কলকাতা: 'সত্যজিৎ রায় চেয়েছিলেন, বাংলার পোড়া আকাশে ইউএফও নেমে আসুক'... এই ভাবনাই যেন তাঁর পাথেয় হয়ে গিয়েছিল। চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ১০০ বছরের জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবেন। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। তবু পরিকল্পনা ছিল , বড়পর্দায় ঘোঁতন আর পপিন্সকে ফেরানোর। সেই কারণেই ফের তিনি পর্দায় নিয়ে এলেন, 'পক্ষীরাজের ডিম'। এই ডিমে চোখ রাখলে নাকি দেখা যায় মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা আবেগ। এ হেন পক্ষীরাজের ডিম এসে পড়ল 'রেনবো জেলি'-র ঘোঁতন আর পপিন্সের হাতে। তারপর? সেই গল্প এবিপি লাইভ বাংলাকে (ABP Live Bangla) শোনালেন পরিচালক সৌকর্য্য ঘোষাল (Soukarya Ghosal)। 

'রেনবো জেলি' দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেই থেকেই কি 'পক্ষীরাজের ডিম' আনার পরিকল্পনা? সৌকর্য্য বলছেন, 'রেনবো জেলি করার পরে অনেক ছোটদের অভিভাবকেরাই আমায় বলেছিলেন, এই ধরণের ছোটদের ছবি আরও নিয়ে আসতে। আমার মাথায় ছিল যে ঘোঁতন আর পপিন্সকে নিয়ে সিনেমা করলে, সেটা সাই ফাইয়ের দিকেই যাবে। সত্যজিৎ রায় সায়েন্স ফিকশন নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন। তার জন্য তিনি হলিউডেও পাড়ি দিয়েছিলেন। সেটা বিভিন্ন জটিলতার কারণে হয়ে ওঠেনি। সেই আফশোস ওঁর ছিল। সেটা আমাকেও ছোটবেলা থেকে খুব কষ্ট দিত। উনি চেয়েছিলেন বাংলার এই পোড়া আকাশে ইউএফও নেমে আসুক। সেই ভাবনা থেকেই পরিকল্পনা করেছিলাম সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবার্ষিকীতে একটা সায়েন্স ফিকশন নিয়ে কাজ করার। সেই সময়ে সেটা হয়ে ওঠেনি। তবে সেই ভাবনা থেকেই 'পক্ষীরাজের ডিম'-এর জন্ম। আমি যে কটা ছবি করেছি, তার মধ্যে আমার অন্যতম প্রিয় চরিত্র ঘোঁতন আর পপিন্স। ফলে ওদের পর্দায় ফিরিয়ে আনার একটি পরিকল্পনা ছিলই। তবে এই ছবির ভাবনার বীজটা ওই সত্যজিৎ রায়ের ইউএফও নিয়ে ছবি করার স্বপ্নই।'

ঘোঁতন আর পপিন্সের পাশাপাশি, এই ছবি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বটব্যাল। সেই চরিত্রে দেখা গিয়েছে অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে। এর আগে অনির্বাণকে এইরকম চরিত্রে দেখা যায়নি। সৌকর্য্য কী করে তাঁকে কল্পনা করলেন? পরিচালক বলছেন, 'অনির্বাণকে ভেবেই আমি চিত্রনাট্য লিখেছি। ও ভীষণ দক্ষ অভিনেতা, বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছে। তবে অনির্বাণ কখনও বাচ্চাদের জন্য কোনও চরিত্র করেনি, কোনও বিজ্ঞানীর চরিত্র করেনি। সাই ফাইয়ের দুনিয়ায় ও কখনও কাজ করেনি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, ও এটা দারুণ পারবে। এসভিএফকে যখন এই ছবিটা পিচ করি, আমার আর্জি ছিল, অনির্বাণকেই লাগবে।'

মহাব্রত আর অনুমেঘা, ছবি দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র এখন অনেকটাই বড় হয়েছে। ওদের সঙ্গে এইবার কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? সৌকর্য বলছেন, 'দুটো ২ ধরণের। ওরা যখন ছোট ছিল, ছবির গল্প আলাদা ছিল। এখন ওরা বড় হয়েছে, ফলে ছবির গল্পগুলো ও বদলে গিয়েছে। চরিত্রের বিভিন্ন শেড এসেছে, অভিনয়ের জায়গা বেড়েছে। ওদের নিয়ে ৪ মাস ধরে আমি একটা ওয়ার্কশপ করেছিলাম। প্রথমে ওদের তৈরি করি। ওরা ৩ মাস মতো সময় নিয়েছিল, শেষ ১ মাস অনির্বাণের সঙ্গে ওয়ার্কশপ করেছিলাম মহাব্রত আর অনুমেঘাকে নিয়ে। 'রেনবো জেলি'-র পরে ওরা যেহেতু কোনও কাজ করেনি, ওদের আবার ওই খাঁচাটায় ঢোকানোর জন্য সময়ের দরকার ছিল।'

ছবির শ্যুটিং হয়েছে শিমুলতলায়। এই জায়গার কথাটা কেন মাথায় এসেছিল পরিচালকের? সৌকর্য বলছেন, 'শিমুলতলা আমার খুব প্রিয় জায়গা। ওখানে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, এ যেন সত্যজিৎ রায়েরই ইলাস্ট্রেশন। শিমুলতলার একটু দূরেই গিরিডি। সত্যজিতের গল্পের আবহ, সেটা শিমুলতলায় পাওয়া যায়। সেই কারণেই ওখানে শ্যুটিং।'

সৌকর্যের ছবি মানেই সেখানে ছোটদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। বাচ্চাদের জন্য ছবি বর্তমানে কম হচ্ছে, সেই কারণেই কি সৌকর্যের এই প্রচেষ্টা? পরিচালক বলছেন, 'শুধু বাচ্চাদের তো আর হলমুখী করা যায় না। কারণ তারা একা সিনেমা দেখতে আসবে না। বাবা মায়েদের তো তাদের নিয়ে আসতে হবে। তবে আমি বড়দের ছবি করলেও, সেখানে বাচ্চারা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকে। কারণ, আমার মনে হয়, ছবি যদি জীবনের দর্পণ হয়, সেখানে পুরুষ, নারী, রূপান্তরকামী প্রত্যেকের বার্তা তুলে ধরার অধিকার থাকে, তাহলে সেই অধিকার একটা বাচ্চারও রয়েছে। ভূতপরী, পক্ষীরাজের ডিম এই ছবিগুলো বাচ্চাদের কথা মাথায় রেখেই বানানো। এখন হয়তো বাচ্চাদের ছবির সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। আমি নিজে যখন ছোট ছিলাম, ভেবে দেখেছি আমিও ছোটদের ছবি মিস করতাম। সেই কারণেই বাচ্চাদের ছবি তৈরি করা।'

ছবির বিষয়বস্তু যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ ছবির ব্যবসায়ীক দিকও। সেটা কি মাথায় রাখেন সৌকর্য্য? পরিচালক বলছেন, 'ব্যবসায়ীক দিক ভেবে ছবি করলে আদৌ ব্যবসা হবে কি না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ছবির ব্যবসা হয় কারণ মানুষ ছবিটা দেখেন। এর জন্য ২টো জিনিস লাগে। প্রথমত, একটা সঠিক সময়ে ছবিটা মুক্তি পেতে হয়। আর মানুষের ভাল লাগতে হয়। মানুষের ছবি ভাল লাগলে মানুষ সেটা দেখতে যাবেই। পরিচালকের লক্ষ হবে এটা মাথায় রাখা, মানুষের ছবিটা ভাল লাগবে কেন? মানুষের ছবি তবেই ভাল লাগবে, যখন মানুষ নতুন কিছু দেখবে। মৌলিক কিছু। পরিচালকের নিজের ওপর সেই বিশ্বাস থাকতে হবে। আমি সেইভাবেই ছবি বানিয়েছি। বানিজ্যিক দিক থেকে বাচ্চাদের ছবির ক্ষেত্রে প্রয়োজকেরা এমনিতেই এগিয়ে থাকেন। প্রযোজকেরা বাচ্চাদের ছবি করতে চান। যখন যখন বাচ্চাদের ছবি হয়, বাণিজ্য হয়, সেটা হলিউড, বলিউড বা টলিউড হোক।'

আগামীদিনেও ছোটদের জন্যই ছবি তৈরি করবেন পরিচালক? সৌকর্য বলছেন, 'ছোটদের জন্য আলাদা করে কোনও ছবি হয় বলে আমি বিশ্বাস করি না। সিনেমা সবার জন্য হয়। হ্যাঁ, বলতে পারেন আমার ছবিতে ছোটদের একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র থাকে। আগামীদিনেও তাই থাকবে।'