ব্যক্তিগত তথ্যের ভান্ডার আদতে একটি সোনার খনি। ডিজিটাল দুনিয়ায় বৃহৎ সংস্থাগুলি সেই তথ্য নানা ভাবে ব্যবহার করে। যা অনেকসময়েই অনুচিত। অনেক সময়েই বড় বড় সংস্থাগুলির তথ্যভান্ডার ফাঁস হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া ব্যক্তিগত তথ্য নানাভাবে বিপজ্জনক কাজে ব্যবহার হতে পারে।
ইদানিং কালে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস বা Privacy Breach-এর যে ঘটনা ঘটছে। তা মূলত ডেটা ব্রোকার, বিজ্ঞাপনদাতা, সার্চ ইঞ্জিন, সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মকে কেন্দ্র করেই ঘটছে। কারণ এদের হাতের মুঠোয় থাকে উপভোক্তা, গ্রাহকের যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য। জন্মদিন থেকে বিবাহবার্ষিকী, পছন্দের খাবার থেকে বাড়ির সন্তান কোন স্কুলে পড়ে- সব তথ্যই মেলে। ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও বিপজ্জনক। কারণ ভারতের নাগরিকদের একটি বড় অংশ তথ্য়ফাঁস থেকে কী বিপদ হতে পারে সেই বিষয়ে অজ্ঞ। এখনও ডিজিটাল দুনিয়ার নানা বিপদ সম্পর্কে ঠিকমতো জানা নেই ভারতীয় নাগরিকদের একটি বড় অংশের।
দেশে এখন ফাইভ-জি পরিকাঠামো এসে গিয়েছে। অমৃত কাল অর্থাৎ ২০২২ থেকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত ডিজিটাল দুনিয়ায় বড় কোনও পদক্ষেপের জন্য বড়সড় লক্ষ্যও নিয়েছে ভারত। সেই আবহে ভারতের প্রয়োজন এমন একটি কৌশল যা স্বাধীন। যে পরিকল্পনার পুরোটাই তৈরি হওয়া উচিত ভারতীয়দের দ্বারা। যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষিত রাখা যাবে।
তথ্য সুরক্ষা করতে চাই একাধিক পদক্ষেপ:
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে বিপদের আশঙ্কার নানা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল ডিজিটাল মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে যেভাবে ব্যক্তিগত তথ্য় দেওয়ার ধরন। যেভাবে বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া হয় তাতে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এই বিপদ এড়াতে আমাদের একটি নির্দিষ্ট ডিজিটাল পরিচয় চাই যেটা নেটদুনিয়ার সব জায়গায় ব্যবহার করা যাবে। এর জন্য ভারত সরকারের এমন একটি ডিজিটাল আইডেন্টিটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা উচিত। যার মাধ্যমে যাবতীয় নিরাপত্তা স্তর মানা হবে এবং নিয়ন্ত্রণ থাকবে। সেই ডিজিটাল আইডেন্টিটি প্ল্যাটফর্ম এমন হতে হবে যা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা সব কাজে ব্যবহার করতে পারবে। টিকিট বুক করা হোক, বিমা কেনা হোক, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার কাজ কিংবা আয়কর দাখিল করা।
এরকমই একটি উদ্যোগ হল ডিজি-লকার। DigiLocker linked single-sign-on technology এনেছে ভারত সরকার। কিন্তু তাতেও নানারকম সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নাগরিকরা এই প্ল্যাটফর্মে তখনই রেজিস্টার করতে পারে যখন তাঁর কাছে একটি মোবাইল নম্বর ও ই-মেল আইডি থাকে এবং সেগুলি আধার কার্ডের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। কিন্তু ভারতে অধিকাংশ নাগরিকই ই-মেল ব্যবহার করে না। আমাদের এরই একটি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
ডিজিটাল সাক্ষরতা, সচেতনতা এবং আইনি কবচ:
আমরা প্রায় সবকিছুর জন্যই ইন্টারনেটের উপর এতটাই নির্ভরশীল যে আমাদের ব্য়ক্তিগত তথ্য নেটদুনিয়ায় ফাঁস হওয়ার ঝুঁকিও অনেক বেশি। সচেতনতা এবং ডিজিটাল শিক্ষা এতটাই কম যে নাগরিকদের একটি বড় অংশ জানেনই না যে তাঁরা কীভাবে বিপদের মধ্যে রয়েছেন।
'অমৃত কালে'র সময়ে ভারতকে ডিজিটাল সচেতনতা এবং ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার বাড়াতে হবে। যাতে নাগরিকরা নতুন যুগের পরিকাঠামো সহজেই ব্যবহার করতে পারে। স্কুল, গণমাধ্যমের সাহায্যে এই কাজ করা যেতে পারে।
পাশাপাশি দেশে এমন আইন তৈরি করা উচিত যাতে তথ্যের সুরক্ষা মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত হয়। ব্যক্তিগত তথ্য় যাতে সুরক্ষিত থাকে তার জন্য তথ্য় সুরক্ষা আইন কড়াভাবে বলবৎ করা উচিত। আইনে এমন জায়গা রাখা উচিত যাতে কোনও সংস্থা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য় ভুলভাবে ব্যবহার করলে অথবা তাঁদের হাতে থাকা ব্যক্তিগত তথ্যকে সুরক্ষিত না রাখতে পারলে মোটা জরিমানার মুখে পড়ে। এই কাজের জন্য Data Protection Regulator (DPR) নিয়োগ করা উচিত।
মেড ইন ইন্ডিয়া:
ভারত সরকার এমন কোনও ভারতীয় সংস্থার সঙ্গে হাত মেলাতে পারে যারা ডিজিটাল আইডেন্টিটি-র ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এই প্ল্যাটফর্মে ভারতীয় নাগরিকদের ডিজিটাল আইডেন্টিটি সহজে সুরক্ষিত রাখা যাবে।
আন্তর্জাতিক স্তরেও পদক্ষেপ:
স্বাস্থ্যক্ষেত্রের পরিষেবা, অনলাইনে পড়াশোনা, অনলাইনে কেনাকাটা, ই-কমার্স, রিমোট ওয়ার্ক এবং আরও নানা ধরনের কাজ রয়েছে যা ডিজিটাল ক্ষেত্রে হয়। এবং অনেকগুলোই বিদেশি সংস্থা। ভারত সরকার এমন সংস্থার সঙ্গে হাত মেলাতে পারে। পাশাপাশি তথ্যের ব্যবহার, সুরক্ষা নিয়ে সতর্ক নজর রাখতে হবে সরকারকে। আইন ভাঙলে পদক্ষেপ করার ব্যবস্থাও থাকবে।
ভারতের টেক-দশক:
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতিমধ্যেই বলেছেন যে ফাইভ-জি লঞ্চ করার মাধ্যমে সবার ইন্টারনেটের সুবিধা মিলবে। তিনি এটাও বলেছেন যে এই দশক আসলে ‘Tech-ade of India’. ইন্টারনেটের যাবতীয় সুবিধা নেওয়ার জন্য আমাদের সবরকম বাধা টপকানো উচিত। তার মধ্যেই অন্যতম হল তথ্য় সুরক্ষা।
'অমৃত কাল'-এর মধ্যে সারা দেশে আমাদের সচেতনতা প্রসার করা উচিত। এর মধ্যেই গ্রাহকদের তথ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য নির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করা উচিত, যৌথ প্রকল্পে যাওয়া উচিত। তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকলে তা ভারতীয়দের প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল বিপ্লবের সর্বাধিক সুবিধা পেতে সাহায্য করবে।
(লেখক Ankura Consulting-এর সিনিয়র ম্য়ানেজিং ডিরেক্টর, ওই সংস্থা তার গ্রাহকদের নানা জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য কৌশলগত সাহায্য করে)
ডিসক্লেইমার: এই ওয়েবসাইটের বিভিন্ন লেখক এবং ফোরাম অংশগ্রহণকারীদের মতামত, বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত।