২২ মার্চ, ২০২৩
আজ ভোরে উঠে তৈরি হয়ে সোজা জুরিখ হফবানহফ। সেখান থেকে আমরা ট্রেনে করে যাব কোলন। আজ থেকে আমাদের জার্মানি ভ্রমণ শুরু। জার্মানি যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য সেখানে সৌরেন্দ্র- সৌম্যজিতের একটা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা। তার আগে কয়েকদিন আমাদের প্রিয় শহর কোলনে থাকব। সৌরেন্দ্র- সৌম্যজিতের জীবনের শুরুর দিকে অনেকটা সময় কেটেছে এই শহরে। ওদের কাছে কোলনের অলিগলি রাজপথ এতটাই পরিচিত যে সেকেন্ড হোম বলা চলে। আমিও আগেরবার দিন সাতেক ছিলাম এই শহরে। ওদের বন্ধু শিল্পী ব্যান কয়েলের বাড়িতে কয়েকটা দিন কাটানোর লোভে আবারও কোলন পাড়ি। ব্যান নিজে হাজির স্টেশনে। আমরা তার গাড়িতে সব ব্যাগপত্র চাপিয়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে খানিকটা শহর ঘোরার উদ্দেশে রওনা দিলাম।


রাইনের ধারে সেতুর পাশে পৌঁছতেই প্রবল ঠান্ডা হাওয়া। দূর থেকে উলটো পাড়ে কোলন ক্যাথিড্রাল দেখা যাচ্ছে। একে কোলন ডোম বলে। হাঁটতে হাঁটতে রাইন নদীর উপর সেতু পেরিয়ে গেলাম। ব্রিজের গায়ে লক্ষ লক্ষ তালা ঝোলানো রয়েছে। ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে এদেশের মানুষ এমনভাবে ছোট ছোট তালা ঝুলিয়ে যান। অসংখ্য তালা, তাদের নানা রং মিলে বেশ একটা নকশা দেওয়াল তুলে রাখে রেলপথ আর হাঁটা পথের মাঝে। সেতু পেরিয়ে সোজা ঢুকে পড়লাম ডোমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোলন শহর মিত্র শক্তির আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এই ক্যাথিড্রালও বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে এর মেরামতি ও পুনর্গঠনের কাজ চলেছে। আবারও এর ভেতরে ঢুকে মনটা শান্ত হয়ে গেল। সুবিশাল উচ্চতার এই গথিক স্থাপত্য, সঙ্গে রঙিন কাঁচের উপর নানা কাহিনী, সব মিলে একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ। সাগ্নিক আর সৈকতের চোখে মুখেও বিস্ময় ফুটে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে, নানা রকম ছবি তুলে বেরিয়ে পড়লাম শহরের পথে। এবার খেতে হবে।





কোলন ডোম



অলিগলি বাজারের পথ ঘুরে প্রিয় ডোনারের দোকান। ইউরোপের নানা প্রান্তে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের দোকানে এই ডোনার পাওয়া যায়। আমাদের দেশে আমরা যাকে সাওয়ারমা বলি এটা তাই একটা ভিন্ন প্রকার বলা চলে। পেটপুরে এবং মন ভরে খেয়ে এনার্জি অনেকটা বেড়ে গেল। মুখে না বললেও জানি এবার সৌম্যজিতের লক্ষ্য অ্যান্টিক শপ। আমাদের ভাষায় কাবারির দোকান। সেখান থেকে খুঁজে পেতে বহু কিছু কেনা হল। সেগুলো প্যাকিং হওয়ার পর বুঝলাম এবার আমাদের সবাইকে মুটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। ম্যাপ দেখতে দেখতে এবং ভুল করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম ব্যানের বাড়ি। ব্যানের স্ত্রী নানা আমাদের প্রত্যাশা মতই অ্যাপেল পাই তৈরি করে রেখেছিল। দীর্ঘ পথ হেঁটে আমরা সবাই ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। ঘরে গিয়ে খানিক বিশ্রাম। রাতে ব্যান নিজে আমাদের জন্য রান্না করল।


২৩ মার্চ, ২০২৩
ব্যানের বাড়িতে আগেও যখন থেকেছি তখনও অন্যতম আকর্ষণ ছিল এবাড়ির ব্রেকফাস্ট। রান্নাঘর এবং ফ্রিজ আমাদের জন্য অবারিত। সকালে নিচে নেমে দেখি সৌরেন্দ্র কফি তৈরি করে রেডি। সৌম্যজিতের রেয়াজ সেরে আসতে তখনও কিছুটা দেরি। ডাইনিং স্পেসের পাশেই সবুজ লন। তাতে অবশ্য পরিচর্যার অভাব স্পষ্ট। সূর্যের আলো শীতের আমেজকে আরো মোলায়েম করেছে। টেবিল জুড়ে নানা ধরনের ব্রেড, চিজ, সালামি জ্যাম ও ফল সাজানো। সঙ্গে জুস এবং কফি তো আছেই। অনেকটা সময় গল্প করতে করতে সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট সারা হল। এবার আমরা টইটই করে শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম।


প্রথম গন্তব্য কোলন জু। এটাই আমার বিদেশে দেখা প্রথম চিড়িয়াখানা। এর আগে কলকাতার বাইরে দার্জিলিং আর নন্দনকানন দেখেছি। অবশ্য সৌরেন্দ্রর বাড়িতে একটা চিড়িয়াখানা রয়েছে। সেটা ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীন ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা। এখানে এসে দেখলাম পশুপাখিদের তারা যেভাবে রেখেছে বা দেখাচ্ছে সেটাই বেশ আকর্ষণীয়। সর্বোপরি পশুপাখি যারা সেখানে রয়েছে তাদের নড়ন চড়ন এবং মুখভঙ্গিতে কোথাও দুঃখের লেশমাত্র নেই। তারাও যেন মানুষদের সামনে পেয়ে অনাবিল আনন্দে মাতোয়ারা। বিশ্বের  নানা প্রান্তের পশুপাখির জন্য তাদের মত পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে। বিশেষ বিশেষ ঘরে তাপমাত্রা এবং জলীয়বাষ্পের মাত্রাও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। হাতির এনক্লোজারে ঢোকার মুখে বসে রয়েছেন আমাদের গণপতি।




 



কোলন জু


বেশ মজা লাগল দেখে। তবে এদের অভিনব সংগ্রহ হল পেঙ্গুইন ও সিল মাছ। চিড়িয়াখানার পাশে রয়েছে অ্যাকোয়ারিয়াম। সেখানে বিভিন্ন ধরনের সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণীসহ নানা ধরনের মাছ ও জলজ প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়। শুধুমাত্র কীটপতঙ্গের জন্যই একটা গোটা গ্যালারি রয়েছে। আইসক্রিম খেতে খেতে ট্রামে চড়ে আবারও বাজারের দিকে চললাম। আগেই বলেছি এ শহর সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিতের বেড়ে ওঠার অনেকটা সময়ের সাক্ষী। এদিন তাদের পরিচিত বেশ কিছু জার্মান শিল্পী ব্যানের বাড়িতে নিমন্ত্রিত। সৌম্যজিৎ নিজে তাদের রান্না করে খাওয়াতে চায়। তাই অনেক কিছু বাজার করে আমরা বাড়ি ফিরলাম। আমি নানা জিনিস নিয়ে কাটাকাটি শুরু করলাম। আমার দায়িত্ব সম্পূর্ণ কাটাকাটি করা এবং শেষে আলু ফুলকপি ভাজা। সৌরেন্দ্র ডাল করে ফেলল। সৌম্যজিৎ মুরগির মাংস আর সৈকতের দায়িত্ব ভাত। গল্প করতে করতে জমিয়ে রান্না হল। এ প্রসঙ্গে বলি ভারতীয়  নানা মশলার স্বাদ ইউরোপিয়রা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। এবারও তার অন্যথা হল না। গান বাজনা খাওয়া, স্মৃতিরোমন্থন আর শেষ পাতে আইসক্রিম।


আরও পড়ুন : সুইৎজারল্যান্ডে বসে গরম ভাত, ডাল, আলু ভাজা, ডিম ভাজা এবং মাউন্ট টিটলিস


 


চলবে...