কলকাতা: রুপোলি পর্দার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তিনি। কিংবদন্তি। তিনি যে সময়ে, যে পরিস্থিতিতে, ছবি পরিচালনার মূল ধারার স্রোতের বিপরীতে হাঁটার সাহস করেছিলেন, তা তৎকালীন বাঙালির কাছে কার্যত অকল্পনীয় ছিল। সত্যজিৎ রায় (Satyajit Roy)। আক্ষরিক অর্থেই তিনি বাঙালির মণিমাণিক্য.. মানিক। কয়েকটা দিন পেরিয়েই তাঁর জন্মদিন। তাঁর ছবিতে বারে বারে ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলা ছবি থেকে শুরু করে বঙ্গ জীবনের টুকরো টুকরো চিত্র। আজ, পর্দায় তাঁর কাজের আলোচনা নয়, কলমে ভর করে ঘুরে দেখা যাক বাংলার সেই সমস্ত জায়গাগুলো,যা সত্যজিৎ রায়ের ছোঁয়া হয়ে উঠেছে অসাধারণ, ঐতিহাসিক। জেনে নেওয়া যাক, শ্যুটিংয়ের সময় সেইসব জায়গায় কী কী গল্প তৈরি হয়েছিল, যা ক্যামেরার আড়ালেই থেকে গিয়েছে। 


পালসিটের কাশফুল গেল কই?


সাদা কাশবনের বুকে কালো ধোঁয়া ছেড়ে ছুটে আসছে কয়লার ইঞ্জিন। আর সেই ট্রেন দেখার জন্য উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে দুই ভাই-বোন। অপু আর দুর্গা। আমৃত্যু এই দৃশ্য ভুলবে না বাঙালি। 'পথের পাঁচালি' ছবির এই দৃশ্যটির শ্যুটিং হয়েছিল, কলকাতা থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে বর্ধমানের পালসিটে। রেললাইনের ধারে খুঁজে বের করা হয়েছিল এক কাশবনের। কথা ছিল, সেখানেই শ্যুটিং করা হবে ভাই বোনের ট্রেন দেখার দৃশ্যটা। অন্তত ২ দিন সময় লাগার কথা অত বড় দৃশ্য শ্যুটিং করতে। প্রথমদিনের শ্যুটিংও হয়ে যায় কার্যত নির্বিঘ্নে। তবে প্রথম কাজ। খুদে অভিনেতা অভিনেত্রী, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান সবাই একটু দ্বিধায়, বাধো বাধো। সকাল থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত শ্যুটিং চলল। প্রথমদিনের শ্যুটিং মিটিয়ে পরিচালক সহ, কলকাতায় ফিরে এলেন সবাই। দিন সাতেক পরে ফের শ্যুটিংয়ে যাওয়ার কথা। সেই মতো ৭ দিন পরে পালসিটে পৌঁছতেই মাথায় হাত। রেললাইনের ধারের সেই কাশবন বিলকুল গায়েব! স্থানীয় মানুষদের থেকে জানা গেল, কাশফুল নাকি গরুর প্রিয় খাদ্য। আর তাই, দিন সাতাকেই কাশফুল খেয়ে শেষ করে ফেলেছে তারা। দৃশ্যের পার্থক্য এতটাই, যে শ্যুটিংই করা চলে না। কাশফুলের দৃশ্যের শ্যুটিং করার জন্য গোটা একটা বছর অপেক্ষা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। পরের বছর শরতে আবার যখন কাশফুল ফুটল, তিনি ফিরেছিলেন পালসিটে। তখনই শ্যুটিং করা হয়েছিল কাশবনে ছোটার বাকি অংশ ও ট্রেনের দৃশ্য। গোটা 'পথের পাঁচালি' ছবির শ্যুটিং করতে সময় লেগেছিল আড়াই বছর। 


বোড়ালের শ্যুটিং সেটে গোখরো সাপ!


সত্যজিৎ রায়ের চোখ নিশ্চিন্দিপুরের গ্রামকে খুঁজে পেয়েছিলেন বোড়ালে। মাঠঘাট, ডোবা, আমবন, অপু-দুর্গার বাড়ি, অপুর পাঠশালা, সবই পাওয়া গিয়েছিল বোড়ালেরই আশেপাশে। পর্দায় অপু-দুর্গার যে বাড়িটি দেখানো, সেটি ছিল একেবারেই জীর্ণ অবস্থায়। বাড়ির মালিক থাকতেন কলকাতায়। মাসিক ভাড়া দিয়ে সেই বাড়িকেই শ্যুটিংয়ের জন্য ব্যবহার করতেন সত্যজিৎ রায়। বাড়িটি মেরামত করে শ্যুটিংয়ের যোগ্য করতে সময় লেগেছিল ১ মাস। বাড়ির কয়েকটি ঘরে থাকত জিনিসপত্র, শ্যুটিংয়ের যন্ত্রপাতি। তারই একটা ঘরে বসে ছবির শব্দগ্রহণের কাজটি করতেন ভূপেনবাবু। শট হয়ে গেলে, সেখান থেকেই চিৎকার করে তাঁকে প্রশ্ন করা হত, সাউন্ড ঠিকঠাক হয়েছে কি না। ঘর থেকেই চিৎকার করে উত্তর দিতেন ভূপেনবাবু। একদিন এমন প্রশ্ন করাতে কোনও উত্তর পেলেন না পরিচালক। একাধিকবার প্রশ্নের পরেও যখন উত্তর এল না, তখন সবাই মিলে এলেন ভূপেনবাবুর ঘরে। ঢুকেই একটা দৃশ্য দেখে সবাই অবাক, ভীতও। পিছনের জানলা দিয়ে মাটিতে নামছে একটা প্রমাণ সাইজের গোখরো সাপ। আর তাই দেখেই কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে ভূপেনবাবুর। পরে জানা গিয়েছিল, ওই সাপটি দীর্ঘদিন ধরেই পোড়ো বাড়িতে বসবাস করছে। গ্রামের মানুষেরা আবেদন করেছিলেন, সাপটিকে যেন না মারা হয়। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, ওটি বাস্তুসাপ। অনুরোধ রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়।


 


তথ্যসূত্র: 'একেই বলে শ্যুটিং'


লেখক: সত্যজিৎ রায়


 


আরও পড়ুন: Workout: শরীরচর্চার সময় আচমকাই 'অ্যাজমা অ্যাটাক'! এই সমস্যা এড়াতে কী কী নিয়ম মেনে চলবেন?