কলকাতা: ফেলুদার হাত ধরে যেন কাশীর সঙ্গে বাঙালির এক অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় (Satyajit Roy)। দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে শুরু করে কাশীর অলিগলি.. ফেলুদার হাত ধরে বাঙালি চিনেছিল রহস্যের গন্ধমাখা বেনারসকে। তবে কেবল বেনারস নয়, গ্রাম বাংলার টুকরো টুকরো ছবিকে রুপোলি পর্দায় সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন সত্যজিৎ। পর্দার কাজ নয়, কলমে ভর করে ঘুরে দেখা যাক, মানিকের স্মৃতি বিজড়িত নিমতিতা রাজবাড়ি থেকে শুরু করে কাশীর অলিগলি।


কাশীর গলিতে.. মধ্যরাতে


শশীবাবুর খুনের দৃশ্য। গা ছমছমে পরিবেশে কাশীর গলি দিয়ে মধ্যরাতে হেঁটে এগিয়ে আসছেন তিন মূর্তি। লালমোহনবাবু, তোপসে আর ফেলুদা। হঠাৎ টলতে টলতে তাঁদের সামনে এসে পড়লেন রক্তাক্ত শশীবাবু। রুপোলি পর্দায় এই দৃশ্যের শ্যুটিংয়ের জন্য যে একটা শুনশান গলির প্রয়োজন, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-এর শ্যুটিংয়ের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বেনারসেই। ফলে বিভিন্ন অদ্ভূত পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। এই দৃশ্যটির শ্যুটিং করার কথা হয়েছিল মধ্যরাতে। রেইকি করে বেছে রাখা হয়েছিল একটি গলিকেও। সেই মতো মধ্যরাতে শ্যুটিংয়ের যন্ত্রপাতি নিয়ে পৌঁছনো হল। অভিনেতারাও তৈরি। কিন্তু সেই গলির সামনে পৌঁছেই মাথায় হাত সকলের। শ্যুটিং হবে শুনে মধ্যরাতেও সেখানে জমায়েত হয়েছেন কমপক্ষে হাজার মানুষ। এর আগেও অবশ্য এমন ভিড়ে বিভিন্ন দৃশ্যের শ্যুটিং করতে হয়েছিল। তবে খুনের দৃশ্য এত মানুষের মধ্যে শ্যুটিং করা কার্যত অসম্ভব। বার বার সবাইকে সরে যাওয়ার আবেদন করেও যখন কোনও ফল হল না, তখন শ্যুটিংয়ের জিনিস নিয়ে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন সত্যজিৎ। পরিচালক ফিরে গিয়েছেন, এই খবর শুনে অবশ্য সেই রাতেই তাঁর ঘরে হাজির হয়েছিল পাড়ার ছেলেরা। অনেক অনুরোধ করে তাঁরা বলেন, আগামীকাল শ্যুটিংয়ে যেতে। কথা দেন, ভিড় হবে না। পরেরদিন সত্যিই ভিড় না হলেও আরও এক অন্য উপদ্রপ হয়েছিল। শ্যুটিং হবে জেনে গোটা গলি জুড়ে নিজের শাড়ির দোকানের বিজ্ঞাপন আটকে দিয়ে গিয়েছিলেন এক বাঙালি ব্যবসায়ী। তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সরানো হয় সমস্ত বিজ্ঞাপন.. তারপরে শ্যুটিং শুরু হয়। মধ্যরাতে।


স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে নিমতিতা রাজবাড়ি


মুর্শিদাবাদের এই রাজবাড়ি এখন হেরিটেজের তকমা পেয়েছে। ১৭৫ বছর আগে গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারকানাথ চৌধুরী দুই ভাইয়ের হাতে তৈরি এই রাজবাড়ির শ্যুটিং হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের 'জলসাঘর', 'তিন কন্যা', 'দেবী'-র মতো আইকনিক সব ছবির। শ্যুটিংয়ের সৌজন্যেই এই বাড়িতে এসেছিলেন ছবি বিশ্বাস, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, তুলসী লাহিড়ী,  কালী সরকারের কিংবদন্তি শিল্পীরা। শুটিং চলাকালীন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এই রাজবাড়িতে এসেছিলেন তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায় ও পুত্র সন্দীপ রায়ও। সে সময়ে রাজবাড়ি শুধু শুটিংয়ের জন্যই ছেড়েই দেননি জমিদাররা, অতিথিদের থাকার যথাযথ ব্যবস্থাও করেছিলেন। শ্যুটিংয়ে সময়েই জমিদারদের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধুতা তৈরি হয়ে যায় সত্যজিৎ রায়ের। সেই সুবাদে তিনি মাঝেমধ্যেই সপরিবারে এখানে এসে উঠতেন। এই বাড়ির দোতলার ঘরে বসে গঙ্গা দেখা ছিল সত্যজিৎ রায়ের ভীষণ প্রিয়। এই বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রচলন না থাকলেও, গ্রামের অধিবাসীরা মঙ্গলকামনায় এই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন। একদা এই বাড়িতে এসেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, লীলা মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, দাদাঠাকুরের মত স্বনাধন্যরা। 'জলসাঘর' ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন উস্তাদ বিলায়েত খান সাহেব। বিখ্যাত সানাই-বাদক বিসমিল্লাহ খান ও হিন্দুস্থানী ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী বেগম আখতার অভিনয়ও করেন এই ছবিতে। শোনা যায়, এই ছবির জন্য যখন শ্যুটিং স্পট খুঁজছিলেন সত্যজিৎ রায়, সেইসময় লালগোলার এক চায়ের দোকান থেকে তিনি খোঁজ পা নিমতিতা রাজবাড়ির। একঝলকে দেখেই ভীষণ পছন্দ হয়ে যায় পরিচালকের। কলকাতায় ফিরে, চিঠিতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে সে কথা জানিয়েওছিলেন সত্যজিৎ। এই বাড়িতে 'সমাপ্তি' ছবির কিছু অংশেরও শ্যুটিং করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।


তথ্যসূত্র: 'একেই বলে শ্যুটিং'


লেখক: সত্যজিৎ রায়


 


আরও পড়ুন: Google on Loan Apps: ভারতে ৩৫০০ লোন অ্যাপকে 'নিষিদ্ধ' ঘোষণা গুগলের