কলকাতা: ছোটবেলা থেকে আর সব বাঙালির মতোই তাঁরও আবেগ ছিল ফেলুদাকে নিয়ে। আর সমস্ত কিশোর বা সদ্য যুবকের মতো, নিজেকে ফেলুদা হিসেবে কল্পনা করতে তাঁর বেশ লাগত না। কিন্তু তিনি যে বড় হয়ে অভিনেতাই হবেন আর অভিনয়ের হাত ধরেই যে তাঁর সেই স্বপ্ন সফল হবে, তা বোধহয় ভাবতে পারেননি তিনি। আজ, তাঁর জন্মদিন। আর খুশির দিনে জীবনের অন্যতম বড় পাওয়ার গল্প শোনালেন অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরী (Tota Roychowdhury)। 


সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করে টোটা লিখেছেন ফেলুদা আর তাঁকে নিয়ে জড়িয়ে থাকা সমস্ত আবেগের কথা। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই পোস্টই তুলে দেওয়া হল সরাসরি। টোটা লিখছেন, 'স্বপ্নটি দেখার সূত্রপাত সেবারের জন্মদিনটি থেকে যেবার 'বাদশাহী আংটি' বইটি উপহার পেয়েছিলাম। সেই প্রথম ফেলুদার সাথে পরিচয়। সেবার পুজোয় মায়ের কাছে বায়না ধরে একটি ক্যাপ-পিস্তল বাগালাম।।ব্যাস, আর আমায় পায় কে! নাওয়া খাওয়া ভুলে সারাক্ষণ কাল্পনিক অপরাধীর পেছনে ধাওয়া করছি। থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছি, 'খবরদার, আর এক পাও এগোলে খুলি উড়িয়ে দেব।' বাড়ির লোক অতিষ্ঠ। এরপর বাবার কাছে বায়না ধরার পালা, পিস্তল হাতে একটা ছবি তুলে দাও। ততদিনে রঙিন ফটোগ্রাফির ক্যামেরা এসে গেছে কিন্তু বাবার পুরনো Yashica বক্স ক্যামেরায় সাদা কালো ছবির একটা রীল পোরা ছিল। তাই দিয়েই বাঁদিকের ছবিটা তোলা।


তারপর বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেল। টিনটোরেটোর যীশু মুক্তি পেল। প্রখ্যাত, এবং আমার অত্যন্ত প্রিয়, সাহিত্যিক শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দেশ পত্রিকায় সমালোচনায় লিখলেন, "টোটাকে যে এরপর অবধারিতভাবেই ফেলুদার চরিত্রে দেখা যাবে তা অনুমান করে নিতে কষ্ট নেই।" একটি মাত্র লাইন কিন্তু সুপ্ত স্বপ্নটিকে জাগিয়ে তুলতে এক কাপ কড়া কফির কাজ করল! লেখার কাটিংটা আজও সযত্নে তুলে রেখেছি। উক্ত সিনেমাটির প্রিমিয়ার শোয়ের শেষে একটি ঘটনা ঘটল। স্মস্রুগুম্ফমন্ডিত, পনিটেলে শোভিত, কালো ঝুল পাঞ্জাবি পরিহিত, আত্মপ্রত্যয়ে পরিপূর্ন এক উঠতি গীতিকার পপকর্ন চেবাতে চেবাতে এসে আমায় বলল, " আমি যদি কোনোদিন ফেলুদা করি, তোমায় নেব।" বলে উল্টোদিকে ঘুরে প্রিয়া সিনেমার ভিড়ে বিলীন হয়ে গেল। ততক্ষনে তার কনফিডেন্স দেখে আমি ছিটকে ছত্রিশ।

হঠাৎ একদিন শুনলাম যে বেণুদা আর ফেলুদা করবেন না। শুরু হলো দরবার করা; ফেলুদা হিসেবে একটিবার আমার স্ক্রীন টেস্ট নেওয়া হোক। পছন্দ না হলে পত্রপাঠ বাতিল করে দেবেন কিন্তু পরীক্ষা দেবার জন্য, একবার অন্তত, দয়া করে সুযোগ দিন। বহু মানুষের কাছে অনুরোধ, আর্জি নিয়ে গেলাম যদি রোলটার জন্য আমার হয়ে তদ্বির করে দেন। বঙ্কিমি হাসি ও বক্রোক্তি ছাড়া আর বিশেষ কিছু জোটে নি। এরমধ্যে আরো দুটো বিখ্যাত বাঙালি ডিটেকটিভের রোল ফিরিয়ে দিয়েছি। ততদিনে রোখ চেপে গেছে, হয় ফেলুদা, না হয় কিছুই না।

 

ফোনটা এলো এক সন্ধ্যেতে। প্রায় বারো বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে, সেই উঠতি গীতিকার ততদিনে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত পরিচালক সৃজিত মুখার্জি। ভূমিকা না করে সোজাসাপ্টা, "ফেলুদা করছি। স্ক্রীন টেস্ট নিতে চাই। দেবে?" বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে তখন আমার অবস্থা নকশাল আমলের পুলিশের মত --- পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশ বারো। যতই ভালো অভিনয় করি না কেন, যতই দর্শকদের ভালোবাসা পাইনা কেন; কোনো অজ্ঞাত কারণে পরিচালক, প্রযোজকদের মন পেতে আমি সম্পূর্নরূপে ব্যর্থ। অথচ এর মধ্যে কয়েকটা হিন্দি ছবির কাজ করে ফেলেছি। ম্যানেজার বললেন যে শিফট্ করুন। এখানে অনেকে আপনার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে। তাই মুম্বাইতে পাকাপাকিভাবে থাকব বলে ভাড়ায় ফ্ল্যাট খোঁজার জন্য তখন আমি ওই শহরে। কিন্তু 'ফেলুদা' শুনে সেই সন্ধ্যায় সব ছেড়েছুড়ে পরদিন ভোরে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। তবে স্ক্রীন টেস্ট আর দেওয়া হলো না। টেস্টের দিনদুয়েক আগে টেক্সট এলো, I am going with you. You are my Feluda. আমি হতভম্ব!! হঠাৎ করে চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো। গলায় কি যেন দলা পাকিয়ে উঠল। ঠিক পড়লাম তো? নাকি আমার দৃষ্টিশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করছে? ধরা গলায় ফোন করলাম। সৃজিত বলল, আমরা একটা look-set করব আর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে একমাস টানা শুটিং। দুটো গল্প একসাথে শুট করব। তৈরি হও।

 


 

জীবনে এক-আধবার অলীক স্বপ্নও সত্যি হয়। অবশ্যই ভাগ্যের একটা বড় ভূমিকা থাকে। পরিস্থিতিরও। তবে বিশ্বাস স্থির থাকলে আর প্রত্যয় দৃঢ় থাকলে সেটির সফল হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আমি সাক্ষী। প্রায় সাড়ে তিন দশক লেগেছে। কিন্তু বাস্তবায়িত হয়েছে। যদিও অনেকটা পথচলা বাকি। আরো ঘষেমেজে নিজেকে পরিশীলিত করতে হবে। যোগ্যতর ও যথার্থ করে তুলতে হবে নিজেকে।

 

আবারও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে। আজকের পৃথিবীতে কথা দিয়ে কথা রাখার মানুষ অত্যন্ত বিরল।

 

আর ধন্যবাদ ও ভালোবাসা জানাই সেই কিশোরটিকে যে প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে এক স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। ওরই অনুপ্রেরণায় সেই স্বপ্নটিকে আঁকড়ে ধরে পথচলার সাহস পেয়েছিলাম। বোদ্ধাদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে, প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে তার অমূল্য স্বপ্নটিকে সযত্নে লালনপালন করে গিয়েছি। অবশেষে সেই স্বপ্ন সাকার পেয়েছে।

 

ইদানীং,জন্মদিনে সেই কিশোরটি কানে কানে 'ধন্যবাদ' বলে যায়।'