কর্নেল দানবীর সিং (অবসরপ্রাপ্ত): তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেই সময় একটি উক্তি করেছিলেন ফ্রান্সের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জর্জেস বেঞ্জামিন ক্লেমেন্সউ (Georges Benjamin Clemenceau)। তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধ বিষয়টি এতটাই গুরুতর যে সেনাধ্যক্ষের (Generals) উপর ছাড়া যায় না। কিন্তু ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে যে সবচেয়ে ভাল পরিকল্পনা বা স্ট্যাটেজি তৈরি করলেও তা ভেস্তে যেতে পারে, যদি সেই স্ট্র্যাটেজি সেনাধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনা না করে, তাঁদের বাদ দিয়ে তৈরি হয়। ঠিক এই বিষয়টিই হাতে-কলমে প্রমাণ হয়েছিল ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের সময়।


১৯৫৯ সাল। সেই সময়ে ভারতের ইস্টার্ন কম্যান্ড (Eastern Command)-এর আর্মি কম্যান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসপিপি থোরাট (Lt Gen SPP Thorat)। অরুণাচলের উত্তর-পূর্ব সীমান্তকে (North East Frontier of Arunachal or NEFA) শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি একটি পরিকল্পনা করেছিলেন, যা এখন থোরাট প্ল্যান (Thorat Plan) নামে পরিচিত। ওই বছরেই ৮ অক্টোবর, থোরাট প্ল্যান পাঠানো হয় আর্মি হেডকোয়ার্টারে। যেখানে সেনাপ্রধান জেনারেল কেএস থিমায়া (KS Thimayya) সেটিতে সিলমোহর দেন। তারপর ব্যক্তিগত ভাবে গোটা পরিকল্পনা এবং তার জন্য কী কী প্রয়োজন তা দেখান তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভিকে কৃষ্ণ মেনন (VK Krishna Menon)-কে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অপ্রয়োজনীয় বলে সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেন মেনন। কূটনীতির মাধ্যমেই চিনকে রুখে দেওয়া যাবে বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। ওই থোরাট প্ল্যান (Thorat Plan) ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকেও দেখানো হয়নি।


ভারতের নেতারা জর্জেস বেঞ্জামিন ক্লেমেন্সউ-এর কথাটি বেদবাক্য বলে মেনে নিয়েছিলেন, আর ভয়াবহ ভুল করেছিলেন। 



১৯৬২'র হার:
১৯৬২ সালের ২০ নভেম্বর। অসমের (Assam) পাহাড়ি এলাকা তেজপুর। সেখান থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিল চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (People’s Liberation Army from China)। ওই দিন চিনের (China) তরফে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। সেই তথ্য এসে পৌঁছতে একটু সময় লেগে গিয়েছিল, ফলে ২২ নভেম্বরের মধ্যে অসমের তেজপুর ভৌতিক শহরে পরিণত হয়েছিল। চিনা সৈন্য আসার খবর পেয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছিল সবাই।  


ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধাক্কা খেয়েছিল। আমরা বিশাল পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়েছিলাম। সেই হারের দাগ এখনও ভারতের মানসিকতায় কোথাও না কোথাও রয়ে গিয়েছে। চিনারা পিছু হঠে গিয়েছিল, উত্তর-পূর্বাঞ্চলও ছেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু পূর্ব লাদাখে রয়ে গিয়েছিল তাঁরা। কিন্তু কেন চিনারা জমি ছেড়ে দিয়েছিল? বিশেষ করে NEFA-এলাকা? এর অন্যতম বাধ্যতামূলক কারণ হল সড়ক পরিবহণের পরিকাঠামোর ঘাটতি। কোনও এলাকা দখলে রাখতে গেলে সেই এলাকায় গোলাবারুদ ও রসদ পৌঁছতে হয়। তার জন্যই চাই সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থা। চিনের যা অর্থনৈতিক শক্তি ছিল এবং সেনার যা পরিকাঠামো ছিল তাতে তাদের পক্ষে ওই এলাকায় দখল রাখা অসম্ভব ছিল। অনেক বেশি এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল চিনা সৈন্যরা। হয়তো ভারতের সেনা এত তাড়াতাড়ি পিছু হঠবে সেটা তারা ভাবতে পারেনি।


৬২'র ভারত-চিন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে সেই থোরাট প্ল্যান ফের সামনে নিয়ে আসা হয়। NEFA-এলাকাতে সুরক্ষিত রাখতে মেননের বাতিল করে দেওয়া সেই পরিকল্পনাকেই গ্রহণ করে ভারত।


  
লাদাখে অন্য গল্প:
লাদাখের ভূগোলটা আলাদা, ফলে পরিস্থিতিও ভিন্ন। তিব্বতী মালভূমির একটা অংশ লাদাখ (Ladakh)। এখানে এমন ভৌগোলিক পরিস্থিতি যার ফলে চিনের পক্ষে সহজে এপার-ওপার করা সহজ। ভারতের দিকটি রুক্ষ এবং পর্বতসঙ্কুল, যা ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য সুবিধাজনক ছিল। আকসাই চিনের মধ্যে দিয়ে চিনারা রাস্তা তৈরি করেছে যা জিনজিয়াং প্রদেশের সঙ্গে তিব্বতের সরাসরি যোগযোগ তৈরি করেছে। ভারত-চিনের যে সীমান্ত এখন কার্যত হয়েছে, তাঁর সমান্তরালে রয়েছে ওই রাস্তা। এই রাস্তার কারণেই কৌশলগত অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। রাস্তার ফলে দ্রুত বাহিনী সমন্বয় করা, লজিস্টিক সাপোর্ট এনে হাজির করাতে পারবে চিনা সৈন্য যা তাদের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। আমাদের দিকে রয়েছে উঁচু পর্বত, সেই সুবিধার কথা মাথায় রেখেই থোরাট প্ল্যানের অনুকরণে আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজিয়েছি।  


সাম্প্রতিক কালে যতবারই ভারত রাস্তা ও পরিকাঠামো তৈরি করতে গিয়েছে ততবারই বিস্তর চাপ এসেছে তিনের পক্ষ থেকে।


১৯৬০ থেকে ১৯৯০ সাল, এই সময়ে ভারতের অর্থনীতি দুর্বল ছিল। খাদ্যদ্রব্যে ঘাটতি থেকে ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ একাধিক বিষয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে ভারতকে। শত্রুদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যও কাজ করতে হয়েছে ভারতকে। সম্পদের ঘাটতি ছিল, সেই কারণেই প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ হিসেবে NEFA-এর পরিকাঠামোর অনুন্নত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল, LAC (Line of Actual Control)-এর এপারে শক্তিশালী ঘাঁটি রেখে হিমালয়ের ওপারে চিনকে আটকে রাখা।


এদিকে আশির দশকের পরে চিনের দিকেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। দেং জিয়াওপিং-এর (Deng Xiaoping) অধীনে চিনা অর্থনীতিতে বড়সড় পরিবর্তন আসে। ভারতের অর্থনীতির সঙ্গে ফারাক হয়ে যায় অনেকটাই। নব্বইয়ের দশকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও এবং তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ভারতে অর্থনীতিকে মুক্ত করেন। তা সত্ত্বেও তিন দশক পরেও দুই দেশের অর্থনীতির ফারাক রয়ে গিয়েছে। চিনে অর্থনৈতিক প্রগতির কারণেই তিব্বতে বিপুল পরিমাণ পরিকাঠামো উন্নয়ন হতে থাকে। ১৯৫৬ কিলোমিটার লম্বা কিংঘাই-তিব্বত রেলপথ (Qinghai-Tibet railway) তৈরি করা হয় যা লাসার সঙ্গে বেজিংকে জুড়ে দিয়েছে। এই পথেই পড়েছে চেংদু (Chengdu), চোংগকিং (Chongqing), গুয়ানঝাউ (Guangzhou), সাংহাই (Shanghai), জিনিন (Xining) এবং লানঝাউ (Lanzhou)। এই রেলপথের ফলে চিনের প্রধান সামরিক এলাকাগুলির সঙ্গে লাসার যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়াও বাহিনী মোতায়েনের জন্য ২০২১ সালে লাসা থেকে নিংগচি (Nyingchi) পর্যন্ত আরও একটি রেলপথের সূচনা করেছে চিন।  যার ফলে LAC থেকে মাত্র ৫০ কিোলমিটার দূরে এসে পৌঁছেছে চিনের রেল। সীমান্তে চিনা সেনার কাছে সবচেয়ে কম সময়ে রসদ ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছনোর জন্য সড়ক পরিবহণ, বিমানঘাঁটি থেকে শুরু করে যাবতীয় পরিকাঠামো তৈরি করেছে চিন। তিব্বতে সড়ক পরিবহণ যোগাযোগ ব্যবস্থা চমকে দেওয়ার মতো। সেখানে মোট ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কপথ রয়েছে।


ডোকলামের ঘটনা এবং তারপরের শিক্ষা:
Line of Actual Control (LAC)-এ চিনা সেনার আগ্রাসন বা এগিয়ে আসার ঘটনা ২০১০ সাল থেকে দেখছে ভারত। LAC-এর দৈর্ঘ্য মোট ৪০০০ কিলোমিটার। এই বিস্তীর্ণ সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় চিনা সেনা (PLA) অনুপ্রবেশ করেছে বা করার চেষ্টা করেছে। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অন্তত ৫০০ বার অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর ২০১৩ সালের এপ্রিলে চিনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় চ্য়ালেঞ্জের মুখোমুখি হয় ভারত। পূর্ব লাদাখের ডেপসাং এলাকায় (Depsang) ভারতের জমির ১০ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে আসে চিনা সেনা (PLA)। চিনা সেনার রসদ জোগানোর জন্য কপ্টার ব্যবহার করা হয়েছিল চিনের তরফে। বোঝা গিয়েছিল ওদের পরিকাঠামোগত উন্নতির দিকটি। এই ঘটনা ভারতকে সতর্ক করেছিল। যদিও এর থেকেও খারাপ ঘটনা অপেক্ষা করছিল ভারতের জন্য।


২০১৭ সাল। ৭৩ দিনের জন্য মুখোমুখি হয়েছিল ভারতে ও চিনা সেনা। হিমালয়ের একটি দুর্গম অঞ্চল ডোকলাম যেখানে ভারত, চিনের তিব্বত অংশের ও ভুটান- তিন দেশেরই সীমানা রয়েছে। ওই বছরেরই জুন মাসে সমস্যার সূত্রপাত। চিনের সেনার তরফে ডোকলাম মালভূমির উপর দিয়ে একটি রাস্তা তৈরি ঘিরে সমস্যা। ওই ডোকলাম ভুটান ও চিন উভয়েই নিজেদের বলে দাবি করেছে। ওই এলাকায় ভারতের জন্যও অত্যন্ত স্পর্শকাতর, বিশেষ করে ভারতের জলপাইগুড়ি করিডরের জন্য। সেই কারণে বিষয়টি হস্তক্ষেপ করে ভারতীয় সেনা। যার ফলে তুঙ্গে ওঠে উত্তেজনা। এশিয়ার দুই মহাশক্তিধর দেশের সেনা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন আলোচনার পরে দিল্লি ও বেজিং উভয়েই তাঁদের সেনা সরাতে রাজি হয়। চিন বাধ্য হয় পরিকল্পনা বাতিল করতে। কিন্তু তারপরেও নিশ্চুপে এবং অত্যন্ত ধীর গতিতে সেনা মোতায়েন ও পরিকাঠামো তৈরি করছে চিন। ওই এলাকায় সুবিধাজনক পরিস্থিতি পাওয়ার লক্ষ্যে কাজ চালাচ্ছে।


তার ঠিক তিন বছর পরে ফের মুখোমুখি হয় ভারতীয় ও চিনা সেনা। ৪৫ বছরে প্রথমবার প্রবল সংঘর্ষে জড়ায় ভারত ও চিনের সেনা। ২০২০ সালের ১৫ জুন গালওয়ান উপত্যকায় (Galwan Valley)। ওই ঘটনায় দুপক্ষেই প্রাণহানি ঘটে। যার ফলে প্রবল উত্তেজনা তৈরি হয়। দুই দেশের তরফে বিপুল পরিমাণে সেনা মোতায়েন করা হতে থাকে। তখন বিশ্বে কোভিড মহামারি চলছে, তার মধ্যেই যুদ্ধের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় গোটা পরিস্থিতি।   


উত্তর হিমালয় সীমান্ত কার্যত ফুটছে। ভারত ও চিন দুই পক্ষই সমানে নিজেদের পরিকাঠামোর উন্নয়ন করে চলেছে। যাতে দ্রুত বিপুল সংখ্যক সেনা ও পরিকাঠামো মোতায়েন করা যায়। পাশাপাশি কূটনৈতিক স্তরেও চলে আলোচনা। আলোচনার মাধ্যমে কূটনৈতিক স্তরে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু তারপরেও সংঘর্ষ রোখা যায়নি। 
 
ভারতের দিকে সীমান্ত পরিকাঠামোর উন্নয়ন:
ডোকলাম সমস্যার পর থেকে পাঁচ বছরে সীমান্ত এলাকায় ৩৫০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রাস্তা তৈরি করেছে ভারত। অন্যদিকে তিব্বত এলাকায় সামরিক পরিকাঠামো তৈরি করেছে চিন। যার মধ্যে রয়েছে ৬০ হাজার কিলোমিটারের রেল ও সড়কপথ। তবে এটা মাথায় রাখা উচিত যে এই এলাকায় ভারতের দিকে রয়েছে উঁচু পবর্তসঙ্কুল এলাকা। আর চিনের দিকে রয়েছে প্রায় সমতল তিব্বতী মালভূমি অঞ্চল। 


চিন expressway G-695 তৈরির কাজ করছে। যেটা LAC-এর সমান্তরালে থাকবে। তিব্বতের সঙ্গে জিনজিয়াংয়ের সংযোগ তৈরি হবে। এটা তৈরি হলে ভারত-চিন সীমান্তে দ্রুত সেনা পাঠানোর জন্য চিনের কাছে আরও একটি রুট থাকবে। প্যাংগং সো হ্রদের দুই তীরের মধ্যে আরও ভাল যোগাযোগের জন্য দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ করছে চিন। 


পরিস্থিতির দিকে তাকিয়েই সীমান্ত পরিকাঠামোয় নজর দিয়েছে ভারত। হিমালয়ের সমান্তরালে সড়ক ও রেল পরিকাঠামো তৈরি করেছে ভারত। উত্তর-পশ্চিম জম্মুর উধমপুর থেকে অসমের তিনসুকিয়া পর্যন্ত সড়ক ও রেল যোগাযোগ রয়েছে। যা ৪০০০ কিলোমিটার লম্বা। এছাড়াও LAC-তে অতি দ্রুত সেনা ও রসদ পৌঁছনোর জন্য ভারতের ফিডার রোড প্রয়োজন। সেই কারণেই কাজ করছে ICBR বা India-China Border Roads। এই প্রকল্পের অধীনে ভারত-চিন সীমান্তে উন্নত সামরিক পরিকাঠামো তৈরির জন্য একাধিক রাস্তা-ব্রিজ ও টানেল তৈরি হচ্ছে। 


লেখক একজন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ। Indian Defence Review-এর অ্য়াসোসিয়েট এডিটর এবং ABP News -এর কনসালট্যান্ট


ডিসক্লেইমার: এই ওয়েবসাইটে বিভিন্ন লেখক এবং ফোরাম অংশগ্রহণকারীদের মতামত, বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিগত