কলকাতা: বোর্ডে অঙ্ক লিখতে যতটা সময় লাগল, কষতে তার অর্ধেকেরও কম? কম্পিউটারের থেকেও তাড়াতাড়ি অঙ্কের উত্তর বলে দিতে পারে কোনও মানুষ? এই অসম্ভবটাই সম্ভব করেছিলেন ১৯ শতকের গোড়ার দিকের এক নারী। যিনি বলতেন ‘অঙ্কে নিয়ম নেই, শুধু ম্যাজিক আছে’! পরবর্তীকালে বিশ্ব যাকে চিনেছিল হিউম্যান কম্পিউটার নামে। শকুন্তলা দেবী। এবার রুপোলি পর্দায় সেই ভারতীয় গণিতবিদের কাহিনীই ফুটিয়ে তুলেছেন অনু মেনন। ছবির নাম ভূমিকায় রয়েছেন বিদ্যা বালন। আজই অ্যামাজন প্রাইমে মুক্তি পেল বিদ্যা বালন,সান্যা মালহোত্রা, অমিত সাধ ও যিশু সেনগুপ্ত অভিনীত ‘শকুন্তলা দেবী’। বাস্তব জীবনে অঙ্ক কেমন লাগত বিদ্যার? নারীর ক্ষমতায়ন থেকে বলিউডের নারীকেন্দ্রিক ছবি, কী ভাবেন তিনি? কলকাতা নিয়ে রয়েছে কতটা আবেগ? এবিপি আনন্দ-র সঙ্গে ভার্চুয়াল আড্ডায় মজলেন বিদ্যা।



প্রশ্ন- ফিল্মে তিন চিজো কি ওজেসে চলতি হ্যায়, এন্টারনেটমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট অউর এন্টারটেনমেন্ট! আপনার সিনেমার বিখ্যাত সংলাপ। কখনও ভেবেছিলেন অঙ্ক একটা এন্টারটেনিং সিনেমার বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে?

বিদ্যা বালন- না, কোনওদিন না (হাসি)। কখনও ভাবিনি অঙ্ক কোনও মজার বিষয় হতে পারে। কিন্তু শকুন্তলা দেবীর অঙ্ক করার ভিডিও যদি দেখেন, তাহলে বুঝবেন অঙ্ক অবশ্যই একটা মনোগ্রাহী মজার জিনিস হয়ে উঠতে পারে। ওঁর সমস্ত অঙ্কের শো ঠিক ম্যাজিক শো-এর মতো ছিল। সেখানে এত উৎসাহ, খেলা, মজা করা, হাসি... সবকিছু। স্কুলে যদি আমাদের ঠিক এমন করে অঙ্কের ক্লাস করানো যেত, তাহলে আমরা কক্ষনও ভয় পেতাম না। শকুন্তলা দেবী ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে আমি বুঝেছি, সমস্ত জায়গাতেই অঙ্ক রয়েছে। এই জন্য যখন শকুন্তলা দেবী অঙ্ক নিয়ে শো করতেন, সবার মনে হত অঙ্ক খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। উনি প্রথম মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন, গান, কবিতা থেকে শুরু করে রান্না বা ফটোগ্রাফি, সমস্ত জায়গাতেই লুকিয়ে রয়েছে অঙ্ক। যাকে দেখা যায় না তাকেই কেবল ভয় করা উচিত। কিন্তু অঙ্ক তো ছড়িয়ে থাকে আমাদের রোজনামচার সর্বত্র।



প্রশ্ন- স্কুল জীবনে বিদ্যা বালনের অঙ্ক করতে কেমন লাগত?

বিদ্যা- ভালো। সংখ্যার সঙ্গে আমার সবসময়ই বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। হয়ত এই কারণেই শকুন্তলা দেবী ছবিটা আমার জন্য একটু সহজ ছিল। আমি সংখ্যাগুলো সহজেই মনে রাখতে পারতাম। সংখ্যার সঙ্গে বন্ধুত্ব না হলে এই ছবি করতে একটু সমস্যা তো হত বটেই। বাট থ্যাঙ্কফুলি আই হ্যাভ ম্যানেজড!



 

প্রশ্ন-  শকুন্তলা দেবীর জীবনের কোন অংশটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল?

বিদ্যা- আমরা সবাই জানি শকুন্তলা দেবী অঙ্কে চৌখশ ছিলেন। সারা পৃথিবী তাঁকে মানব কম্পিউটার বলে জানত। কিন্তু আমি জানতাম না উনি জীবনে কখনও স্কুলেই যাননি! আমি কেবল এইটুকু জানতাম, ওনার নাম গিনেস বুক অফ ওয়র্ল্ড রেকর্ডে রয়েছে। কিন্তু জানতাম না উনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অনেক বইও লিখেছিলেন। অঙ্ক তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে রয়েছে জ্যোতিষচর্চা, ক্রাইম থ্রিলার এমনকি ছেলেদের জন্য একটা রান্নার বই (হাসি)! উনি প্রথম সমকামিতা নিয়ে বই লিখেছিলেন! এত কিছু জীবনে অর্জন করেছিলেন শকুন্তলা দেবী। এই সবকিছু আমায় ভীষণভাবে অনুপ্ররণা জুগিয়েছে। সেই যুগের নারী হয়ে উনি ভেবেছিলেন, আমায় আকাশ ছুঁতে হবে আর তাই করে দেখিয়েছিলেন। ওনার পৃথিবীর ভয় ছিল না। নিজেই নিজের শর্তে, নিজের জন্য বাঁচতে জানতেন শকুন্তলা দেবী। সেই শিক্ষা হয়তো আমরা এখনও পুরোটা শিখে উঠতে পারিনি।



প্রশ্ন- ট্রেলারে শকুন্তলারূপী বিদ্যা তাঁর মেয়েকে বলছেন, ‘তুমনে মুঝসে মেরা ম্যাথস ছুড়ওয়া দিয়া।‘ বাস্তব জীবনে বিদ্যাকে কি পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিজের পছন্দের কোনও জিনিস ছেড়ে দিতে হয়েছে?

বিদ্য়া- এখনও পর্যন্ত না। এজন্য আমি আমার পরিবার, আমার স্বামীর কাছে খুব কৃতজ্ঞ। আমায় কেউ কোনওদিন কোনও সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয়নি।



প্রশ্ন- অনেক পরিবার আছে যেখানে এখনও মেয়েদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোকে সমর্থন করা হয় না। ‘মিশন মঙ্গল’ ছবিতে আপনি একজন বৈজ্ঞানিক আবার একজন পুরোদস্তুর সংসারী। ‘শকুন্তলা দেবী’ ছবিতেও জীবনের লক্ষ্যপূরণ ও পারিবারিক সম্পর্কের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমান জীবনে একজন নারীর পক্ষে কর্মক্ষেত্র ও পারিবারিক জীবন একসঙ্গে সামলানো ঠিক কতটা মুশকিল?

বিদ্যা- খুব কঠিন! কারণ মানুষটা তো একটাই! নিজেকে কত ভাগে ভাগ করা সম্ভব? একজন প্রফেশনাল, একজন মা, একজন পত্নী, একজন মেয়ে, একজন বোন, একজন বন্ধু... আরও কত কী! বিশেষ করে ভারতে একটা বিশ্বাস এখনও রয়েছে। একবার মা হয়ে যাওয়ার পর একজন নারীর পুরো দুনিয়াটাই তৈরি হয়ে যায় সন্তানকে ঘিরে। নিজের কোনও ইচ্ছা থাকলে, স্বপ্ন থাকলে অনেকে সেটা বুঝতে পারে না। এই দশকেও অনেকে বলেন, এখন তো তুমি একজন মা। জীবন থেকে আর কী নতুন করে পাওয়ার আছে তোমার? এই পরিস্থিতিতে আমরা মেয়েরা যদি কোনও কাজ করতে গিয়ে পরিবারের থেকে একটু সাহায্য পাই আমাদের মনে হয় আমরা অনেক বড় কিছু পেয়ে গেছি। অনেক মেয়ে এইভাবেই বলেন, আমার স্বামী আমায় এই কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু এই অনুমতির প্রয়োজনই বা কেন হবে! একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী নিজের খুশি মতো কাজ করতেই পারেন! অনেক সময় মেয়েরা পরিবারের জন্য নিজেদের স্বপ্নকে ভুলে যান। আর যাদের নিজেদের কর্মজীবন রয়েছে, তাঁরা প্রতিনিয়ত কাজ ও সাংসারিক জীবনের জাঁতাকলে নিস্পেষিত হন! কারণ তাঁরা ভাবেন তাঁদের সমস্ত কিছু সামলাতে হবে। কিন্তু সবকিছু সামলানো কখনই সম্ভব হয় না। বেশিরভাগ সময়ই তাঁরা সবকিছু করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আসলে আমাদের আরও অনেকটা বেশি সাহায্যের দরকার। ভারতীয় পরিবারে সন্তানদের বড় করার জন্য গোটা পরিবার থাকে। কিন্তু আমাদের, আমাদের মেয়েদের আরও বেশি করে পাশে থাকা উচিত। তবেই তো মেয়েরা তাদের স্বপ্নপূরণ করতে পারবে। ঠিক যেভাবে একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীকে কেরিয়ারের দিক থেকে সাহায্য করে, ঠিক তেমনটাই করা উচিত স্বামীদেরও।­



প্রশ্ন- বলিউডে এখন নারীকেন্দ্রিক ছবি তৈরির একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়টাকে কতটা সদর্থকভাবে দেখছেন?

বিদ্যা- আমি গত ১০-১২ বছর ধরে এই ধারার ছবি করছি। আমি যখন ‘ইশকিয়া’ করেছিলাম তখন তো নারীকেন্দ্রিক ছবি তৈরিই হচ্ছিল না। এরপর আস্তে আস্তে আমার এই ছবিগুলি দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হয়। অন্যান্য নায়িকারাও এখন নারীকেন্দ্রিক ছবি করতে শুরু করেছেন। এখন যখন এই ধরনের ছবি খুব জনপ্রিয় হচ্ছে তখন প্রযোজকরাও নারিকেন্দ্রিক ছবি বানানোর দিকে ঝুঁকছেন। আমরা চাই নারীদের গল্প দেখতে, শুনতে। এটাই তো সঠিক সময়! এতদিন আমরা শুধু নায়কদের গল্প শুনেছি। এবার আমাদের নিজেদের গল্প দেখার সময় এসেছে। আজকাল মেয়েরা এত কিছু অর্জন করছে। সেই সাফল্যকে আমাদের উদযাপন করা উচিত। আমি খুব খুশি আমরা শকুন্তলা দেবীর জীবনী নিয়ে কাজ করেছি। হয়তো ১০০ বছরে একজন শকুন্তলা দেবীর জন্ম হয়। আমার মনে হয় শকুন্তলা দেবীর কথা স্কুলে পাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভূক্ত হওয়া উচিত। আমি যখন স্কুলে পড়তাম আমি অন্তত শকুন্তলা দেবীর কথা পড়িনি। আমি আশা করি এই ছবি সবাইকে শকুন্তলা দেবীর জীবনের কথা শেখাবে। উনি একজন দৃষ্টান্ত ছিলেন। এমন মানুষদের সাফল্য আমাদের উদযাপন করা উচিত। তবেই তো মহিলারা প্রেরণা পাবে, স্বপ্ন দেখতে শিখবে।



প্রশ্ন- আপনার রুপোলি পর্দায় পথ চলা শুরু বাংলা ছবি ‘ভালো থেকো’-র হাত ধরে। এরপর আপনার একাধিক ছবি যেমন কাহানি, ভুলভুলাইয়াতেও বাংলা যোগ রয়েছে। ব্যতিক্রমী নয় ‘শকুন্তলা দেবী’ ও। বাংলা নিয়ে অবসেসড?

বিদ্যা- হ্যাঁ সত্যিই। শকুন্তলা দেবীর স্বামী বাঙালি ছিলেন। সেই চরিত্রে অভিনয় করেছেন যিশু সেনগুপ্ত। ওর সঙ্গে আমার বেশ ভালোই সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। আমরা সেটে একে অপরের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতাম। আমি যিশু আর শিলাদিত্য ছাড়া সেটে আর কেউ বাংলা জানত না। আমরা বাংলায় কথা বলে হাসাহাসি করতাম। আর সবাই বলত কী কথা বলছো তোমরা? কেউ কিছু বুঝতে পারত না(হাসি)। একজন ভালো অভিনেটা ছাড়াও যিশু একজন খুব ভালো মানুষ। আশা করি ওর সঙ্গে আবার কাজ করতে পারব।



প্রশ্ন- এর আগে অনেকবারই কলকাতায় শ্যুটিং করতে এসেছেন। এই শহর বলতে প্রথম কী মনে পড়ে?

বিদ্যা- জাস্ট কলকাতা! নামটাই যথেষ্ট। ওই গলিগুলো... ওখানের সমস্ত গলিতে বোধহয় আমি শ্যুটিং করেছি। কলকাতার মানুষকে আমার খুব ভালো লাগে। ওখানকার মানুষেরা আমায় খুব ভালোবেসেছেন। আগে মনে হত কলকাতা গেলে মিষ্টি দই খাব। এখন অনেকদিন মিষ্টি খাই না। তবে নলেন গুড়ের রসগোল্লা বড্ড ভালোলাগে। যদিও সেটা সবসময় পাওয়া যায় না।



 

প্রশ্ন- সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে আপনার আবৃত্তি ‘ডিয়ার ডটার্স অফ ইন্ডিয়া’। বিদ্যা বালন নিজে যদি এখনকার মেয়েদের জন্য কোনও বার্তা দিতে চান তাহলে কী বলবেন?

বিদ্যা- আমি এই কবিতাটা লিখিনি। কিন্তু এত সুন্দর কবিতা আমি আবৃত্তি করার সুযোগ পেয়েছি। সেই কবিতার কথাগুলোই আমি সব মেয়েদের বলতে চাইব। বলব, যাও.. ডানায় ভর করে আকাশকে ছুঁয়ে ফেলো। তারাদের জড়িয়ে ধরো। এই পৃথিবীটা তোমার। কেবল নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। কেউ নিঁখুত হয় না। আমাদের ভাবা উচিত নয় আমরা নিঁখুত হব। শকুন্তলা দেবী বিশ্বাস করতেন, আমি যেমনই হই না কেন, আমি অসাধারণ। ট্রেলারে একটা ডায়লগ ছিল- জব অ্যামেজিং হো সকতি হুঁ তো নরম্যাল কিউ বনু? এটাই আমাদের সবার মনে রাখা উচিত। বেশিরভাগ সময়ই মেয়েরা তাদের আশেপাশের মানুষদের স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য নিজেরাই অপ্রতিভ হয়ে পড়েন। এই অভ্যাস বদলাবার সময় এসেছে।