নয়াদিল্লি: শরীরচর্চা করতে জিমে গিয়েছিলেন। সেখানে হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন মহিলা। লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। টানা ১৭ মিনিট শরীরে প্রাণ ছিল না তাঁর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেঁচে উঠলেন। কিন্তু ওই ১৭ মিনিট কোনো উজ্জ্বল আলোও দেখেননি তিনি, স্বর্গোদ্যানেও পৌঁছে যাননি। বরং ওই ১৭ মিনিট কী ঘটছিল, তার একেবারে অন্যরকম বিবরণ দিলেন তিনি। 

৪১ বছর বয়সি ভিক্টোরিয়া টমাস ইংল্যান্ডের গ্লস্টারের বাসিন্দা। পরিবারে কারও হৃদরোগের সমস্যা ধরা পড়েনি আগে। Mirror-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কয়েক বছর আগের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তিনি। জানিয়েছেন, সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৫ বছর। নিজের এলাকাতেই একটি জিমে শরীরচর্চা করতে গিয়েছিলেন। ওয়েট লিফ্টিং চলাকালীন অসুস্থ বোধ করেন তিনি।

ভিক্টোরিয়া জানিয়েছেন, কোনও রকমে পাশের একজনকে অসুস্থ বোধ করছেন বলে জানান তিনি। মনে হচ্ছিল শরীর থেকে সমস্ত শক্তি বেরিয়ে গিয়েছে, মাথা ঘুরছিল। সেই অবস্থায় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সেই সময়ই হৃদরোগে আক্রান্ত হন ভিক্টোরিয়া। অর্থাৎ হৃদযন্ত্র থেকে গোটা শরীরে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। 

ভিক্টোরিয়ার পরিস্থিতি দেখে জরুরি পরিষেবা বিভাগে খবর দেন জিমের লোকজন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। CPR দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও হৃদস্পন্দন ফেরানো যাচ্ছিল না ভিক্টোরিয়ার। প্রায় ১৭ মিনিট নিথর হয়ে পড়েছিল তাঁর শরীর। তার পর হঠাৎই ঘুম ভাঙার মতো জেগে ওঠেন তিনি। 

ওই ১৭ মিনিট ধরে স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন তাঁকে ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন, ভিক্টোরিয়ার কোনও অনুভূতি হচ্ছিল কিনা জানতে চাওয়া হয়। জবাবে  তিনি বলেন, “চারপাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। একেবারে শূন্য। বুঝতে পারলাম নীচে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। ছাদের কাছাকাছি ভেসেছিলাম আমি। সেখান থেকে জিমের মেঝেয় পড়ে থাকা নিজের শরীরের দিকেই তাকিয়েছিলাম। প্রথমেই যে ভাবনা মাথায় আসে, তা হল, পা দু’টো বেশ মোটা আমার। পরে সেই সময় তোলা একটি ছবি দেখি আমি, তাতেও পা ফোলা দেখাচ্ছিল।”

কয়েক মিনিট শরীরে প্রাণ না থাকা সত্ত্বেও, বেঁচে ওঠার নিদর্শন আগেও উঠে এসেছে। ফিরে এসে কেউ সুড়ঙ্গের শেষে উজ্জ্বল আলো দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন, কেউ আবার স্বর্গোদ্যানে পৌঁছনোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সেসব কিছুই হয়নি বলে জানিয়েছেন ভিক্টোরিয়া। তাঁর বক্তব্য, “কোনও আলো দেখিনি আমি, শান্তিও অনুভব করিনি। বরং নিজের দিকেই তাকিয়েছিলাম। হলুদ রংয়ের কিছু মেশিন দেখতে পাচ্ছিলাম। ওঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছুতেই হাল ছাড়ছিলেন না। আমার বয়স কম ছিল, ফিট ছিলাম, সুস্থ ছিলাম। হঠাৎই ওই ঘটনা ঘটে।”

১৭ মিনিট পর প্রাণ ফিরলে ভিক্টোরিয়াকে জিম থেকে ব্রিটিশ রয়্যাল ইনফার্মারিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিন দিন কোমায় আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। সেখানে ফের হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। পরে বাড়ি ফিরে যেতে দেওয়া হলেও, পরবর্তী কয়েক মাসে একাধিক বার হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। ডিফিব্রিলেটরের সাহায্য়ে প্রতিবারই তাঁকে ফেরাতে সফল হন চিকিৎসকরা।  

ভিক্টোরিয়া জানিয়েছেন,  ওই ঘটনার তিন সপ্তাহ পরই ফের খেলাধুলো শুরু করে দেন তিনি। প্রত্যেকবার হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার পর ফের ফিরিয়ে আনা হতো তাঁতে। তবে জীবন থমকে থাকেনি তাঁর। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কথা জানতে পারেন ভিক্টোরিয়া। কিন্তু তাঁর হৃদপিণ্ড সহ্য করতে পারবে কিনা সন্দেহ ছিল। তবে পেসমেকার তাঁকে আশ্বাস জোগাচ্ছিল। তবে কেন বার বার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁর, তা ছ’মাসের গর্ভাবস্থায় জানতে পারেন ভিক্টোরিয়া। তিনি Danon রোগে আক্রান্ত বলে জানান চিকিৎসকরা।

Danon একটি বিরল জিনঘটিত রোগ। গোটা পৃথিবীতে ১০ লক্ষেরও কম মানুষের শরীরে এই রোগের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। এই রোগের জন্য LAMP 2 জিনকে দায়ী করেন চিকিৎসকরা। LAMP 2 জিন থেকে এক ধরনের এনসাইম বা উৎসেচক উৎপন্ন হয়, যা কোষগুলিকে পরিষ্কার রাখে এবং সুস্থ রাখে শরীরকে। কিন্তু Danon রোগীদের শরীরে নোংরা পরিষ্কারের জন্য প্রয়োজনীয় LAMP 2 প্রোটিনের ঘাটতি দেখা যায়। এর ফলে কোষে ময়লা জমে থাকে, বিশেষ করে হৃদযন্ত্রের কোষে এবং হাড়ের সঙ্গে সংযুক্ত পেশিতে। এই রোগে আক্রান্ত হন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে পুরুষদের আয়ু হয় ১৯ বছর, মহিলাদের ক্ষেত্রে ২৪ বছর। তাঁর পরিবারে ভিক্টোরিয়াই প্রথম, যিনি Danon রোগো আক্রান্ত।

ভিক্টোরিয়া জানিয়েছেন, ওই অবস্থায় সন্তানধারণ করায় আতঙ্কিত ছিলেন তিনি। চিকিৎসকরা ২৪ সপ্তাহেই সন্তান প্রসব করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আরও কয়েক সপ্তাহ সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু গর্ভাবস্থা যখন ৩০ সপ্তাহ পূর্ণ করে, সেই সময়ই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ভিক্টোরিয়ার। শরীরে তরল জমা হচ্ছিল। ফলে জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার হয় তাঁর। তবে ভিক্টোরিয়ার ছেলে টমি সুস্থ ছিল। এত কিছুর পর সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন, তা কল্পনাই করতে পারেননি ভিক্টোরিয়া। একাই ছেলেকে বড় করছেন তিনি। কিন্তু ছেলের যখন ছ’মাস বয়স, সেই সময় ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে দেখা যায়, তাঁর হৃদযন্ত্র ১১ শতাংশ কাজ করছে। আর কয়েক মাস বাঁচবেন বলে তাঁকে জানিয়ে দেন চিকিৎসকরা। সেই সময় ডোনারের খোঁজ শুরু হয়। দু’টি হৃদযন্ত্র পাওয়া গেলেও, তা ভিক্টোরিয়ার শরীরের জন্য উপযুক্ত ছিল না। শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সঠিক হৃদযন্ত্র পাওয়া যায়। বার্মিংহামের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপিত হয় ভিক্টোরিয়ার শরীরে। অস্ত্রোপচার সফল হয়। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। এখন ফের খেলাধুলোয় ফিরেছেন ভিক্টোরিয়া। আগামী মাসে জার্মানিতে আয়োজিত ওয়র্ল্ড ট্রান্সপ্লান্ট গেমসে ভলিবল এবং বাস্কেটবল খেলবেন। এখন ছেলের বয়স তিন বছর। ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ। তার সঙ্গেই সময় কাটে ভিক্টোরিয়ার।