জীবনের আশীর্বাদ বলে মনে করেন 'কোনি' ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ। 'কোনির সঙ্গে যুক্ত সবাই তো চলেই গিয়েছেন। ভগবানের সঙ্গে লড়াই চলছিল ক্ষিদ্দার। জিততে পারলেন না।' শ্যুটিং-এর অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ সৌমিত্রকে চেনা, এবিপি আনন্দের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কখনও গলা ধরে এল, কখনও স্মৃতির ঝুলি উপুড় করে দিলেন শ্রীপর্ণা।
পেশা হিসাবে অভিনয়কে বেছে নেননি কোনওদিনই। শ্রীপর্ণার সঙ্গে রূপোলি পর্দার যোগসূত্র ছিলেন একমাত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শ্রীপর্ণা বলছেন, 'মোতি নন্দীর 'কোনি' বইটি যখন প্রকাশিত হয়, আমি তখন পড়াশোনা করছি, সাঁতার শিখছি। কেন্দ্রীয় চরিত্রে কালুদার (সরোজ দে) প্রথম পছন্দ যেমন আমি যেমন ছিলাম না, তেমন ক্ষিদ্দার চরিত্রেও প্রথম পছন্দ সৌমিত্রদা ছিলেন না। উত্তমকুমার বলে রেখেছিলেন, 'কোনওদিন যদি কোনি বইটা নিয়ে ছবি হয়, তাহলে ক্ষিদ্দার চরিত্র আমি করব।' উত্তমকুমার তার কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান। শুনেছিলাম তারপর ওই চরিত্রটা নাসিরুদ্দিন শাহর করার কথা ছিল। ক্ষিদ্দার চরিত্রে তৃতীয় পছন্দ ছিলেন সৌমিত্রদা। ভাবলে অবাক লাগে, আমার বা সৌমিত্রদার কারওই প্রথমে এই ছবিটায় অভিনয় করার কথা ছিল না।'
'ক্ষিদ্দা চরিত্রের জন্য কোনও পুরস্কার পাননি উনি। অথচ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একাধিকবার সৌমিত্রদা বলেছেন, ক্ষিদ্দা ওনার অভিনীত অন্যতম সেরা চরিত্র।' আক্ষেপের সুর শ্রীপর্ণার গলায়। কোনির শ্যুটিং-এর কথা ভাবলেই ভিড় করে আসে কত রঙিন স্মৃতি। পর্দার কোনি বলছেন, 'সৌমিত্রদা যখন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন প্রথম, তখন উনি তারকা। অথচ আমি অভিনয় করব সেই কথা শুনেই ১০ মিনিটের মধ্যে আমার বাড়ি চলে এসেছিলেন, কেবল কাজটা ভালো হওয়ার জন্য। ওই ছবিতে আমার সঙ্গে বাকি যারা অভিনয় করেছিলেন, সবাই আমার বন্ধু। অত বড় একজন কিংবদন্তির সঙ্গে অভিনয় করব বলে আমাদের প্রথমদিকে একটু জড়তা ছিল। কিন্তু খুব অল্পদিনের মধ্যেই উনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে আমাদের সৌমিত্রদা হয়ে উঠেছিলেন। ওঁকে সম্মান করি একজন তারকা হিসেবে নয়, স্বভাবগুণে উনি সম্মানের যোগ্য ছিলেন। শ্যুটিং-এর পর আমরা সবাই গল্প করতে বসতাম। কলেজের গল্প.. প্রফেসরদের গল্প...। সৌমিত্রদা একবার আমাদের নিয়ে কালুদাকে বলেছিলেন, ওদের দলটাকে আমার বড় ভালো লাগে, কারণ ওদের মধ্যে এখনও পেশাদারিত্বটা আসেনি।'
ক্ষিদ্দা চরিত্রের জন্য নিজেকে নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন সৌমিত্র। শ্রীপর্ণা বলছেন, 'একবার শ্যুটিং করতে করতে আমরা বলি, ক্ষিদ্দার সঙ্গে আমাদের কোচ অনিলদার(অনিল দাশগুপ্ত) অনেক মিল রয়েছে। আমাদের সেই কথাটাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সৌমিত্রদা। সেটা তখন বুঝলাম, যখন দেখলাম, পরেরদিনই ভোর সাড়ে ৫টায় উনি আমাদের সুইমিং ক্লাব আইএসএল-এ হাজির হয়ে গিয়েছেন। দিনের পর দিন উনি ক্লাবের একটা কোণায় বসে অনিলদাকে লক্ষ্য করতেন। শ্যুটিং-এ দেখেছিলাম, সত্যিই আমাদের কোচের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অবিকল আয়ত্ত করে ফেলেছেন সৌমিত্রদা।'
কোনির শেষ দৃশ্যে ক্ষিদ্দার গলায় 'ফাইট কোনি ফাইট' এখনও যেন অক্সিজেন দেয় শ্রীপর্ণাকে। বললেন, 'ওই দৃশ্যটা করতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেছিলেন সৌমিত্রদা। গ্লিসারিনের প্রয়োজন ওনার পড়ত না। আমার মনে হয়, উত্তমকুমারের চেয়েও বড়মাপের অভিনেতা ছিলেন উনি।'
পরবর্তীকালে যখনই দেখা হয়েছে, নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। একবার আইএলএস ক্লাবেই এসেছিলেন সৌমিত্র। অনুষ্ঠান শেষে চলছিল গল্প। সেদিনের কথা মনে করে শ্রীপর্ণা বলছেন, 'হঠাৎ সৌমিত্রদা আমায় বললেন, 'আমার খুব ভয় করে জানিস তো!' আমি মনে করছিলাম শরীরের কথা বলছেন। আমি সাধারণত প্রশ্ন করতাম না উনি কথা বললে, বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। সম্প্রতি দেখা হতে বলেছিলেন, 'আমার ফোন নম্বরটা আছে তোর কাছে?' তারপর নিজে থেকেই নম্বরটা দিয়ে বললেন, 'মাঝে মাঝে ফোন করিস। ভালো লাগবে।'
ক্ষিদ্দার ফাইট শেষ। কোনির মোবাইলে কেবল রয়ে গেল নম্বরটা।