লোকেশ সুজি, নয়াদিল্লি: গত এক দশকে ভারতে ই-স্পোর্টসের (Esports) জগতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। ২০০০ সালের কথা। সেই সময় ই-স্পোর্টস দেখা যেত শুধু কলেজ ফেস্ট বা স্থানীয় কোনও প্রতিযোগিতায়। সেই ই-স্পোর্টসই এখন আড়াইশো কোটি টাকা মূল্যের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ভারতে ৬ লক্ষেরও বেশি খেলোয়াড় এবং প্রায় এক লক্ষ দল ই-স্পোর্টসের সঙ্গে যুক্ত।


যে সংখ্যা শুনলে যে কেউ চমকে উঠবেন। তবে যাঁরা ই-স্পোর্টসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাঁরা বিশেষ অবাক নন। বরং তাঁদের মতে, এই বৃদ্ধি স্বাভাবিক। এবং ই-স্পোর্টসের ক্রমবর্দ্ধমান জনপ্রিয়তার জন্যই চলতি বছরে কমনওয়েলথ ই-স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ ও এশিয়ান গেমস ২০২২-এ অংশগ্রহণ করছে ভারত।


তবে ই-স্পোর্টসের এশিয়ান গেমসে ভারতের অংশগ্রহণ এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৮ সালে জাকার্তায় ই-স্পোর্টস এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়েছিল ভারত। মোট ১৮টি দেশ অংশ নিয়েছিল। খালি হাতে ফিরতে হয়নি ভারতকে। হার্থস্টোনে তীর্থ মেটার হাত ধরে ব্রোঞ্জ জিতেছিল ভারত।


তবে এবার ই-স্পোর্টসের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। কারণ, এবার ই-স্পোর্টসকে পদক জেতার খেলা বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফিফা ২২, স্ট্রিট ফাইটার ৫, হার্থস্টোন, লিগ অফ লেজেন্ডস ও ডোটা টু, এই পাঁচটি গেমে অংশ নেবেন ভারতীয় অ্যাথলিটরা।


এশিয়ান গেমসের পাশাপাসি চলতি বছরে কমনওয়েলথ গেমসেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ই-স্পোর্টস। যেখানে ভারতীয় দল ডোটা টু ও রকেট লিগে অংশগ্রহণ করেছেন। তার আগে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটি (IOC) ভার্চুয়াল অলিম্পিক সিরিজ আয়োজন করেছিল। ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিক্সের আগে। তবে তারও আগে, ২০০৭ সাল থেকে OCA ইভেন্টে ই-স্পোর্টস অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।


পাশাপাশি কোরিয়া, তাইল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ইতালি, ব্রাজিল, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, ম্যাসিডোনিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, সার্বিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও জর্জিয়ার মতো ৪৬টি দেশ ই-স্পোর্টসকে নিয়মিত খেলাধুলো হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।


ভারতীয় ই-স্পোর্টস অ্যাথলিটদের প্রতিভা প্রদর্শনের মঞ্চ করে দিচ্ছে ই-স্পোর্টসের নিয়ামক সংস্থা। যা থেকে ই-স্পোর্টসের ক্রমবর্দ্ধমান জনপ্রিয়তার আভাস পাওয়া যায় বৈকি।


বৃদ্ধির সম্ভাবনা


যে কোনও খেলাধুলোর মতো প্রতিযোগিতামূলক গেমিংয়েও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রস্তুতি, সাধনা, চাপ, অ্যাড্রিনালিন ক্ষয়, রিফ্লেক্স এবং জনউন্মাদনা জড়িয়ে রয়েছে। পাশাপাশি মূল স্রোতের খেলাধুলোর মতো ই-স্পোর্টসেও বাড়ছে আয়ের সুযোগ।


লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ই-স্পোর্টসের দর্শকসংখ্যাও। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে ১৫২টি দেশের ৫০ কোটিরও বেশি মানুষ ই-স্পোর্টস দেখেছেন। যে সংখ্যাটা চমকপ্রদ। ইউটিউব, ফেসবুক গেমিং, লোকো ও রুটার হল ভারতে ই-স্পোর্টস সম্প্রচারের চারটি সেরা মাধ্যম। সবচেয়ে বড় কথা, ই-স্পোর্টস সম্প্রচারের মধ্যে দিয়ে বড়সড় রোজগারের রাস্তাও খুলে গিয়েছে স্ট্রিমারদের জন্য। অনেকে কেরিয়ার হিসাবেও বেছে নিচ্ছেন ই-স্পোর্টস সম্প্রচারকে।


ভারতে ক্রমবর্দ্ধমান জনপ্রিয়তা


ইউগভ গ্লোবাল প্রোফাইল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতি চারজন ই-স্পোর্টস উপভোক্তার মধ্যে একজন (২৫ শতাংশ) সপ্তাহে অন্তত ৭ ঘণ্টা তাঁদের মোবাইল ফোনে ভিডিও গেমস খেলেন। ভারতে মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ সপ্তাহে ১ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় মোবাইল গেম খেলে কাটান, ১১ শতাংশ সপ্তাহে ৭-১৪ ঘণ্টা মোবাইল গেম খেলেন।


মোবাইল ডেটা সস্তা হয়ে যাওয়ায় ও স্মার্টফোনের দাম মধ্যবিত্তেরক আয়ত্তের মধ্যে থাকায় ভারতে ই-স্পোর্টসের জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছে। মোবাইল গেমিংয়ে প্রচুর মানুষের আগ্রহের কারণে ভারত এখন অ্যাপ ডাউনলোডের ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাজারে পরিণত হয়েছে। যে কারণে মোবাইল ভিত্তিক গেমস ভারতে ই-স্পোর্টসের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছে।


করোনা পরবর্তী অধ্যায়ে ভারতে ই-স্পোর্টস অ্যাথলিট ও দলের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিরাট পুরস্কার মূল্যের টুর্নামেন্টগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে আট থেকে আশি। এমনকী, কিছু কিছু ই-স্পোর্টস টুর্নামেন্ট ২ কোটি টাকা পর্যন্ত পুরস্কার অর্থ ঘোষণা করেছে।


২০২১ সালের ই অ্যান্ড ওয়াই রিপোর্টে সম্ভবত সেই কারণেই শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল, 'রেডি, সেট, গেম অন'। যেখানে বলা হয়েছে, ই-স্পোর্টসের বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১১০০ কোটি টাকায় পৌঁছবে।


ই-স্পোর্টসে বিনিয়োগ এখন আর শুধু টুর্নামেন্ট, প্ল্যাটফর্ম বা কমিউনিটিতে সীমাবদ্ধ নয়। ই-স্পোর্টসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, গেমার ও কনটেন্ট ক্রিয়েটররা অনেক ব্র্যান্ডকে আকৃষ্ট করছেন। এগিয়ে আসছে স্পনসররা। পাশাপাশি ভারতে বিভিন্ন প্রথম সারির মাল্টিপ্লেক্স, যেমন আইনক্স লেজার ও পিভিআর ই-স্পোর্টসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে ও ই-স্পোর্টসকে বড় পর্দায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করছে।


বিভিন্ন ব়্যাপার, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, অভিনেতা ও বিখ্যাত ব্যক্তিরা ই-স্পোর্টসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেদের আয় ও জনপ্রিয়তা, দুই-ই বাড়াতে চাইছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, ব়্যাপার রফতার ভাংড়া বুগি কাপের জন্য ফোর্টনাইটের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন, রুটারের কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন ক্রিকেটার যুজবেন্দ্র চাহাল। ই-স্পোর্টস প্রিমিয়ার লিগের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন টাইগার শ্রফ। যার থেকে বোঝা যায়, ভারতে ই-স্পোর্টসের বাজার কতটা লাভদায়ক হয়ে ওঠার ইঙ্গিত বহন করছে।


কোন কোন খেলা ই-স্পোর্টস গোত্রভুক্ত?


ভারতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, কোন খেলা ই-স্পোর্টস গোত্রীয় আর কোন খেলা ই-স্পোর্টস বহির্ভুত, তা নিয়ে প্রবল সংশয়। অনেক সময়ই প্রতিযোগিতামূলক ই-স্পোর্টস যেমন ডোটা, ফিফা, কাউন্টার স্ট্রাইক বা ফোর্টনাইটের সঙ্গেই এক করে দেখা হয় তিন পাত্তি, রামি, পোকার এবং ফ্যান্টাসি স্পোর্টসকে। শেষোক্ত খেলাগুলি লটারির মতো, যেখানে একজন খেলোয়াড়ের টাকা রোজগারের সুযোগ থাকে। কিন্তু এগুলি ই-স্পোর্টস নয়। কারণ ইলেকট্রনিক স্পোর্টস বা ই-স্পোর্টস প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যেখানে একজন অ্যাথলিট ভার্চুয়াল, বৈদ্যুতিন পরিবেশে নিজের শারীরিক ও মানসিক মুন্সিয়ানার পরিচয় দেন।


পেশা হিসাবে ই-স্পোর্টস


ই-স্পোর্টসের ক্রমবর্দ্ধমান জনপ্রিয়তা ও ঊর্ধ্বমুখী বাজার কেরিয়ার হিসাবেও একে আকর্ষণীয় বিকল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভারতের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ই-স্পোর্টসকে পেশা হিসাবে বেছে নিচ্ছেন। ভবিষ্যতে ই-স্পোর্টসের বাজারে পতনের কোনও আশঙ্কাই দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। ই-স্পোর্টস বিপণন, প্রশিক্ষণ, ই-স্পোর্টস সাংবাদিকতা, গেম ডিজাইনারের মতো একাধিক পেশায় রোজগারের রাস্তা তৈরি হচ্ছে।


ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ প্রকাশ্যেই ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক্সে ই-স্পোর্টসের অন্তর্ভুক্তর দাবি তুলেছেন। মনে করা হচ্ছে অলিম্পিক্স বা কমনওয়েলথ গেমসে প্রতিযোগিতামূলক গেমিংয়ের অন্তর্ভুক্তি শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। আর যদি তা হয়, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারত তাতে অগ্রণী ভূমিকা নেবে।


ক্রমবর্দ্ধমান লভ্যাংশ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কথা মাথায় রাখলে এটা স্পষ্ট যে, ভারতে এই দশকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বাজার হতে চলেছে ই-স্পোর্টসই।


আরও পড়ুন: দলীপ ট্রফি দিয়ে মরসুম শুরু, ফিরছে ইরানি কাপ, ইডেনে রঞ্জির হোম ম্যাচ খেলবে বাংলা