভীর, অনুচ্চারিত ভালবাসা, উপলব্ধি, পর্যবেক্ষণ আমায় দারুণ অনুপ্রাণিত করেছে। এটা ওনার সব ছবিরই বিশেষত্ব। সত্যজিতের সিনেমা না দেখা মানে সূর্য্য বা চাঁদকে না দেখে বেঁচে থাকা। প্রথম ‘পথের পাঁচালি’ (১৯৫৫) দেখার পর তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। কুরোসাওয়া নিঃসন্দেহে মনে মনে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পার্ট কী হতে পারে, সেকথা ভেবেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে পথের পাঁচালি শেষ হয়ে যায় অপুর বোন দুর্গার মৃত্যু ও ওদের বাবা হরিহরের গ্রামের পৈত্রিক ভিটে ত্যাগের সিদ্ধান্তে। ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬) শেষ হয় অপুর মায়ের মৃত্যু ও তাঁর কলকাতা ফিরে স্কুলের পরীক্ষায় বসার সিদ্ধান্তে।
সৌমিত্র ‘অপুর সংসার’-এ অপু হিসাবে হাজির হবেন। প্রারম্ভিক দৃশ্যে বলা হচ্ছে, অপূর্ব কুমার রায় কলকাতার সিটি কলেজের ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স ক্লাসের ছাত্র। সে আবেগপ্রবণ, বিবেকবান, পরিশ্রমী। পূর্ণ সমবেদনা ও উত্সাহ পাওয়ার দাবিদার।“
ছবিটার প্লট ও ন্য়ারেটিভ কাঠামো ব্যাখ্যা করার জায়গা এই নিবন্ধ নয়। এটুকু বলাই যথেষ্ট যে একাকী অপু, যে কোনওদিন নারী সংস্পর্শই করেনি, আচমকা দেখল, একেবারে অস্বাভাবিক এক পরিস্থিতিতে এক যুবতীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল! সত্যজিতের আগের দিকের বেশিরভাগ কাজকেই বলা হয়েছে ‘খাঁটি সিনেমা,’ কিন্তু ‘ভিস্য়ুয়াল পোয়েট্রি’ গতিময়তা ও স্থিরতার মিলনকে বোঝানোর সবচেয়ে সেরা উপায়। অপু ও অপর্ণার (শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত) বিবাহিত জীবনকে দেখানো হয়েছে মাত্র কয়েকটি দৃশ্যে। সবগুলিই সহজ, সূক্ষ্ম, মাধুর্য্যে ভরা। সেন্সরশিপ বিধি যৌন মিলনের আকছার প্রকাশ অনুমোদন করত না। কিন্তু সত্য়জিতের খোলাখুলি ভালবাসা, প্রেমের দৃশ্য দেখানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। অপর্ণা সকালে ঘুম থেকে ওঠে, তার পাশে শুয়ে অপু। অপর্ণা বিছানা থেকে উঠে পড়তে যায়, কিন্তু দেখে শাড়ির কোণাটা কুর্তার সঙ্গে আটকে আছে। এমন দুষ্টুমির জন্য তাকে মৃদু চাপড় মেরে সে বাঁধনটা খুলে ফেলে। অপু চোখে মেলে দেখে, স্ত্রীর হেয়ার পিন বালিশের ওপর। শরীরী সম্পর্ক বোঝাতে এটুকু যেন যথেষ্টরও বেশি।

কে বলতে পারে, অন্য কোনও অভিনেতা সৌমিত্রর মতো এত নিখুঁত ভাবে দৃশ্যটা ফুটিয়ে তুলতে পারতেন কিনা? এখানে তাকে সংসার জীবন, সুখী দাম্পত্য়ের মধ্যে জীবনরস, সজীব, প্রাণবন্ত মেজাজ তুলে ধরতে হয়েছে। কিন্তু বেশি সুখ মানুষের সয় না। আর খুব বেশি সুখ দেখিয়ে ভাল সিনেমা হয় না। সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় অপর্ণা মারা যায়। কিন্তু তাদের সন্তান বেঁচে যায়। স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকে পাথর অপু ছেলে কাজলকে ফেলে চলে যায়, যদিও কয়েক বছর পর তাঁকে আবার কাছে টেনে নিতে আসে। কাজল তার প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখায়। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বাবার কাছে ঘেঁযতে থাকে। অপুর ভয়, সব হারিয়ে গিয়েছে। সে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু কাজল তাকে দূর থেকে নজরে রাখে। অপুর সংসার-এর শেষ দৃশ্যের চেয়ে ভাল ছবি সিনেমায় খুব কমই হতে পারে। কাজল ছুটে এসে বাবার বাহুবন্ধনে ধরা দেয়। অপু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে তুলে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ট্রিলজির শুরুর ছবি ‘পথের পাঁচালি’। কিন্তু আসলে পুরো যাত্রাটাই পথের পাঁচালি। সুতরাং অপুর সংসার-এর অপু মানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শুরু থেকেই ছিলেন। সৌমিত্রকে অপু হিসাবে দেখা মানে একটা পুরো জীবনের পরিক্রমার মধ্য দিয়ে চলা।

(লেখক প্রাবন্ধিক, খ্যাতনামা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত)