রাদিফা কবীর, নয়াদিল্লি: 'ভারতকে উপর থেকে কেমন দেখতে লাগে?' প্রশ্ন করলেন প্রধানমন্ত্রী। 'নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সারে জাঁহা সে আচ্ছা',জবাব দিয়েছিলেন ভারতের প্রথম নভোচর রাকেশ শর্মা। সালটা ১৯৮৪। সোভিয়েত ইন্টারকসমস প্রকল্পের আওতায় সয়ুজ-টি১১ মহাকাশযান থেকে রাকেশ শর্মার সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর এই কথোপকথন এখন সব অর্থেই ইতিহাসের দলিল। তবে ভারতের মহাকাশ-গবেষণা যে শুধু এই কথোপকথনে থেমে থাকেনি, তার প্রমাণ একের পর পর প্রকল্প। সাফল্য-ব্যর্থতা মিলিয়ে তা হইহই করে চলছে।


ফিরে দেখা...
১৯৬৪ সাল। মার্কিন উপগ্রহ 'Syncom-3'-র সৌজন্যে  টোকিও অলিম্পিক্সের সরাসরি সম্প্রচারের সাক্ষী থাকলেন অনেকে। ভারতের মতো দেশের নানা সমস্যার সমাধানে যে এই ধরনের  মহাকাশ-প্রযুক্তি দুরন্ত কাজ দিতে পারে সে কথা সে সময়ই মাথায় এসেছিল বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের। এর ঠিক বছরপাঁচেক পর, ১৯৬৯ সালের আগস্টেই তৈরি হয় ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ইসরো। তার পর মোটে ছবছর। শুরু হয় ভারতের প্রথম উপগ্রহ প্রকল্প। পরীক্ষামূলক ভাবে  প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে দেশ। নাম 'আর্যভট্ট'। সেই শুরু। তার পর থেকে Satellite Instructional Television Experiment (SITE), Rohini সিরিজ, INSAT এবং GSAT সিরিজ, EDUSAT, HAMSAT, Bhaskara-1, Resourcesat সিরিজ, Cartosat সিরিজ, Kalpana-1, Oceansat-1, Earth Observation Satellite সিরিজ, Indian Regional Navigation Satellite System, Space Recovery Experiment Satellite, SARAL, চন্দ্রযান-1, Mars Orbiter Mission বা মঙ্গলযান, AstroSat এবং চন্দ্রযান ২-র মতো  একের পর এক মহাকাশ গবেষণা প্রকল্পে ভরসা রেখে এগিয়ে চলেছে ইসরো।


'অনন্তে' ভারতের ভবিষ্য়ৎ...
 ভাবছেন এতেই শেষ? আজ্ঞে না। ইসরোর তালিকায় এখনও আরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আদিত্য এল-১ (Aditya L1), চন্দ্রযান-৩ (Chandrayaan-3) গগনযান ১ (Gaganyaan 1), গগনযান ২ (Gaganyaan 2), গগনযান ৩ (Gaganyaan 3), শুক্রযান ১ (Shukrayaan-1), মঙ্গলযান ২ (Mangalyaan-2), লুনার পোলার এক্সপ্লোরেশন মিশন বা লুপেক্স (LUPEX) ইত্যাদির মতো দুরন্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চলেছে ইসরো। একঝলকে দেখে নেওয়া যাক অভিযানগুলির খুঁটিনাটি।


আদিত্য এল-১
সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য ভারতের মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এটিই প্রথম অভিযান হতে চলেছে। যা ঠিক হয়েছে, তাতে ৪০০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হবে। এটির কাজ হবে সূর্যের সবচেয়ে বাইরের স্তর 'করোনা'-র বেশ কিছু দিক পর্যবেক্ষণ করা। ২০২২-এই প্রকল্পটি শুরু হওয়ার কথা।    


চন্দ্রযান-৩
চাঁদের খুঁটিনাটি বুঝতে ইসরোর তৃতীয় অভিযান এটি। মূলত চন্দ্রযান-২-র কাঠামোই রাখা হচ্ছে। ২০১৯ সালে বিক্রম ল্যান্ডার যেখানে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছিল,চন্দ্রযান-৩-ও চাঁদের সেই দক্ষিণ মেরুকেই পাখির চোখ করেছে। তবে এতে কোনও অরবিটার থাকবে না।  ২০২২-র আগস্টে প্রকল্পটি শুরু হওয়ার কথা।


গগনযান ১ 
মহাকাশে নভোচর পাঠানোর নিরিখে ইসরোর প্রথম অভিযান গগনযান। এর মধ্যে গগনযান ১ প্রথম পরীক্ষামূলক সফর। তিন জন মহাকাশচারী নিয়ে যেতে পারে এমন একটি মহাকাশযান পাঠানো হবে এই ধাপে। তবে এই ধাপে কোনও নভোচর থাকবেন না। 
২০২২ সালের শেষে মহাকাশযানটি পাঠানোর কথা। 


গগনযান ২ 
এটিও ২০২২-র শেষেই হওয়ার কথা। তবে এই মহাকাশযানে করে রোবট 'ব্যোমিত্র'-কে পাঠানো হবে। প্রথম মহাকাশচারী পাঠানোর আগে স্পেসক্রাফটের খুঁটিনাটি বুঝে নেওয়াই লক্ষ্য এর।


নিসার...
এটি নাসা এবং ইসরোর যৌথ প্রকল্প। ভূপৃষ্ঠের যে রদবদল হচ্ছে, তার কারণ ও পরিণাম বুঝতে অত্যাধুনিক রেডার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে NASA-ISRO Synthetic Aperture Radar বা নিসার নামে এই অভিযানে। ২০২৩ সালে অভিযান শুরু হওয়ার কথা।


গগনযান ৩
২০২৩ সালে শুরু হওয়ার কথা এটি। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য নভোচরদের বেছে নেওয়া হবে। সব ঠিকঠাক চললে এঁদের মধ্যে থেকে যাঁরা চূড়ান্ত নির্বাচিত হবেন তাঁদেরই মহাকাশে পাঠানো হবে।  এতে সাফল্য এলে কোনও সাহায্য ছাড়া মহাকাশচারী পাঠানোর নিরিখে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হবে ভারত।  


এছাড়াও শুক্রগ্রহের পৃষ্ঠ ও পরিমণ্ডল পর্যবেক্ষণের জন্য শুক্রযান-১-র পরিকল্পনা করা হয়েছে। ২০২০৪-র ডিসেম্বরে অভিযানটি শুরু হওয়ার কথা। রয়েছে দ্বিতীয় মঙ্গলযান পাঠানোর ভাবনাও। সম্ভবত ২০২৫-এ সেটি শুরু হবে। সব মিলিয়ে মহাকাশের খুঁটিনাটি জানতে তৈরি ইসরো। লক্ষ্যও স্থির। এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা।
কে বলতে পারে হয়তো স্বাধীনতার একশো বছরে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আর এক মহাকাশচারীর কথোপকথন নতুন ইতিহাস গড়বে না?