২০ মার্চ, ২০২৩
এ যেন স্বপ্ন মায়ার জগৎ। যেখানে পৌঁছনো সহজ নয়। আমাদের পরিচিত, পরিজন, বন্ধু, প্রতিবেশী অনেকেই হয়তো লন্ডন - আমেরিকায় থাকেন বা বেড়াতে গেছেন। তাদের প্রসাদের চকোলেট আমি আপনি অনেকেই পেয়েছি। কিন্তু সুইৎজারল্যান্ড ? সেখানে আশপাশের বাড়ির সম্পর্কের কেউ থাকে এমনটা চট করে শোনা যায় না। এই অধরা মাধুরীকে আরও মনমোহিনী করে তুলেছে বলিউডের রূপোলি পর্দা।


আমার এটা দ্বিতীয়বার। সৈকত আর সাগ্নিকের এটাই প্রথম। লন্ডন থেকে ভোরের ফ্লাইট। মাঝরাত পেরোতেই আমাদের এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিতে ঐশ্বর্য আর গৌরব এসে হাজির। শীত শেষের এই ক’দিনের লন্ডন সফর তাদের আন্তরিকতা উষ্ণতায় ভরেছিল। এই ফাঁকে একটু গৌরবের কথা বলে নিই। লন্ডনের এক ব্যাঙ্কের উচ্চপদে আসীন। চাকরির সময় বাদে তার বাকি সময়টা কাটে ক্রিকেট নিয়ে। ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর হলেও আবহাওয়ার কারণে এদেশে ক্রিকেট সিজন বছরে ৩-৪ মাসেই সীমাবদ্ধ। ফলত ক্রিকেটাররা সারা বছর খেলার মধ্যে থাকতে পারেন না। গৌরব সেদেশের বোর্ডকে সঙ্গে নিয়ে ইন্ডোর ক্রিকেট লিগের আয়োজন করছে। ফলে ক্রিকেটপ্রেমীরা সারা বছর ক্রিকেট খেলতে পারছেন। এরফলে সেদেশে ক্রিকেটের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ছে।


গ্যাটউইক এয়ারপোর্টে লাগেজ চেকিং সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়। নিজেরাই সেসব করে সিকিউরিটি চেক সেরে যখন বসলাম তখনও আকাশ ফরসা হয়নি। ফ্লাইটে বসে সেদিনের কাগজে চোখ বুলিয়ে দেখি আমরা যেদিন যাচ্ছি তার আগের দিনেই সুইৎজারল্যান্ডের ক্রেডিট সুইস ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণ করল ইউবিএস। দশ বছর আগে যখন সে দেশে গিয়েছিলাম তখনই শুনেছিলাম সুইস ব্যাঙ্ক গুলোর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। বহু সুইস কোম্পানি তাদের প্রধান কার্যালয় সিঙ্গাপুরে সরিয়ে নিচ্ছে। সুইৎজারল্যান্ডের যে আকর্ষণের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তার আরেক কারণ হল তার ঐশ্বর্য। ছোটবেলা থেকে শুনেছি বিত্তবানদের বা ব্যবসায়ীদের কালো টাকা নাকি সুইস ব্যাঙ্কে রাখা থাকে। আর যে কোন নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ স্বাভাবিক।


জুরিখ ইউরোপের একমাত্র বড় শহর যার আন্ডারগ্রাউন্ড টিউব নেই। বলা হয় সুইস ব্যাঙ্কগুলোর ভল্ট মাটির নিচে থাকায় সে দেশে টিউব তৈরি হয়নি। লন্ডন থেকে ঘন্টা দুয়েকের উড়ানে পৌঁছে গেলাম জুরিখ এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্ট থেকেই সবার ট্রাভেল পাস নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। জুরিখ শহর জুরিক লেকের পাশে। যার একদিককে গোল্ডকোস্ট অন্যদিককে  সিলভার কোস্ট বলে। জুরিখ লেকের পাশেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। লন্ডনের মতই তিনটি ঘরের অ্যাপার্টমেন্ট বুক করা হয়েছে। বাড়ি পৌঁছে স্নান সেরে আমি আর সৌম্যজিৎ কিছুটা ঘুমিয়ে নিলাম। সৌরেন্দ্রর সঙ্গে সাগ্নিক আর সৈকত ঘুরতে বেরোলো। ফেরার সময় প্রচুর বাজারও করে আনল। সন্ধ্যেবেলা সবাই মিলে রান্না করা হল বেশ পিকনিকের মেজাজে। সুইৎজারল্যান্ডে বসে গরম ভাত, ডাল, আলু ভাজা, আর ডিম ভাজা। তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালবেলায় মাউন্ট টিটলিস যাওয়া।


২১ মার্চ, ২০২৩
মাউন্ট টিটলিস যাওয়ার টিকিট কলকাতা থেকেই বুক করা ছিল। সামান্য জল খাবার খেয়ে আর সামান্য কিছু ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।হফবানহফ (মেন স্টেশন) এর কাছে স্টার্টিং পয়েন্টে পৌঁছে গেলাম। রিসেপশন থেকে হাতে টিকিট এবং কী কী করতে হবে তার তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হল। আমাদের নিয়ে সাকুল্যে জনা কুড়ির জন্য মস্ত বড় একটা বাস। গাইড মহিলা হাসিমুখে অভ্যর্থনা করছেন সবাইকে। বাস ছাড়ল। মনের শিহরণ ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। দশ বছর আগে যখন এই দেশে এসেছিলাম তখন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেবল কার বন্ধ থাকায় যেতে পারিনি। তাই এবার যাতে টিটলিস সফর ফসকে না যায় তাই আগেভাগে বুকিং করে রাখা। লিমাৎ নদীর ধার দিয়ে ছুটল আমাদের বাস। শহরের গন্ডি ছাড়িয়ে শহরতলি। দূরে দূরে পাহাড়। কোথাও সবুজ মাঠ, কোথাও সরোবর। আশপাশে সাজানো ছোট ছোট বাড়ি। তাদের মধ্যে আকাশছোঁয়ার প্রতিযোগিতা নেই। কোন এক শিল্পী যেন ক্যানভাসের প্রতিটি কোনা নিখুঁতভাবে রং তুলিতে এঁকে দিয়েছেন। মসৃণ পথ ধরে ছুটে চলেছে আমাদের বাস। গাইড মহিলা নানা জায়গায় বর্ণনা দিয়ে চলেছেন এবং কেন সেখানে বাড়ি কেনা অত্যন্ত লাভজনক তার কিছু বিবরণ (ফিরিস্তিও বলা চলে) দিয়ে চলেছেন। মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে বরফে মোড়া কিছু কিছু পাহাড়ের মাথা। লুসার্ন শহরে এসে আমাদের এক ঘন্টার বিরতি। সামনেই লেক। তার পাশে আয়তনে না হলেও ব্যস্ততায় বেশ বড় শহর লুসার্ন। খানিক ঘুরে আর অল্প খেয়ে আবার বাসে উঠে পড়া।


আমাদের আর তর সইছে না। সবাই একাগ্রচিত্তে যেন মাউন্ট টিটলিসের ধ্যান করে চলেছি। শহর ছাড়াতে আশপাশ আরও ফাঁকা হয়ে গেল। দূরে দূরে এক- একটা বাড়ি। হঠাৎই আকাশের বুকে কয়েকজন প্যারাগ্লাইডার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আরও খানিক এগিয়ে এঙ্গেলবার্গে আমাদের বাসযাত্রার ইতি। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একখানে ফাঁকা জায়গা। সেখানেই ভ্রমণকারীদের বাস এবং গাড়ির পার্কিং।  এখান থেকে আমাদের কেবল্ কারে চড়তে হবে। গাইড আমাদের সবার হাতে একটা করে ডিজিটাল পাস ধরিয়ে দিলেন। আমরা চড়ে বসলাম কেবল্ কারে। আমরা পাঁচজন। চকিতে আশপাশের সবুজ সাদায় বদলে যেতে লাগল। প্রথম যে স্টেশনে আমাদের কার থামল সেখানে আমাদের না নামার নির্দেশ আগে থেকেই গাইড দিয়ে রেখেছিলেন। তবে এখান থেকে আমাদের কেবল্ কুঠুরিতে উঠলেন এক বিদেশি। তার পোশাক এবং হাত- পায়ের সরঞ্জামে বোঝা যাচ্ছে তিনি একপ্রস্থ স্কি করে নিচে নেমে আবার উপর থেকে স্কি করতে চলেছেন। আমাদের সঙ্গে দু'একটা কথা বলার পরই আমাদের জুতো নিয়ে সতর্ক করে দিলেন। এই বিদেশি আগন্তুকের কথায় জুতোটি বদলে নেবার সিদ্ধান্ত পাকা হল। শেষ পর্যন্ত কেবল কার যেখানে গিয়ে আমাদের নামাল সেটা একটা ছোট পাঁচতলা বাড়ি। কোন তলা থেকে কী কী উপভোগ করা যাবে তার একটা তালিকা সামনেই ঝোলানো আছে। তবে আমরা সবার আগে জুতোটা বদলে নিলাম। এটা একটা স্মারকের দোকান। সেখানে স্থানীয় পোশাক সহ বরফের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক ভাড়া পাওয়া যায়। স্থানীয় পোশাকে বেশ কয়েকজন ভারতীয় সেলিব্রেটির ছবি দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে। এক বৃদ্ধ দম্পতি দোকানটি চালাচ্ছেন। বৃদ্ধ সত্তোরোর্ধ্ব। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করছেন। তাঁর সঙ্গীনী অসম্ভব চাঞ্চল্য ও হাসি মুখ নিয়ে সকলকে জুতো পরিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর বয়সের কারণেই তাঁর পায়ে হাত দেওয়ায় বেশ কুন্ঠিত হচ্ছিলাম বরং তিনিই কথা বলতে বলতে সেই আড়ষ্ট ভাবটা কাটিয়ে জুতার ফিতে বেঁধে দিলেন। আমার পায়ের আরাম দেখে তাঁর হাসিমুখে যে তৃপ্তি তা মনে করিয়ে দিচ্ছিল স্বামীজীর কথা, ‘ওয়ার্ক ইজ ওয়ারশিপ’।


 



মাউন্ট টিটলিস


এবার ছুট একেবারে উপরের তলায়। ঘেরাটোপ থেকে বাইরে বেরোতেই দমকা ঠান্ডা হাওয়া অনুভব করলাম। মাথার ওপর লেখা টিটলিস ৩০২০ মিটার ১০০০০ ফুট। বুঝলাম আনন্দে ঠিক কী করব ভেবে পাচ্ছি না। চারিদিকে সাদা বরফ। পাহাড়ের ঢালের দিকে লোহার দড়ি দেওয়া রয়েছে। সৌরেন্দ্র আর সৌম্যজিৎ দ্রুত একটা গান শ্যুট করে নিল। ওই বরফের ওপরেও ওদের ট্রেডমার্ক পোশাক সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরেই শ্যুট হল। শ্যুটিং টুকু দ্রুত সেরে আবার পরে নেওয়া হল গরম পোশাক। এবার এগিয়ে গেলাম ক্লিফ ওয়াকের দিকে। দুটো পাহাড়ের মাঝে খাদের ওপরে লোহার দড়ির সেতু। তার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। ভার্টিগো রোগীদের পক্ষে সেই দুলন্ত সেতু এ মাথা ও মাথা পেরতে বেশ বুক দুরুদুরু করার কথা। এই ব্রিজের পাশেই রয়েছে আইস ফ্লায়ার। আরেক কেবল কার তবে তা চেয়ারের মতো। ছ’জন একসঙ্গে বসতে পারেন। পায়ের তলাও ফাঁকা, সামনেটাও আবরণহীন। তখন আমরা উত্তেজনার তুঙ্গে। আমরা পাঁচজন একটায় চেপে বসলাম। সৌরেন্দ্রর হাতে মেলোডিকা ছিলোই। ঝুলন্ত অবস্থায় সবাই গান গাইলাম। বহু নিচে তখন বরফের চাদরে আঁকিবুকি কেটে স্কি করে চলেছেন বেশ কিছু মানুষ। চেয়ার লিফট থেকে নেমে তখনো হাতে অনেকটা সময় রয়েছে। তাই বাঙালির প্রিয় বরফ ছোঁড়া খেলা এবং অবশ্যই তার ছবি তোলা হল। ততক্ষণে ঠান্ডায় হাত জ্বালা করতে শুরু করেছে। এবার বিদায় জানানোর পালা।


 



মাউন্ট টিটলিস


কিন্তু তখনো একটা জিনিস রয়ে গিয়েছে। গ্লেসিয়ার কেভ অর্থাৎ হিমবাহ গুহা ঘুরে দেখা হয়নি। একটা হিমবাহের ভেতরে সুড়ঙ্গ করে তার ভেতর দিয়ে কয়েকশো মিটার যাত্রীদের হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মেঝে থেকে দেওয়াল, ছাদ সবই বরফের। বরফে পা পিছলে যাওয়া থেকে বাঁচতে একদিকে রেলিং লাগানো আছে। রেলিং ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে হয়। আবার বরফের সিংহাসনে চেপে বসে ছবি তোলার ব্যবস্থাও রয়েছে। সব রকমের দস্যিপনা সেরে অ্যাপেল পাই আর কয়েক চুমুক গরম কফি। কাঁচের ঘেরাটোপে হিটারের আঁচে বসে তিন হাজার মিটার উচ্চতায় বরফে মোড়া মাউন্ট টিটলিসকে বেশিক্ষণ দেখার সৌভাগ্য হল না। দোকানি রীতিমতো তাড়া দিচ্ছেন দোকানপাট বন্ধ করে সবাইকে তো নামতে হবে। ফেরার পথে গোটা রাস্তাটাই আমরা প্রায় বাক্যহীন বসে ছিলাম। এতক্ষণ যা দেখলাম তাকে যেন মনের হার্ড ড্রাইভে সেভ করে রাখছিলাম। জুরিখ ফিরে রাতে গরম ভাত আর সৌম্যজিৎ-এর হাতের চিকেন কারি।


আরও পড়ুন- 'বাগানে নেমে এসে দেখি এক কোণে বসে মিটিমিটি হাসছেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ'


চলবে...


এবিপি আনন্দ এখন টেলিগ্রামেও, ক্লিক করুন এই লিঙ্কে
https://t.me/abpanandaofficial