পুরুষোত্তম পণ্ডিত, কলকাতা: জীবন একটাই। কিন্তু সেই জীবনের মধ্যেই অনন্ত জীবনের সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু তাঁর ভাবনার, তাঁর আদর্শের মৃত্যু হয় না। 


সুজিত সরকারের ছবি ‘সর্দার উধম’ এই আদর্শের কাহিনিই শোনায়। সমানাধিকারের, স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার এক যুবকের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। আপাত দৃষ্টিতে শান্ত যুবকটির হৃদয়ে তীব্র দহন। সেই দহন শান্ত করতে দীর্ঘ অপেক্ষা। যুবকটির বুকে জ্বলতে থাকা সেই আগুনের উত্তাপ ছুঁয়ে যায় দর্শকদেরও। 



ভারত থেকে ইংল্যান্ড পাড়ি দিয়ে ক্যাক্সটন হলের একটি সভায় পিস্তলের গুলিতে মাইকেল ও’ডায়ারকে হত্যা করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী উধম সিং। জালিয়ানওয়ালাবাগের নারকীয় হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল উধম সিংহের মুঠোয় ধরা সেই পিস্তল। আদালতে দাঁড়িয়ে নিজের প্রাণভিক্ষা করেননি উধম। ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। দৃপ্ত কন্ঠে ভগৎ সিংহের বন্ধু উধম বলেছিলেন, তিনি বিপ্লবী। যাঁরা মনুষ্যত্বের মর্যাদাকে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য খুন করে, তাঁদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। 


আমাজন প্রাইম ভিডিওয় মুক্তি পাওয়া সর্দার উধম যেন টাইম ট্র্যাভেল। যে মুনশিয়ানায় সুজিত সরকার ১৯১৯ থেকে ১৯৪০ - এই সময়কালকে তাঁর ছবিতে তুলে ধরেছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। ছোট ছোট ঘটনায় এক একটা আলাদা গল্প যেন তৈরি হয়েছে সর্দার উধমের কাহিনিতে। বর্তমান এবং অতীতের প্রেক্ষাপট ক্রমপর্যায়ে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করেছেন সুজিত। তাঁর প্রতিটি ছবির মতই এই ছবিতেও ডিটেলিং অনবদ্য। 


সর্দার উধমের কাহিনি শুরু হয়েছে জেলখানার এক অন্ধকার কুঠুরি থেকে। সেই কুঠুরি থেকে দিনের আলোয় বেরিয়ে আসার পর পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে ভোল বদলে এক অন্তহীন পথে পাড়ি দেন উধম। অমৃতসর থেকে আফগানিস্তান, রাশিয়া হয়ে জাহাজে চেপে লন্ডনে পৌঁছন তিনি। তার পর দীর্ঘ ছ’বছরের অপেক্ষা। অপেক্ষা এমন একটা সুযোগের, যেখান থেকে নতুন করে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। ভারতের স্বাধীনতাই শুধু নয়, মানুষে মানুষে সমানাধিকারের দাবি ছড়িয়ে দেওয়া যাবে সারা বিশ্বে।


লন্ডনে মাইকেল ও’ডায়ারকে বহুবার হাতের নাগালে পেয়েছেন সর্দার উধম। কিন্তু, গুলি চালাননি। ও’ডায়ারের বাড়িতেই পরিচারকের কাজ করেছেন, লন্ডনের রাস্তায় পোশাক বিক্রি করেছেন, কারখানায় কাজ করেছেন। আর অপেক্ষায় থেকেছেন সঠিক সময়ের জন্য।  স্বাধীনতা সংগ্রামী শহিদ ভগৎ সিংহের সঙ্গে সর্দার উধমের বন্ধুত্বের গল্পও উঠে এসেছে এই ছবিতে। উধমের মনে দুঃস্বপ্নের মত জেগে থাকা জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই অভিশপ্ত দিনটিকে সুজিক সরকার যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন, তাতে তীব্র হয়ে উঠেছে মৃত্যুর হিম-শীতল গন্ধ। উধম তাঁর রেশমাকে খুঁজতে গিয়েছিলেন সেই মাঠে। নিজের একজনকে খুঁজতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মৃতদেহের স্তুপে সবাই তাঁর আপন হয়ে উঠেছিল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে প্রবল শারীরিক অত্যাচারেও ভেঙে পড়েননি উধম। তখন শুধু একটাই কথা বলেছিলেন। তিনি মৃত্যু দেখেছেন। তাই তাঁর কোনও যন্ত্রণা নেই। তিনি মৃত্যুকে দেখছেন। ফাঁসির দড়িতে নিজের জীবন দিয়ে অমূল্য একটা কথা বলে যান উধম সিং। যৌবন এক সম্পদ। মানুষের উপরেই নির্ভর করে সে তাঁর যৌবনকে অর্থবহ করে তুলবে, নাকি এমনই ভাসিয়ে দেবে সময়ের স্রোতে। 


সুজিত সরকারের এই ছবির পুরোটা জুড়ে, শুধুই ভিকি কৌশল। অসামান্য দক্ষতায় এই ছবিতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন ভিকি। সুজিত যখন এই ছবির পরিকল্পনা করেন, সেই সময় উধমের চরিত্রের জন্য তাঁর মাথায় ছিলেন ইরফান খান। তবে বলতেই হয় পরিশ্রমে, মুনশিয়ানায় সুজিতের স্বপ্নকে সত্যি করে তুলেছেন ভিকি। সুজিতের ছবিতে বরাবরই অভিনেতারা এমন এক একটি চরিত্র পান, যা আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের ফিল্মযগ্রাফিতে সম্পদ হয়ে থাকে। ‘সর্দার উধম’ ভিকি কৌশলের ফিল্মগ্রাফিতে তেমনই একটি ছবি হিসেবে রয়ে যাবে। উধমের বান্ধবী রেশমার চরিত্রে এই ছবিতে অভিনয় করেছেন বনিতা সান্ধু। ছোট্ট হলেও তাঁর উপস্থিতি আলাদা করে নজর কাড়ে। ভগৎ সিংহের চরিত্রে অমল পরাশরের অভিনয়ও মন ছুঁয়ে যায়। সিনোম্যাটোগ্রাফার অভীক মুখোপাধ্যায়ও ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন এই ছবিতে। সর্দার উধমের ভেতরে লুকিয়ে থাকা মানুষটির সাধারণ আবরণটিকেই এই ছবিতে ভিকির গায়ে চাপিয়ে দিয়েছেন পরিচালক সুজিত সরকার। উধম বিপ্লবী। কিন্তু প্রবল হুঙ্কার, আস্ফালন বর্জিত এক সাধারণ যুবকের মতই তাঁর গতিবিধি। ক্ষনিকের রক্তগরম করা সংলাপ নয়, সাধারণ কথায় এক অমূল্য জীবনবোধ আর আদর্শকে রক্তে মিশিয়ে দিতে চায় উধমের মুখের কথাগুলো।


শুভেন্দু ভট্টাচার্য এবং রীতেশ শাহর লেখা চিত্রনাট্য, সংলাপ এই ছবির অন্যতম সম্পদ। চন্দ্রশেখর প্রজাপতির এডিটিংও চমৎকার। অভীক মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য সিনেম্যাটোগ্রাফির সঙ্গে শান্তনু মৈত্রের আবহসঙ্গীত ছবির প্রতিটি মুহূর্তকে যেন জীবনের স্পন্দন জুগিয়েছে। সুজিত সরকারের পরিচালিত, রনি লাহিড়ি, শীল কুমার প্রযোজিত ‘সর্দার উধম’ শুধু একটি সিনেমা নয়, সময়ের দলিল। ইতিহাসের পাতা থেকে বিপ্লবের বারুদের গন্ধমাখা এক অধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে ‘সর্দার উধম’ তীব্র আলোড়ন তোলে দর্শকের চেতনায়, অবচেতনেও।