India at 2047: চলতি বছরেই নেওয়া হয়েছিল সিদ্ধান্ত। ক্রিপ্টো কারেন্সির লাভে ৩০ শতাংশ কর আরোপ করেছিল সরকার। ক্রিপ্টো ছাড়াও নন-ফাঞ্জিবল টোকেন (NFTs)ও একই ধরনের সত্তাগুলিকে দেশে ভার্চুয়াল ডিজিটাল অ্যাসেটের (VDAs)অধীনে নথিভুক্ত করা হয়েছিল। এরপরই নেমে আসে আয়কের খাঁড়া। ১ এপ্রিল থেকে কঠোর কর ব্যবস্থা আরোপ করা হয় এই ভার্চুয়াল ডিজিটাল অ্যাসেটগুলির ওপর। প্রথমে মনে হতেই পারে, এটা সরকারের তরফে একটা কঠোর পদক্ষেপ। যদিও এর পিছনে রয়েছে অন্য ভাবনা। মূলত, ক্রিপ্টো কারেন্সির মতো অস্থির বাজারে বিনিয়োগের আগে আমানতকারীদের সতর্ক করতেই নেওয়া হয়েছে এই পদক্ষেপ।কম সময়ে বেশি রিটার্নের আশায় বিনিয়োগকারীরা যাতে নিজের সব অর্থ না হারান , সেদিকে নজর রাখতেই এই উদ্যোগ। এই অস্থির বাজারে বিনিয়োগের আগে ক্রিপ্টো সম্পর্কে 
সম্যক জ্ঞান থাকাটা খুবই জরুরি। সেই কারণেই এই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি এই কর আরোপের মাধ্যমে দেশে ক্রিপ্টো কারেন্সিকে সরাসরি নিষিদ্ধ না করে একপ্রকার বৈধতা দিয়েছে কেন্দ্র। এতদিন যারা দেশে ক্রিপ্টোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় ছিলেন এখন সেই ইনভেস্টার ও ট্রেডাররা চিন্তামুক্তভাবে এই ডিজিটাল অ্যাসেটে বিনিয়োগ করতে পারবেন।


প্রথমে দেখে নেওয়া যাক ভারতে ক্রিপ্টো কারেন্সির কর ব্যবস্থার চিত্রটি। পাশাপাশি বাইরের বিশ্বের সঙ্গে এর পার্থক্য ঠিক কোথায় , তাও জেনে 
নেব আমরা।


ভারতে ক্রিপ্টো লাভের উপর কত কর আরোপ করা হয় ?


২০২২-২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ভার্চুয়াল ডিজিটাল অ্যাসেটে (VDA)-তে একটি কর নীতির প্রস্তাব করেছিলেন। যেখানে বলা হয়েছিল, VDA বিক্রি থেকে প্রাপ্য সব লাভের ওপর 30 শতাংশ কর নেবে সরকার। মনে রাখবেন, এমন কোনও সীমা দেওয়া হয়নি, যার অধীনে VDA ট্যাক্স আরোপ করা হবে না। এর মানে দাঁড়াল, যদি একজন করদাতার মোট আয় ২.৫ লক্ষ টাকা সীমার নিচে হয়, তবে তাঁর লাভের পরিমাণও করযোগ্য হবে।


সবথেকে বড় বিষয়, VDA-র সব লেনদেনের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ টিডিএস (TDS)কাটা হবে। যা ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কেটে নিয়ে বিক্রেতাকে ক্রেডিট বা অর্থপ্রদান করবে।


কীভাবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের কর কাঠামোর তুলনা করা হয় ?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স বা মূলধন থেকে লাভের ওপর ট্যাক্স দিতে হয়। ঠিক যেমন কর আরোপ করা হয় স্টক বা শেয়ার বাজারের ওপর। ফেডারেল ট্যাক্স রেটের ক্ষেত্রে আমেরিকায় ক্রিপ্টোর ওপর (০-৩৭)শতাংশ কর নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আপনি যদি ১০০ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে ১২০ ডলার পান, তাহলে আপনার ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স দাঁড়াল ২০ ডলার।


ক্রিপ্টো নিয়ে একই ধরনের কর কাঠামো রয়েছে ব্রিটেনে। সেখানেও ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্সের পাশাপাশি GBP ১২৩০০ পর্যন্ত করমুক্ত ভাতা রয়েছে। 


কিছু দেশ আছে যেগুলিকে ক্রিপ্টোর 'স্বর্গরাজ্য' বলে বিবেচনা করা হয়। জার্মানিতে ক্রিপ্টোকারেন্সি মুদ্রা, পণ্য এমনকী স্টক হিসাবে বিবেচিত হয় না। এটি ব্যক্তিগত অর্থ হিসাবে বিবেচিত হয়। আপনি যদি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্রিপ্টোগুলির মালিক হন, তবে আপনার ট্যাক্স রিটার্নে সেগুলি দেখানোর প্রয়োজন নেই। এখানেই শেষ নয়, এর থেকে লাভ বা বিক্রয়ের লেনদেনও করমুক্ত৷ মনে রাখবেন, আপনি যদি ১২ মাসের মধ্যে আপনার ক্রিপ্টো বিক্রি করেন, তাহলে EUR 600 পর্যন্ত লাভ করমুক্ত হবে। অন্যদিকে, ক্রিপ্টো লাভের উপর কর্পোরেট আয়কর দিতে হবে।


একইভাবে, বারমুডায় ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলি থেকে আয়ে ক্যাপিটাল গেইন বা ভার্চুয়াল ডিজিটাল অ্যাসেটে অন্য কোনও ট্যাক্স দিতে হয় না।


ভারতে ক্রিপ্টো ট্যাক্স: নিয়ন্ত্রণ না সতর্কতা ?


কিছু দেশের তুলনায় ভারতের কর কাঠামো একটু বেশি নমনীয় মনে হতে পারে। একইভাবে কিছু দেশের সঙ্গে তুলনা করলে ভারতের ক্রিপ্টো ট্যাক্স বেশি কঠোর বলে মনে হবে। এরপরও ভারতে ক্রিপ্টো করের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের ক্রিপ্টো ব্যবসায়ী থেকে বিনিয়োগকারী সকলেই। একটা সময় ক্রিপ্টোকে দেশে নিষিদ্ধ করা হবে এমন জল্পনা তৈরি হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার এই ডিজিটাল অ্যাসেটে কর আরোপ করে বৈধতা দিয়েছে বলেই মনে করেন বিনিয়োগকারীরা।


এটা এখন স্পষ্ট যে, সরকার শীঘ্রই একটি সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি (CBDC) চালু করতে চাইছে, যা ভারতের ক্রিপ্টোপন্থী হওয়ার আরও একটি লক্ষণ। অনেকেই জানেন না CBDC আসলে ফিয়াট মুদ্রার ভার্চুয়াল ফর্মকে বোঝায়, যেমন ভারতের ক্ষেত্রে রুপি। এই লিগ্যাল টেন্ডার আরবিআই ডিজিটাল ফর্ম্যাটে জারি করবে। যেহেতু এটি দেশের সরকারি মুদ্রার একটি ডিজিটাল টোকেন হিসাবে বিবেচিত হবে, তাই এটি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আশা করা হচ্ছে, CBDC ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে সাপোর্ট করবে। পাশাপাশি এই নতুন ব্যবস্থা বিদ্যমান কাঠামোর পরিপূরক হবে।


এইসব বলার পরেও মানতে হবে, ভারতে ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির ওপর উচ্চ কর আরোপ করা হয়েছে। ভারতে ক্রিপ্টো করের হার অন্য যেকোনও অ্যাসেট ক্লাসের থেকে বেশি রাখা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে, ভারতে সিকিউরিটিগুলি দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভের ওপর ১০ শতাংশ ও স্বল্পমেয়াদি মূলধনী লাভের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে থাকে।


মনে রাখতে হবে, ক্রিপ্টো থেকে ৩০ শতাংশ কর কাটার পরও আপনি ছাড় পাচ্ছেন না। এরপরেও রয়েছে ১ শতাংশ টিডিএস। জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকেই কার্যকর হয়েছে এই করকাঠামো। ক্রিপ্টোর এই করের বিষয়ে বিশদে বুঝতে জুন থেকে 'ফ্রিকোয়েন্টলি আস্কড কোয়েশ্চন' (FAQ)-এর ব্যবস্থা করেছিল সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডিরেক্ট ট্যাক্সেস (CBDT)। 


কেউ কেউ এই উদ্যোগকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এই বিষয়ে ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ ইউনোকয়েনের সিইও ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাত্বিক বিশ্বনাথ বলেন, “আমরা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে টিডিএস নিয়ে যেভাবে সরকার চিন্তাভাবনা করছিল, তার ব্যবহারিক সমস্যাগুলি ব্যাখ্যা করেছিলাম। এর কার্যকর সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সরকার আমাদের কথার মান রেখেছে। মন্ত্রক টিডিএস-এ তথ্য ও অর্থ সংগ্রহের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম হিসাবে আমাদের নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। আমি একে ক্রিপ্টো সম্প্রদায়ের জন্য একটি ছোট জয় হিসাবে দেখছি। আমরা অন্যান্য বিভাগ থেকেও এই ধরনের সদর্থক পদক্ষেপের আশায় রয়েছি।"


ক্রিপ্টো ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম weTrade-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্ত কুমার, ABP লাইভকে বলেন, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে TDS-এর ১০০ শতাংশ বোঝা তুলে নেব। TDS কাটার সমান ইনস্ট্যান্ট ক্যাশব্যাক দেওয়া হবে গ্রাহকদের, যাতে তাঁদের পক্ষে এই নিয়ম মেনে চলা আরও সহজ হয়। weTrade আসলে ক্রিপ্টো বিনিয়োগকে সহজ ও ফলপ্রসূ করে তোলে। এটিকে একটি TDS-মুক্ত প্ল্যাটফর্মে পরিণত করার মাধ্যমে গ্রাহকদের আরও ভালবাসা পাব আমরা।”


তিনি এই প্রসঙ্গে যোগ করেন, “আমরা weTrade-এ VDA-তে TDS-এর বিষয়ে যে স্পষ্টীকরণ অর্থমন্ত্রক দিয়েছে, তা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। সরকারের এই উদ্যোগ ইতিবাচক। এর মাধ্যমে ক্রিপ্টো বিনিয়োগে আরও স্বচ্ছতা আসবে। পাশাপাশি সহজেই বিনিয়োগের জায়গা সম্পর্ক জানা যাবে।নিয়ন্ত্রকদের সহায়তায় দীর্ঘমেয়াদে এটি ভিডিএ-র বিকাশে সাহায্য করবে।"


এই বলেই অবশ্য থেমে থাকেননি কুমার।তিনি জানান, সরকারের এই পদক্ষেপ "বিশেষভাবে প্রশংসনীয়"। এর ফলে সাধারণ আমানতকারীদের বিনিয়োগ করার সময় ঝামেলা পোহাতে হবে না। ১ শতাংশ টিডিএস কেবল বিক্রি করার সময় প্রযোজ্য, যা পরের বছরের ফাইলিংয়ে দাবি করা যাবে।


সর্বপরি বলা যায়, দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে এখনও ক্রিপ্টো সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অভাব রয়েছে। বর্তমানে KYC, মোবাইল অ্যাপে এক্সচেঞ্জ, ওয়ালেট ও সরকারি আইডি প্রমাণ থাকার ফলে বিনিয়োগকারীদের কাছে ক্রিপ্টোতে ইনভেস্ট করা খুব সহজ হয়েছে। সেই কারণে ক্রিপ্টোতে বেশি ট্যাক্স কাটের পথে হেঁটেছে সরকার। মূলত, ভিডিএ-তে অর্থ রাখার আগে যাতে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশিত রিটার্নের বিষয়টা বিশদে বুঝে নেন, সেই কারণেই এই সরকারি সতর্কতা।