রঞ্জিত কুমার: এখনও সম্পূর্ণ ভাবে নোভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপমুক্ত হয়নি বিশ্ব। তার মধ্যেই যুদ্ধের আবহ তৈরি হয়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছেই। তার উপর তাইওয়ানের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে চিনও। এমন পরিস্থিতিতে মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের সূচিতেও রদবদল চোখে পড়ছে। সন্তর্পণে হলেও, তাতে ভারতের উত্থান চোখে পড়ার মতো। ব্রিকস হোক বা শাংহাই সহযোগিতা গোষ্ঠী, অথবা ভারত মহাসাগরে অধিপত্য বজায়ের চতুর্দেশীয় কৌশল, সবক্ষেত্রেই মধ্যমণি হয়ে উঠছে ভারত। তাই বিশ্বগুরু হওয়ার দৌড়ে ভারত বিশেষ পিছিয়ে নেই বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। 


বিশ্ব অর্থনীতিতে আমেরিকা এবং পশ্চিমি দেশগুলির আধিপত্য রুখতে জন্ম ব্রিকস-এর। রাশিয়া, চিন, ভারত, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার যৌথ উদ্য়োগে এর প্রতিষ্ঠা চলতি সহস্রাব্দের প্রথম দশকে। যত সময় এগিয়েছে, তাতে গুরুত্ব বেড়েছে ভারতের। চিনা আগ্রাসন রুখতে আমেরিকা, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চতুর্দেশীয় কৌশলেরও অন্যতম প্রধান মুখ ভারত। পুরনো সম্পর্কের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকেই সব ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিচ্ছে ভারত। তাতেই ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের অভূতপূর্ব উত্থান চোখে পড়ছে। 


নিরপেক্ষ থেকে কৌশলী হওয়ার দিকেই ঝুঁকছে ভারত


ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি ভারতের জন্য কৌশলগত সম্পর্ক উন্নত করার রাস্তা খুলে দেয়। ফলে প্রতিপক্ষ দেশের সঙ্গেও সংযোগ বাড়ে।  ১০ সদস্য রাষ্ট্রের আসিয়ান (ASEAN) সংগঠন হোক বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্য এশিয়া হোক বা উপসাগরীয় অঞ্চল অথবা আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বাণিজ্য ক্ষেত্র, সব ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণ ভারতের। একদিকে আমেরিকার সঙ্গে যেমন সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সফল ভারত, তেমনই সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আমেরিকার প্রতিপক্ষ রাশিয়ার সঙ্গেও কৌশলী সম্পর্ক টিকিয়ে রাখায় সাফল্য মিলেছে। 


আবার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, ভারতের বাজারে পশ্চিমি প্রযুক্তি, সরঞ্জাম এবং সামগ্রীর চাহিদার কথা মাথায় রেখে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী তাবড় শক্তিশালী রাষ্ট্র। ৩ লক্ষ কোটির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়ে ফেলে আমেরিকা, চিন, জাপান, জার্মানি এবং ব্রিটেনের পর এই মুহূর্তে ভারতই বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি। আমেরিকার মতো দেশ তাই ভারতের সঙ্গে কৌশলী সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। 


ঠান্ডা যুদ্ধ আমেরিকা এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ করে তুলেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা অধুনা রাশিয়ার সঙ্গে বরাবরই ভাল সম্পর্ক ভারতের। স্বাধীনতার সময় থেকেই নানা ভাবে ভারতের পাশে থেকেছে তারা। নয়ের দশকের শুরুতে তাদের প্রতিপক্ষ আমেরিকাও ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটায়। মালাবার উপকূলে ভারতের সঙ্গে যৌথ মহড়ার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার সূচনা ঘটে। ১৯৯২-এর মালাবার উপকূলের মহড়ার মাধ্যমে যার সূচনা ঘটেছিল, বর্তমানে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সেই সামরিক সহযোগিতা বজায় রয়েছে ভারত মহাসাগরে। তাতে যুক্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মতো দেশও, যা চতুর্দেশীয় কৌশল সংগঠন (QUAD) নামে পরিচিত। ভারত মহাসাগরে চিনের সম্প্রসারণবাদ এবং আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা প্রতিহত করতেই এই পারস্পরিক সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ। অর্থনীতিবিদদের অনুমান, ২০৪৯-এর মধ্যে বিশ্বের মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকাকে ছাপিয়ে যাবে চিন। তাই চিনের বিরুদ্ধে আরও বেশি করে ভারতকে পাশে চাইছে আমেরিকা।


ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ যাবৎ নিরপেক্ষ ভূমিকাই পালন করে এসেছে ভারত। কোনও পক্ষপাত ছাড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উন্নতি ঘটিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতেই লিপ্ত থেকেছে। তাই শাংহাই সহযোগিতা, ব্রিকস থেকে চতুর্দেশীয় সহযোগিতা গোষ্ঠী, সবক্ষেত্রেই উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি আমেরিকা, ইজরায়েল এবং সংয়ুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে I2U2 গোষ্ঠীরও অংশ হয়ে উঠেছে ভারত। কূটনৈতিক ভাবে চিনকে কোণঠাসা করতেই এই গোষ্ঠীর পত্তন বলে মত কূটনীতিবিদদের। তাতে ভারতের অন্তর্ভুক্তি তাদের বৈশ্বিক গুরুত্বেরই প্রমাণপত্র বলে মনে করা হচ্ছে। 


অতিমারি স্তিমিত হওয়ার পর পরই রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। তাতে গোটা বিশ্ব দুই ভাবে বিভক্ত। পরিবর্তনসীল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে কেউ রাশিয়াকে সমর্থন করছে, কেউ আবার ইউক্রেনকে। চিন যেমন কোনও রাখঢাক না করেই রাশিয়ার পাশে দাঁডি়য়েছে। আমেরিকা, জাপান, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ আবার ইউক্রেনের পাশে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইতি টানার পক্ষে সওয়াল করলেও, রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপুঞ্জে ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে ভারত। কিন্তু তাতে ফাঁপরে পড়েছে দুই পক্ষই। সকলেই চাইছে ভারত কোনও একটি পক্ষ নিক। ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের গুরুত্ব যে ক্রমশ বাড়ছে, তা স্পষ্ট। 


২১ শতকের প্রথম দশকে রাশিয়া-চিন দুই দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে দেখা যায় ভারতকে। একই সঙ্গে আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক ঘষেমেজে নিতে দেখা যায়। ফলে পরমাণু শক্তি পরীক্ষা করে কোণঠাসা হয়ে পড়া ভারতের পাশে থাকতে ২০০৮ সালে ইন্দো-মার্কিন পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করে আমেরিকা। এই চুক্তির ফলে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের সূচিতে পাকাপাকি জায়গা করে নেয় ভারত।


আবার আমেরিকা তথা পশ্চিমি দেশের আধিপত্য রোখার ব্রিকস গোষ্ঠীর অংশ হলেও, আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কৌশলী পদক্ষেপে দিনে দিনে সম্পর্ক মজবুত করে ফেলেছে ভারত। দক্ষিণ চিন সাগরে ড্রাগনের চোখ রাঙানি, লাদাখে তাদের আগ্রাসনের ফলে ব্রিকস-এর অংশ হয়েও চিনের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে ভারত। তাতে ব্রিকস-এর অন্দরেও প্রভাব পড়েছে। গোড়ার দিকে নিয়মিত এই গোষ্ঠীর সম্মেলনে অংশ নিলেও, পাশাপাশি আমেরিকা, ইজরায়েল, ইউরোপ এবং আসিয়ান দেশগুলির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক মজবুত করে নিয়েছে ভারত। শুধু আমেরিকাই নয়, ইউরোপে তাদের মিত্র দেশ বলে পরিচিত ফ্রান্স, ব্রিটেনের পাশাপাশি, পূর্ব এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী দেশগুলির সঙ্গেও সুসম্পর্ক ভারতের। ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতিপক্ষ সব গোষ্ঠীই ভারতকে পাশে পেতে আগ্রহী। তবে কোনও দিকে না ঝুঁকে এখনও পর্যন্ত ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে ভারত।


জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য ভারতের


রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে এই নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়ে ভারত। সার্বভৌম দেশ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে এ বছর ফেব্রয়ারি মাসে যুদ্ধ ঘোষণা করে রাশিয়া। ফলে আমেরিকার মতো রাশিয়া-বিরোধী দেশগুলি ভারতকে পাশে পেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। কিন্তু নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেই ভারত জানিয়ে দেয়, ইউক্রেনের সার্বভৌমিকতা অধিকারকে সম্মান করলেও, রাশিয়ার সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক কিছুতেই নষ্ট করা সম্ভব করা নয়। কারণ বিপেদ আপদে এ যাবৎ ভারতের পাশে থেকেছে রাশিয়া। পড়শি দেশ চিন এবং পাকিস্তানের মোকাবিলায় অস্ত্রশস্ত্রের ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল ভারত। তাই এই অবস্থানে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের মিত্রতা অক্ষুণ্ণ রইল। 


প্রায় ৫৪০ কোটি ডলারের বিনিময়ে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনা নিয়ে এর আগে ভারতের উপর চাপপ সৃষ্টি কের আমেরিকা। ওই চুক্তি বাতিলের জন্য কার্যত হুঁশিয়ারিও দেয়। তাও পিছু হটেনি ভারত। তার পরেও I2U2 গোষ্ঠীতে ভারতের অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আমেরিকা। ফলে পশ্চিম এশিয়াতেও ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে। ইসলামি দেশগুলিতে চিনের অতিরিক্ত দখলদারিতে ইতি টানাই এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য। 


আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে ভাবে পট পরিবর্তন ঘটছে, তাতে চতুর্দেশীয় গোষ্ঠী হোক বা I2U2, ভারত সকলের বন্ধু হয়ে উঠেছে। তাই ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে, দক্ষিণ চিন সাগরে এবং ৩ হাজার ৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে চিনা আগ্রাসন হোক বা পাকিস্তান সরকার মদতপুষ্ট সন্ত্রাস, দুইয়ের মোকাবিলাতেই আমেরিকা-সহ অন্য দেশগুলিকে পাশে পেতে পারে ভারত। তাইওয়ানকে সম্প্রতি যে ভাবে ঘিরে ধরতে শুরু করেছে চিন, তাতে আমেরিকার সঙ্গে তাদের সংঘাত আরও বেড়েছে। ফলে চিন বিরোধী গোষ্ঠীগুলিতে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ম হয়ে উঠতে চলেছে। 


বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনশীল এই পরিস্থিতিই ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী ক্ষমতাশীল রাষ্ট্রের সূচিতে রদবদল ঘটাছে। তবে আদর্শগত অবস্থান নয়, কৌশলী সমীকরণই এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে।  জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে সেই ভাবেই এগোচ্ছে ভারত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব, শত্রুতা, কোনও কিছুই স্থায়ী নয়। যদি কিছু স্থায়ী হয়, তা হল জাতীয় স্বার্থ।  দেশের অর্থনীতি, বাজার এবং সামরিক শক্তিকে সামনে রেখে সেই স্বার্থসিদ্ধির ক্ষমতা রয়েছে ভারতের। একই সঙ্গে বিশ্বশান্তি, সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের যোগ্যতা রয়েছে। 


 


আরও পড়ুন: India at 2047: খাদের কিনারা থেকে দেশকে তুলে আনতে পারবেন রনিল! কোন পথে শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ