পুরুষোত্তম পণ্ডিত, কলকাতা: অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওয় শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে ফারহান আখতার, ম্রুণাল ঠাকুর অভিনীত ছবি ‘তুফান’। একজন বক্সারের ভূমিকায় এই ছবিতে অভিনয় করেছেন ফারহান। ছবিটি পরিচালনা করেছেন রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা।



মানুষ পরিস্থিতির দাস নয়। পরিস্থিতি তাঁর ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কেউ একজন কেমন মানুষ হবেন, তা নির্ভর করে তাঁর ইচ্ছে, পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক দৃঢ়তার উপরে। এই সবকটি উপাদান যদি সঠিক ভাবে মিলে যায়, তাহলে যে কেউই, এমনকি মুম্বইয়ের ডোংরি এলাকার ঘিঞ্জি বসতির গুণ্ডা আজ্জু ভাইও বক্সিং রিংয়ের বিখ্যাত আজিজ আলি হয়ে উঠতে পারে। এই বিশ্বাস আর পরিশ্রমে স্বপ্নের উত্তরণের কাহিনিই শোনায় আজিজ। রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার ছবি ‘তুফান’-এর মুখ্য চরিত্র আজিজ। বলাই বাহুল্য, ‘ভাগ মিলখা ভাগ’-এর ট্র্যাকে ফারহান আখতার যে সাবলীলতায় দৌড়েছিলেন, রাকেশের এই নতুন ছবিতেও বক্সিং রিংয়ে আজিজের চরিত্রে তিনি ততটাই সাবলীল, ততটাই ক্ষিপ্র, ততটাই শক্তিমান।  


সিনেমা সিনেমা হয়ে ওঠে নায়কের সাফল্যে, খলনায়কের ব্যর্থতায়। তুফানও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সব ঝড়ের প্রকৃতি যেমন এক হয় না, তেমনই তুফানও অন্যান্য ঝড়ের থেকে আলাদা হয়ে ওঠে। শুরুতে বলতেই হয়, গল্পের প্লটে কেউ যদি খুব নতুনত্বের প্রত্যাশা করে ছবিটি দেখতে বসেন, তাহলে সে আশা পূর্ণ হবে না। তুফানের মূল বিষয়টি লুকিয়ে কাহিনির স্বাদের মাধুর্যে। কিছু দীর্ঘ সময় নিয়েই ধীমে আঁচে ছবিটি বানিয়েছেন পরিচালক রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা। এই ছবির কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন অঞ্জুম রাজাবলী, যিনি এর আগে 'গুলাম', 'রাজনীতি'-র মতো ছবি উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। তুফানের কাহিনি শুরু হয় ডোংরির এঁদো দেওয়াল, মরচে ধরা জীবন, আর অন্ধকারে থেকেও আলো খুঁজে নেওয়ার চেষ্টায় মরিয়া এক তোলাবাজ গুন্ডার জীবনকে ঘিরে। আজ্জু ভাই। তার মুখ যেমন চলে, হাতও তেমন চলে। তোলাবাজির টাকায় বস জাফর ভাইকে খুশি করার পাশাপাশি নিজের খুশিতে সে টাকা ওড়ায় এলাকার অনাথ শিশুদের জন্য। তাদের বিরিয়ানি থেকে জুতো, সানগ্লাস - সবকিছুর দায়িত্ব আজ্জু ভাইয়ের কাঁধে। এহেন আজ্জুই একদিন মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে হাজির হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় তরুণী চিকিৎসক অনন্যা প্রভুর। প্রথম আলাপেই প্রেম হয়নি। সেখানে রাগ ছিল, ঘৃণা ছিল। কিন্তু আজ্জুর অন্য এক রূপ দেখে ধীরে ধীরে তাঁকেই ভালবেসে ফেলে অনন্যা। তবে শর্ত ছিল একটাই। মানুষ হতে হবে। সামাজিক সম্মান নিয়ে বাঁচতে হবে। এই শর্তই বদলে দেয় আজ্জুকে।


মহম্মদ আলির বক্সিংয়ের ভিডিও দেখে বক্সিংয়ের প্রেমে পড়ে আজ্জু। তারপর ঘটনাচক্রে আজ্জু থেকে বক্সার আজিজ আলি হয়ে ওঠার নেপথ্যে সবথেকে বড় ভূমিকা নেন অনন্যার বাবা নারায়ণ নানা প্রভু। অনন্যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ম্রুণাল ঠাকুর। নানা প্রভুর চরিত্রে পরেশ রাওয়াল। আজ্জু থেকে আজিজ হয়ে ওঠার পর্বে ফারহানের অক্লান্ত পরিশ্রমের ছাপ ছবির পরতে পরতে। অভিনয়ে ফারহান ছবির প্রতিটি দৃশ্যে সপ্রতিভ। কোথাও বাড়তি অভিনয়ের লেশমাত্র নেই। আজিজের পেশীবহুল শরীরের মতোই ফারহানের অভিনয় নির্মেদ। কিন্তু ছবিতে ফারহানের বয়সের ছাপ লুকোনো যায়নি। অভিনয়ে ফারহানকে যোগ্য সঙ্গত করেছেন ম্রুণাল। তবে কিছু কিছু দৃশ্যে ম্রুণালের মেকআপ অতিরিক্ত বলেই মনে হয়েছে। একটি দৃশ্যে ম্রুণালের হাতের দামি আংটি তাঁদের পরিবারের অর্থনৈতিক চেহারার দিক থেকে বেমানান। পরেশ রাওয়ালও নিজের অভিনয়ে নানা প্রভুর চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছেন। তাঁর চরিত্রটি কখনও ‘চক দে ইন্ডিয়া'-র কবীর খানকে মনে করায়, কখনও আবার 'দঙ্গল-এর মহাবীর সিং ফোগতকে। আজ্জু ভাইয়ের ডানহাত মুন্নার চরিত্রে হুসেন দালালের অভিনয় দুর্দান্ত। স্পেশ্যাল অ্যাপিয়ারেন্সে ধর্মেশ পাটিলের চরিত্রে দর্শন কুমারও নজর কেড়েছেন।


সিলভেস্টার স্ট্যালোনের ‘রকি’-ই হোক বা মার্টিন স্করসেসির ‘রেজিং বুল’, বা রায়ান কগলারের ‘ক্রিড’ - বিখ্যাত স্পোর্টস মুভিগুলির মধ্যে বক্সিংয়ের প্রতিটি কাহিনিতে অনিবার্য ভাবে এটাই দেখানো হয়েছে যে বক্সিং শুধু মাত্র একটি খেলা নয়। বক্সিং রিংয়ের হার-জিতের বাইরেও জীবনের ঔজ্বল্য ধরে রাখাটাই একজন বক্সারের কাছে চ্যালেঞ্জ। বক্সিং একটা পরিচয়। শৌর্য, সম্মান, উন্নত জীবনের স্বপ্ন সার্থক করাই বক্সারের লক্ষ্য। ‘তুফান’-এও বক্সিং শুধু মাত্র খেলায় আটকে থাকেনি। সাফল্য পাওয়ার পর ব্যর্থতার আগুনেও ঝলসেছে আজিজ। নেতিবাচক ভাবনা এসেছে মনে। কিন্তু সময়ের তাগিদেই আবার তাঁকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে। তার সবচেয়ে কঠিন লড়াইটা কোনও প্রতিপক্ষের সঙ্গে ছিল না। ছিল, নিজের সঙ্গে। আজিজ সেই লড়াই জিতেছে। 


অনন্যা আর আজিজের ভালবাসা ধর্মের বাধা মানেনি। জীবনকে  দেখেছে নিজেদের এক প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গীতে। যেখানে ভেদাভেদের কোনও দেওয়াল নেই। একে অপরের স্বপ্নের পাশে দাঁড়িয়ে ঘর বেঁধেছে । তবে নানা প্রভুর চরিত্রটি বক্সিং রিংয়ে জয় হনুমান বলছেন, সঙ্গে সঙ্গে আজিজও তাই বলছে-এই বিষয়টি আরোপিত মনে হয়েছে। নানা জাতি, নানা ভাষা, নান ধর্মের ভারতীয় ঐতিহ্যে চেনা ছবি ধরে পড়েছে আজিজ-অনন্যার বিয়ের দৃশ্যে। 


পরিচালক রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার এই ছবির দৈর্ঘ্য দর্শকের ধৈর্যচ্যূতির কারণ হতে পারে কোথাও কোথাও। প্রায় সোয়া তিনঘন্টা ধরে কাহিনির বিস্তার ছবির গতিকে মন্থর করেছে। এটাই দুর্বলতা। আজিজ নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলেও ‘তুফান’-এর গতি দুর্বল হয়েছে দীর্ঘসূত্রিতার কারণেই।