কলকাতা: টানা ৮৩ দিন ঘরে বসে পড়া হয়ে গিয়েছে আলমারিতে সাজানো প্রায় সমস্ত বই। দেখা হয়ে গিয়েছে বেশিরভাগ ওয়েবসিরিজ। নতুন শেখা রান্নার রেসিপির বৈচিত্রেও টান পড়েছে যখন, তখনই ফের পুরনো জীবনে ফেরার ডাক পেল টলিউড। ১০ জুন থেকে শুরু হতে চলেছে শ্যুটিং। কিন্তু এত স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে কী করে সম্ভব বিভিন্ন দৃশ্যে সম্পর্কের সমীকরণকে অবিকল ফুটিয়ে তোলা? কতটা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে সুরক্ষা? নিরাপত্তা বিধি মাথায় রেখে কী কী পরিবর্তন হতে পারে চিত্রনাট্যে? শ্যুটিং শুরুর আগে কী ভাবছে টলিপাড়ার তারকারা? খোঁজ নিল এবিপি আনন্দ।
পাওলি দাম
প্রায় ৩ মাস বিচ্ছেদের পর জীবনে ফিরতে চলেছে লাইটস-ক্যামেরা-অ্যাকশন। কিন্তু ফ্লোরে পা রাখার আগে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাকেই অগ্রাধিকার দিতে চান পাওলি দাম। এবিপি আনন্দকে মোবাইল ফোনে অভিনেত্রী বললেন, ‘শ্যুটিং শুরু না করা পর্যন্ত বোঝা যাবে না কী কী প্রভাব ফেলবে নতুন পদ্ধতি। তবে সবাইকে কোভিড পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজ করতে হবে। কারণ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে অনেক মানুষের জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে।’ লকডাউনে বাড়িতে বসে বিরক্তি কাটাতে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন গান, কবিতা কিংবা আঁকার। পরোক্ষভাবে ভাবলে সবাইকেই আশ্রয় দিয়েছিল শিল্পের বিভিন্ন আঙ্গিক। আর বিনোদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম অভিনয় তো ফুটিয়ে তোলে মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবিকেই। ২ ফুটের দূরত্ব বজায় রেখে, স্পর্শ এড়িয়ে কতটা সম্ভব সাবলীল অভিনয়? পাওলি বলছেন, ‘মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হল স্পর্শ। আমরা বাড়ির পোষ্য থেকে শুরু করে মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান যে কোনও সম্পর্কেই আবেগের প্রকাশ ঘটাতে স্পর্শ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ছবির বেশিরভাগটাই জুড়ে রয়েছে সামাজিক সম্পর্কের গল্প। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি সম্পর্কে ফুটিয়ে তোলা হবে কীভাবে? এর জন্য পরিচালক বা চিত্রনাট্যকারকেই ভাবতে হবে বিভিন্ন পদ্ধতি। বর্তমান সময় আমাদের সবাইকে চিত্রনাট্য নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার একটা বিরাট সুযোগ করে দিল। আমার মনে হয় এতে অনেক নতুন চিন্তাভাবনার দরজা খুলে যাবে।’ লকডাউনের জেরে আটকে পড়েছিল একাধিক ছবির কাজ! তাই শ্যুটিং শুরুর প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেন পাওলি। সেই সঙ্গে বললেন, ‘সুরক্ষা মেনেই হবে বিনোদন। আর তার জন্য নতুন পদ্ধতি আসবেই। তাই চিত্রন্যাট্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে হলেও আপসহীন নজরে দেখতে হবে সবার স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাকে।’
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
লকডাউনে সঙ্গী হয়েছিল লেখালেখি, ওয়েবসিরিজ আর বই। ঘরে বসে কাজে যোগ দেবার জন্য ছটফট করছিলেন। অবশেষে সেই পথ খুলেছে। অভিনয় পদ্ধতির প্রচলিত ছক ভেঙে সাময়িক আপোসের কথাই বললেন পরমব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। এবিপি আনন্দকে মোবাইল ফোনে পরমব্রত বললেন, ‘এখন অন্তত কিছুদিনের জন্য গাইডলাইন মেনেই চালু করতে হবে শ্যুটিং। ফ্লোরে ঢোকার সময় স্বাস্থ্যপরীক্ষা করার কথা হয়েছে। তবে সমস্ত দৃশ্যে ২ ফুট দূরত্বের নিয়মবিধি মেনে চলা সম্ভব নয়। তাই কোনওভাবে যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর জন্য থাকছে বিশেষ স্বাস্থ্যবিমা।’ করোনার সঙ্গে লড়াইয়ের মূল মন্ত্রই হল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। তাহলে কী করে হবে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের শ্যুটিং? পরমব্রত বলছেন, ‘আপাতত কিছুদিনের জন্য বাদ দিতে হবে সমস্তরকম ঘনিষ্ঠ দৃশ্য। চিত্রনাট্যও পরিকল্পনাও করতে হবে সেই অনুযায়ী। বৈঠকে আপাতত সেইরকমই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথমে ১-২ মাস ভীষণ অসুবিধা হবে। তারপর আস্তে আস্তে গা-সওয়া হয়ে যাবে নতুন নিয়ম।’ স্পর্শবিহীন অভিনয় কতটা প্রাণবন্ত হবে, তা নিয়ে অবশ্য ধন্দে পরমব্রত। ‘ আমরা কোনওদিনও এইভাবে কাজ করিনি। সবার কাছেই এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। ঠিক যেমন এখন বাইরে বেরোনোর সময় মাস্ক, গ্লাভস, চশমা ব্যবহার নিউ নরম্যাল হয়ে গিয়েছে। শ্যুটিং শুরু হলে বোঝা যাবে ঠিক কী কী সমস্যা আসতে চলেছে।’ অবসর কাটিয়ে এবার ফিরতে হবে কাজে। ‘আশা করি পরিস্থিতির খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হবে। আরও নীচে নামবে সংক্রমণের গ্রাফও। আবিষ্কার হয়ে যেতে পারে করোনার প্রতিষেধকও। তখন আবার আগের নিয়মেই শ্যুটিং শুরু হবে,’ বলছেন আশাবাদী পরমব্রত।
তনুশ্রী চক্রবর্তী
ফটোশ্যুট করানোর প্রয়োজন। কিন্তু ভয়ে বাড়িতে কাউকে ডাকতে পারছেন না। যেতে পারছেন না কোনও স্টুডিওতেও। গাইডলাইন মেনে কেমন করে সম্ভব শ্যুটিং, আদৌ কি সম্ভব হবে প্রয়োজনীয় সুরক্ষাবিধি মেনে চলা, এমনই হাজার প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তনুশ্রী চক্রবর্তী। ফোনে তনুশ্রী বলছিলেন, ‘শ্যুটিং গাইডলাইনে বলা হয়েছে ফ্লোরে লোকসংখ্যা কমানো হবে। কিন্তু এত কম লোক নিয়ে শ্যুটিং কী করে সম্ভব! পরিচালকদের কাছেও এটা বেশ চ্যালেঞ্জিং।’ অন্তরঙ্গ দৃশ্যে তনুশ্রীর সাবলীল অভিনয় দর্শক-সমালোচক, সকলের কাছেই প্রশংসিত হয়েছে। তবে নতুন গাইডলাইন মেনে চললে কীভাবে হবে সেই সমস্ত দৃশ্যের শ্যুটিং? তাহলে কি পর্দায় আর দেখা যাবে না চুম্বন? তনুশ্রী বললেন, ‘বেশ কিছু ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দরকার পড়ে। তবে বেশ কিছু জায়গায় আবার অপ্রয়োজনীয়ভাবে অন্তরঙ্গ দৃশ্য রাখা হয়। এইক্ষেত্রে পরিচালক-প্রযোজকদের আবার নতুনভাবে ভাবতে হবে কী করে কোনওরকম চুম্বন বা অন্তরঙ্গ দৃশ্য ছাড়াই চিত্রনাট্য লেখা যায়। এই অভ্যাসের চর্চাটা একদিক থেকে ভালো।’ শিশুশিল্পীদের এই মুহূর্তে কাজে যোগ দিতে বারণ করা হয়েছে। তবে একান্ত প্রয়োজনে তাঁদের জন্য বাড়িতে শ্যুটিং করা যেতে পারে বলে মনে করছেন তনুশ্রী। শ্যুটিং করতে গিয়ে ব্যবহার করা যাবে না মাস্ক, গ্লাভস। তনুশ্রী বলছেন, ‘বাড়িতে বয়স্ক মা-বাবা রয়েছেন। শ্যুটিং করতে গিয়ে যদি সাইলেন্ট ক্যারিয়ার হয়ে যাই সেই ভয়ও রয়েছে।’ তবে তনুশ্রী আশাবাদী, খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিকত্ব ফিরবে শ্যুটিং ফ্লোরে।
রুদ্রনীল ঘোষ
করোনা লকডাউনে আর্থিক ক্ষতির মুখ দেখেছে তামাম টলিপাড়া। তাই গাইডলাইন মেনে শ্যুটিং শুরুর প্রস্তাব ভীষণ ইতিবাচক বলে মনে করছেন রুদ্রনীল ঘোষ। টেলিফোনে এবিপি আনন্দকে তিনি বললেন, ‘শ্যুটিং ফ্লোরে স্যানিটাইজেশন থেকে শুরু করে যা যা সুরক্ষাবিধি আছে তা পালন হলে কাজ শুরু করাটাই কাম্য। তবে কাজ শুরু করার জন্য কাউকেই বাধ্য করা যাবে না। যাঁরা কোভিড আতঙ্ক কাটিয়ে উঠেছেন তাঁদের অপেক্ষায় রয়েছে ফ্লোর। আর যাঁরা এখনও সংক্রমণের ভয় পাচ্ছেন, তাঁদের আরও কিছুটা সময় দেওয়া দরকার।’ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত গাইডলাইনে পোশাক বা মেকআপ সংক্রান্ত কিছু নিয়ম মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে মেক আপ আর্টিস্ট, হেয়ার ড্রেসারদের পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিকে জোর দিতে বলছেন রুদ্রনীল। কোনও শট চলাকালীন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ব্যবহার করতে পারবেন না মাস্ক বা গ্লাভস। তাই রুদ্রনীলের আর্জি, ‘কাজে যোগ দেওয়ার আগে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সকলের যদি কোভিড-১৯ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে সবদিক থেকেই নিশ্চিত হওয়া যাবে।’ অন্যদিকে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় নিয়ে সহ-অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতোই সুর রুদ্রনীলের গলায়। বললেন, ‘যে দৃশ্যে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কাছাকাছি আসেন সেটাই ঘনিষ্ঠ দৃশ্য। তা যেমন প্রেমের হতে পারে, তেমনই হতে পারে অ্যাকশন সিকোয়েন্স। তাই ভাবতে হবে কীভাবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে দর্শকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরা যায় ছবির গল্প।’ এখনও আউটডোর শ্যুটিংয়ের ব্যাপারে জারি হয়নি কোনও নতুন নিয়ম। তাই রুদ্রনীলের ধারণা, সিনেমার শ্যুটিং শুরু হতে এখনও বেশ কিছুটা দেরি হতে পারে। কারণ সমস্ত পরিকল্পনাই নতুন করে করতে হবে। সেই সঙ্গে বয়ঃজ্যেষ্ঠ ও শিশুদের সুরক্ষার ওপর জোর দিয়ে রুদ্রনীল বলেন, ‘ চিত্রনাট্যের প্রয়োজন হলে অল্পবয়সী কাউকে দিয়ে অভিনয় করানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে নেওয়া হবে মেক আপের সাহায্য। কিন্তু সুরক্ষা নিয়ে কোনওরকম আপস করা যাবে না।’
আগামী ৭ তারিখ ফের বৈঠকে বসবে টলিপাড়া। তৈরি হবে চূড়ান্ত গাইডলাইন। তারপরে নতুন নিয়মবিধিই মেনে ফ্লোরে ফিরবেন সকলে। নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফের শুরু হবে অভিনয়।