অভিষেক দে : এটা এমন একটা সময় যখন বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট। ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির কাছে কোনও ওষুধ বাজারজাত করার আগে তার কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জটিল হয়ে উঠেছে। অথচ জ্বর হলে এখন আমরা যে প্যারাসিটামল খাই, সেই ওষুধও ১৯৫০ সালে আমেরিকায় বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের আগে ৫০ বছর তার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা হয়েছিল। যদিও করোনা অতিমারী ওষুধের উচ্চমানের ট্রায়ালের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনার জন্য ভারত দ্রুত আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে উঠে আসছে।
ভারত কেন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠছে ?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৯ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমতুল্য একটি শক্তিশালী কাঠামো, বিশাল সংখ্যক রোগী, চিকিৎসায় দক্ষতা, প্যারামেডিক্যাল পেশাদার এবং কম খরচ- বিশ্বব্যাপী ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মানচিত্রে ভারতের অবস্থান দৃঢ় করেছে।
এবিপি লাইভকে এক সাক্ষাৎকারে পুষ্পবতী সিংহানিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা দীপক শুক্লা জানান, ওষুধের ট্রায়ালের জন্য ভারত সবচেয়ে পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠছে। কারণ, এটি বৃহত্তম ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প। যদি আপনার বড় ফার্মা শিল্প থাকে তবে আরও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হতে বাধ্য।
এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় ওষুধের বাজার ২০৩০ সাল নাগাদ তার বর্তমান স্তর ৪৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। মার্কিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সংস্থা (CRO) Parexel-এর একটি রিপোর্ট বলছে, এটি ১২.৩ শতাংশের CAGR-এ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এই সময়ে অন্যান্য শিল্পের তুলনায় অনেক বেশি। Parexel-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর সঞ্জয় ব্যাস বলেন, ভারতে ১.২ বিলিয়ন জনসংখ্যা থাকার কারণে প্রচুর সংখ্যক রোগী রয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা এবং প্রশিক্ষিত ইংরেজিভাষী ইনভেস্টিগেটর রয়েছে এখানে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রেজিস্ট্রি ইন্ডিয়া অনুসারে, ভারত ২০২১ সালে ১০০র বেশি গ্লোবাল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুমোদন করেছে, যা ২০১৩ সালের পর সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালে ৯৫টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালিত হয়েছিল, যেখানে ২০১৮ সালে ৭৬টি এবং ২০১৭ সালে ৭১টি ট্রায়াল হয়েছিল।
নতুন ওষুধ এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নিয়ম অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে-
২০১৯ সালে ভারত নতুন ওষুধ ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের (NDCT) নিয়ম প্রণয়ন করার পরে আবেদনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। লক্ষ্য ছিল, দেশে ক্লিনিক্যাল গবেষণা বাড়ানো এবং ভারতীয় জনগণের কাছে নতুন ওষুধ দ্রুত পৌঁছে দেওয়া।
ভারতে উৎপাদিত ওষুধের জন্য আবেদন অনুমোদনের সময় কমিয়ে ৩০ দিন এবং দেশের বাইরে তৈরি ওষুধের জন্য ৯০ দিন করা হয়েছে। এছাড়াও, প্রতিকূল ঘটনার ক্ষেত্রে রোগীদের জন্য অতিরিক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রক্রিয়াও স্বচ্ছ করা হয়েছে।
দেশের অন্যতম প্রাচীন ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন SIRO Clinpharm-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট গণেশ দিবাকর বলছেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুমোদন এবং পর্যালোচনা প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ এবং অনুমানযোগ্য হয়ে উঠেছে। এছাড়া ICMR রোগ-ভিত্তিক গাইডলাইন নিয়ে এসেছে, যা চিকিৎসা এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দৃষ্টিকোণ থেকে খুব সহায়ক।
Parexel-এর সঞ্জয় ব্যাস বলছেন, ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও ইউরোপিয়ান মেডিসির এজেন্সির গাইডলাইনের মতো এখনকার রেগুলেশন। তিনি বলেন, ২০০০ সালে এমন একটি সময় ছিল যখন কিছু স্থানীয় জোগানদাতা আচরণবিধি অনুসরণ না করায় ভারত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অনেক সুযোগ হারিয়েছে। অবশেষে, ২০১৯ সালে, DCGI চমৎকার নিয়ম নিয়ে আসে। যা শুধুমাত্র রোগী, ফার্মা কোম্পানিগুলিকে সাহায্য করে না, পরিষেবা প্রদানকারীরাও তাতে সুযোগ পাচ্ছে।
করোনা কীভাবে ভারতের মুকুটে পালক জুড়েছে ?
২০২০ সালে যখন অতিমারী আঘাত হানে, তখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আবহেলায় পড়েছিল। এই সময়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে আলোচনার শুরু হয়। এদিকে অতিমারীর চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিনের জরুরি হয়ে পড়ে। যে কারণে ২০২১ সালের পর দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সংগঠিত হয়। সঞ্জয় ব্যাস বলছেন, হঠাৎ করে সবাই প্লাসিবো, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আচার কী, এপিডেমিওলজি কী- এসব নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। Covid-19 ভারতে ক্লিনিকাল ট্রায়াল সম্পর্কে আরও সচেতনতা এনেছে।
PSRI-এর চিকিৎসক শুক্লা বলছেন, কোভিড-১৯-এর সময় ভারতে ভ্যাকসিন পরীক্ষা এবং প্রক্রিয়াকরণ দ্রুততম হয়ে উঠেছে। এটি খুব দ্রুত এবং সবচেয়ে নৈতিক উপায়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনায় ভারতের সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। পাশাপাশি ভারতের মুকুটে একটি পালক যোগ করেছে।
Parexel-এর সঞ্জয় ব্যাস বলছেন, অতিমারী চলাকালীন, হাসপাতালগুলি কোভিড -১৯ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যস্ত ছিল। এই সময়ে রোগীকে হাসপাতালে পরীক্ষার জায়গায় আসার পরিবর্তে, বাড়িতে পরীক্ষা করার উদ্ভাবনী উপায়ের কথা ভেবেছিলাম আমরা।
এখনও যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে-
তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, জার্মানি এবং জাপানের উন্নত বাজারগুলির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে ভারতকে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। চিকিৎসক শুক্লা বলছেন, দেশে গবেষণার সংস্কৃতি দরকার। বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এতে প্রবেশ করতে হবে। ভারতে স্বাস্থ্য খাতের ৮০ শতাংশ বেসরকারি। বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্য পরিষেবা আরও বাণিজ্যিক ভিত্তিক, তারা শিক্ষাবিদ এবং গবেষণার দিকে খুব বেশি ঝোঁকে না। বর্তমানে, বেশিরভাগ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং গবেষণার কাজ সেন্ট্রাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, PGI চণ্ডীগড়, AIIMS-এর মতো প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু তাদের সংখ্যা এতটাই নগন্য যে, তা দেশের গবেষণা কাজের এক শতাংশও নয়।
এক্ষেত্রে সঞ্জয় ব্যাস বলছেন, প্রচুর পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটতে হবে।
ক্লিনিকাল ট্রায়ালের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনের প্রধান ক্ষেত্র-
ভারতে ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলি বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলছে, যেখানে অঙ্কোলজি এবং জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক গবেষণা করা হচ্ছে।
SIRO Clinpharm অঙ্কোলজি এবং ইমিউনোলজিতে বেশি ফোকাস করছে। কারণ, এগুলিতে এখনও প্রত্যাশিত চিকিৎসা নেই। এখানে উন্নতির অনেক সম্ভাবনাও রয়েছে।
চিকিৎসক শুক্লা বলছেন, কোভিডের পরে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলি আবারও আসছে। এক সময়ে, আমরা ভেবেছিলাম ম্যালেরিয়ামুক্ত ভারত শীঘ্রই বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু এখন, ম্যালেরিয়া পুনরুত্থিত হচ্ছে এবং ডেঙ্গি ফিরে আসছে। এর ফলে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, জনস্বাস্থ্যে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের নতুন ঢেউ আসবে।
প্যারেক্সেল-এর সঞ্জয় ব্যাস মনে করেন যে, ক্লিনিক্যাল গবেষণার দ্বারা স্বাস্থ্যসেবার অগ্রগতিতে ভারতের একটি পাওয়ার হাউস হয়ে ওঠার এটি একটি বিশাল সুযোগ। একটা সময় ছিল যখন ভারত সবসময়ই সবকিছুর জন্য 'ব্যাক অফিস' হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন আমরা একটি বড় পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, ভারত প্রযুক্তিগতভাবে ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালনায় অগ্রগামী হয়ে উঠেছে।