সোমেশ ঝা : নজরে ডিজিটাল অর্থনীতি। চলতি বছরেই ভারত নিজস্ব সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি (CBDC) চালুর পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে। আর এর সাথে সাথে বিশ্বের একাধিক দেশের সঙ্গে ডিজিটাল মুদ্রা চালুর দৌড়ে নেমে পড়েছে ভারত। যদিও নীতি-নির্ধারকদের এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি। কারণ, এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় এখনও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। যা দেখা হয়ে গেলে তবেই যথার্থ আকার দেওয়া যাবে CBDC-র। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ দেশে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি সূচনার ঘোষণা করেছিলেন। 'ডিজিটাল রুপি' হিসেবে সম্বোধন করে অর্থমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, চলতি অর্থবর্ষে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃক এর সূচনা দেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করবে। কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আরও সুদক্ষ ও সস্তা হয়ে উঠবে।
কিন্তু কী এই CBDC ?
RBI বলছে, CBDC হল "ডিজিটাল আকারে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ইস্যু করা একপ্রকার আইনি টেন্ডার। অনেকটা ফিয়েট কারেন্সির (সরকার কর্তৃক ইস্যু করা মুদ্রা যার সোনা বা রুপোর মতো আকার নেই, বরং সরকার এটা ইস্যু করে) মতো। তাছাড়া ফিয়েট কারেন্সির সঙ্গে বিনিময়যোগ্য।" সাধারণভাবে বলতে গেলে, CBDC জাতীয় মুদ্রার থেকে আলাদা নয়। তবে শুধুমাত্র ডিজিটাল আকারে রয়েছে। কাজই, ক্রিপ্টোকারেন্সির বিপরীতে, CBDC-র মূল্য সময়ের সাথে ওঠানামা করবে না।
আরও পড়ুন ; ভারতে ক্রিপ্টো কর ! নিয়ন্ত্রণের আড়ালে সতর্কতার বার্তা ?
তবে নিয়মিত ডিজিটাল লেনদেন এবং CBDC-এর মধ্যে এখনও একটি মূল পার্থক্য রয়েছে যা ডিজিটাল রুপিকে আলাদা করবে। ইউনাইটেড পেমেন্ট ইন্টারফেস (ইউপিআই) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে করা ডিজিটাল লেনদেন যেমন- BHIM, Google Pay বা PhonePe-র সঙ্গে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের ব্যবহার জড়িত। অনলাইন লেনদেন করার জন্য ব্যবহারকারীদের তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলিকে UPI-এর সাথে লিঙ্ক করতে হবে, তা সে দাম মেটাতে হোক বা টাকা ট্রান্সফার করা...সব ক্ষেত্রেই।
যদিও CBDC-তে ব্যাঙ্কিং সিস্টেম জড়িত থাকবে না এবং এটির আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক অর্থাৎ ভারতের ক্ষেত্রে আরবিআই-এর উপর সরাসরি দাবি থাকবে।
কেন CBDC-র পিছনে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ?
শুধু ভারতই CBDC-র পিছনে পড়ে নেই। গোটা বিশ্বজুড়ে প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যাঙ্ক CBDC-র জন্য নেমে পড়েছে। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ হয় ডিজিটাল মুদ্রার বিকাশের চেষ্টা করছে বা একদম পাইলট প্রোজেক্ট চালুর জায়গায় আছে। ব্যাঙ্ক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টের সার্ভেতে দেখা গেছে, গত এক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির নিজস্ব CBDC বিকাশের হার দ্বিগুণ হয়েছে। ভারত-সহ এই দেশগুলির CBDC আনার উদ্যোগ আগের থেকে আরও বেড়েছে কারণ-ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্রমবর্ধমান উত্থান। মূলত গত কয়েক বছরে স্টেবলকয়েনের উত্থান। তাছাড়া প্রাইভেট ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্রমবর্ধমান বাজার অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। এটি সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলিকে একমাত্র মুদ্রা প্রদানকারী সংস্থা হয়ে ওঠার রাস্তায় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই, CBDC-কে প্রতিরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে নিচ্ছে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলি।
Stablecoins-এর কাছে 'পথের কাঁটা' নয় ক্রিপ্টো-
উন্নত অর্থনীতির বিশ্বব্যাপী ধারণা (প্রায় এক-দুই বছর আগে) ছিল যে (সেখানে) এই পর্যায়ে CBDC-এর ব্যবহার খুব বেশি নয়। সাধারণ ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম এমন কিছুই অর্জন করতে পারে না যা CBDC করতে পারে। কিন্তু স্টেবলকয়েনের সূচনার সাথে এটি মূলত পরিবর্তিত হয়েছে।” এপ্রিল মাসে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যানশনাল ইকোনমিক রিলেশনস-কর্তৃক আয়োজিত একটি ওয়েবিনারে এই মন্তব্য করেন আরবিআইয়ের ডেপুটি গভর্নর টি রবি শঙ্কর।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগত ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলি মুদ্রা হিসাবে কাজ করার ক্ষেত্রে খুব পরিবর্তনশীল ছিল, তাদের স্টেবলকয়েনের মতো 'গুরুতর হুমকি' হিসাবে দেখা হয়নি। এখানেই স্টেবলকয়েন, যেমন নাম থেকেই বোঝা যায়, মূল্যের স্থিতিশীলতা প্রদান করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। Tether এবং ইউএসডি কয়েন সহ স্টেবলকয়েনগুলির লক্ষ্য হল - মার্কিন ডলারের মতো অন্য সম্পদের মূল্য বা সোনার মতো একটি পণ্যের সাথে সংযুক্ত হয়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ডিজিটাল লেনদেনের জন্য ভারতে ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা রয়েছে। এজন্য UPI প্রবর্তনকে ধন্যবাদ৷
উপভোক্তাকে কীভাবে সাহায্য করবে CBDC ?
সুতরাং, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠছে, যদি UPI যা ডিজিটাল পেমেন্টের সাফল্যের ভিত্তি (ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়), তাহলে CBDC কীভাবে গ্রাহকদের জীবন পরিবর্তন করবে ?
সিনিয়র রেসিডেন্ট ফেলো এবং আইনি নীতির জন্য বিধি সেন্টারের ফিনটেক লিড শেহনাজ আহমেদ বলেছেন, “ইউপিআই অবশ্যই সবচেয়ে বড় ডিজিটাল পেমেন্ট পরিকাঠামো। কিন্তু CBDC তার উদ্ভাবনী মডেলের মাধ্যমে সেই জায়গাকে প্রতিযোগিতার দিকে নিয়ে যাবে। এটি ব্যবহারকারীদের কাছে অন্য যে কোনও ডিজিটাল পেমেন্ট পরিষেবার মতো মনে হবে । কিন্তু যেহেতু CBDC কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সরাসরি দায়বদ্ধতা হবে, তাই এটি আরও নিরাপদ হবে এবং ব্যাঙ্ক ডিপোজিটের মাধ্যমে অর্থ রাউটিং করার সময় যে কোনও ধরনের ডিফল্টের উপর নির্ভর করবে না।
২০১৮-২০১৯ সালের RBI সমীক্ষা অনুসারে, ডিজিটাল লেনদেনের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার সত্ত্বেও নগদ টাকা এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার কাছে অর্থ প্রদানের পছন্দের মাধ্যম। এখানেই CBDC নগদের প্রকৃত ডিজিটাল সংস্করণ হিসেবে কাজ করতে পারে।
যেহেতু সিবিডিসিগুলিকে ব্যাঙ্কিং চ্যানেলের মাধ্যমে রুট করা হবে না, তাই এটি বেনামে হতে পারে যা নগদের ক্ষেত্রেও হয়, বিশেষ করে ছোটখাট লেনদেনের জন্য। এবং সেই অর্থে, এটি আরবিআইকে মুদ্রা নোট ছাপানো এবং বিতরণের খরচ কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে, RBI ডিজিটাল রুপির ক্ষেত্রে বেনামির সমস্যাটি খতিয়ে দেখছে।
CBDC নিয়ে সবথেকে উদ্বেগের কারণ কী ?
সিবিডিসি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভয়: ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার উপর নির্ভরতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। এর মানে হল যে, গ্রাহকরা তাদের টাকা তাদের CBDC ওয়ালেটে রাখতে শুরু করবে এবং ব্যাঙ্কের আমানত থেকে তুলতে থাকবে। যদি ব্যাঙ্কগুলি আমানত না পায়, তবে ব্যবসা এবং উপভোক্তাদের অর্থ ধার দেওয়ার ক্ষমতাও হ্রাস পাবে এবং এটি অর্থনীতি এবং ব্যাপকভাবে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
কিন্তু আহমেদ বলেছিলেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সিবিডিসি লেনদেনে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিলেও, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে মধ্যস্থতাকারী করা যেতে পারে - একটি মডেল যা কিছু দেশ এখনই পরীক্ষা করছে।
এখনও পর্যন্ত বাহামা ২০২০ সালে তার CBDC, স্যান্ড ডলার চালু করার ক্ষেত্রে প্রথম দেশ হয়ে উঠেছে, তারপরে ২০২১ সালে নাইজেরিয়া (eNaira)। পূর্ব ক্যারিবিয়ান এবং চিন তাদের CBDC-এর পাইলট সংস্করণ চালু করেছে। এই দেশগুলিতে, মুদ্রা ডিজিটাল ওয়ালেটে সংরক্ষণ করা হয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি একটি স্তরভিত্তিক-ওয়ালেট ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর মানে হল যে, কম-মূল্যের লেনদেনগুলি বেনামি হবে এবং কঠোর KYC নিয়ম মেনে চলার প্রয়োজন নেই ৷ কিন্তু একবার পেমেন্ট একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অতিক্রম করলে, লেনদেন ট্র্যাক করা যেতে পারে। দৈনন্দিন লেনদেনেরও কিছু নির্দিষ্ট সীমা রয়েছে। আর্থিক তছরুপ এবং কালো টাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটি করা হয়।
ভারতের ক্ষেত্রে, আপাতত, আরবিআই ডিজিটাল রুপির সম্পূর্ণ লঞ্চে যাওয়ার আগে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে এবং পর্যায়ক্রমে পাইলট প্রোজেক্ট চালু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। RBI ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের জন্য বা দুই দেশের মধ্যে ক্রস-কান্ট্রি লেনদেনের জন্য CBDC-এর ব্যবহারও খুঁজছে, যা পাইকারি CBDC নামে পরিচিত। এটি লেনদেন নিষ্পত্তির সময় কমাতে সাহায্য করতে পারে। কারণ একবার CBDC-এর মাধ্যমে স্থানান্তর হয়ে গেলে, এটি অবিলম্বে এবং লেনদেন সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কার্যকালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। তবে এর জন্য দেশগুলিকে অনুরূপ প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে হবে। আরবিআই গভর্নর শক্তিকান্ত দাস ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক একটি সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে। CBDC-এর ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের উন্নয়নের উপর নজর রাখবে।