কলকাতা : তৃতীয় ওয়েভে শিশুরা কতটা সঙ্কটে পড়তে পারে ? আতঙ্ক চেপে বসেছে অভিভাবকদের মনে। এর মধ্যে শিশুরা এখনও করোনার টিকা পায়নি এদেশে। তাই থার্ড ওয়েভ কি সজোরে কামড় বসাবে কচিকাঁচাদের উপর ? এই নিয়ে প্রমাদ গোনার মাঝেই আরেক আতঙ্ক নাড়িয়ে দিচ্ছে সকলকে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউতে যে শিশুরা আক্রান্ত হয়েছিল, চিন্তায় ফেলছে তাদের করোনা-পরবর্তী অসুখ। সম্প্রতি জেলা-জেলা থেকে খবর আসছে শিশুদের কোভিড পরবর্তী হৃদপিণ্ডের জটিলতা নিয়ে। কী উপসর্গ ? কখন সতর্ক হতে হবে ? উপসর্গ দেখার পর সময়মতো চিকিত্‍সা না করালে হতে পারে প্রাণহানিও? আলোচনায় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়দেব রায় ( professor and head of pediatrics, ICH, Kolkata)


 করোনা আক্রান্ত শিশুদের পোস্ট কোভিড জটিলতা কপালে ভাঁজ ফেলেছে চিকিত্সকদের। তাঁরা বলছেন, বড়দের ক্ষেত্রে যেমন ফুসফুসের ওপর প্রভাব পড়ছে, তেমনই শিশুদের ক্ষতি হচ্ছে হৃদপিণ্ডের, সেই সঙ্গে ভয় ধরাচ্ছে অন্যান্য অঙ্গের সমস্যাও।  


তবে ৩ থেকে ১২ বছরের শিশুদের মধ্যে করোনা পরবর্তী জটিলতা বেশি দেখা দিচ্ছে। মাল্টি সিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোম ইন চিলড্রেন (Multi System inflammatory syndrome - MIS-C) । একেবারে সদ্যোজাত থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছানো ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই এই রোগ দানা বাঁধতে দেখা যাচ্ছে।করোনার ৩-৪ সপ্তাহের মাথায় নানারকম উপসর্গ নিয়ে আসছে শিশু। দেখা যাচ্ছে হৃদপিণ্ডের সমস্যা। তবে ডা. জয়দেব রায় জানালেন, এই নিয়ে অহেতুক আতঙ্কিত হওয়া নিষ্প্রয়োজন। কারণ, শিশুদের মধ্যে যাঁরা করোনা সংক্রমিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে খুব অংশই এই রকম উপসর্গ নিয়ে পরবর্তী কালে আসছে। তাছাড়া, প্রাথমিক স্তরে রোগীকে নিয়ে আসতে পারলে বড় ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।  


চিকিত্সক রায় জানালেন, হৃদপিণ্ডের সমস্যা নানারকম হতে পারে। যেমন - 


- কার্ডিয়াক ভালবে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ হতে পারে। যাকে বলে ভালভালাইটিস (valvulitis)। 
-হার্টের পেরিকার্ডিয়ামে ( inflammation of the pericardium) সমস্যা দেখা দিতে পারে। যাকে বলা হয় পেরিকার্ডাইটিস (pericarditis)।
- করোনারি আর্টারিতে ইনফ্লামেশন দেখা দিতে পারে। 
- পেরিকার্ডিয়ামের দুই স্তরের মাঝে জল জমতে পারে
- হার্ট এনলারজমেন্টে সমস্যা হতে পারে
করোনা আক্রান্ত হয়েছিল, এমন শিশুরা যখন নিম্নলিখিত উপসর্গ নিয়ে চিকিত্সকদের কাছে আসেন, তখন বেশ কিছু পরীক্ষা করে দেখা হয়। তার মধ্যে চেস্ট এক্স রে, ইকো, ইসিজি ইত্যাদিও থাকে। এই পরীক্ষাগুলি করলেই ধরা পড়ে যায় শিশুর হার্টে কোনও সমস্যা দেখা দিচ্ছে কি না। সেই সঙ্গে আরও একটি পরীক্ষা করাতে হচ্ছে সেটি হচ্ছে ইনফ্লামেটরি মার্কার। যদি দেখা যায় শরীরে ইনফ্লামেটরি মার্কারগুলি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি, আছে তাহলে বুঝতে হবে শিশুটি এই অসুখে আক্রান্ত । চিকিত্সকদের একাংশের দাবি, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না শুরু করতে পারলে হৃৎযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে শিশুর। প্রাথমিক স্তরেই সমস্যা ধরা পড়লে ওষুধেই কাজ হবে। কিন্তু রোগী একবার শক স্টেটে চলে গেলে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। 


কী কী উপসর্গ মূলত দেখা যাচ্ছে ? 


- তিন চারদিন ধরে ওষুধ খেয়েও জ্বর কমছে না । জ্বরের কোনও কারণ বোঝা যাচ্ছে না । এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকেও কাজ হচ্ছে না । ক্রমে শরীর দুর্বল হয়ে - কনজাংটিভাইটিস এর মত চোখ লাল,  কিন্তু পুঁজ নেই ।
- ঠোঁট ফেটে যাচ্ছে। লাল হয়ে থাকছে।
- গায় Rash দেখা যাচ্ছে।
- গলার গ্ল্যান্ড ফোলা দেখা যাচ্ছে ।
-  বমির প্রবণতা
- ডায়রিয়া
- পেটে যন্ত্রণা
- শ্বাসকষ্ট
- বুক ধড়ফড় করা
- দ্রুত শ্বাস নেওয়া
- ত্বকে গুটি গুটি rash
- শরীর অবসন্ন ভাব
- মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিচ্ছে


সবাইয়েরই যে সব উপসর্গ দেখা দিচ্ছে এমনটা মোটেই নয়। তবে এর মধ্যে যে কোনও কয়েকটি উপসর্গ দেখলেই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের মত নিতে হবে। চিকিত্সক রায় জানালেন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, শিশু যে করোনা আক্রান্ত হয়েছিল, তা জানেনই না মা-বাবা। কারণ, নয় শিশু উপসর্গহীন ছিল, নইলে পরীক্ষা করানো হয়নি। শরীরে করোনার অ্যান্টিবডির অস্তিত্ব থাকলেই বোঝা যাবে শিশু সাম্প্রতিক কালে করোনা আক্রান্ত হয়েছিল। 


পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে পদক্ষেপ করেছে শহর ও জেলার বেশ কিছু হাসপাতাল। তৃতীয় ওয়েভের কথা ভেবে শিশুদের জন্য পৃথক করোনা ওয়ার্ড। সম্প্রতি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জানিয়েছে, গত ২ মাসে মাল্টি ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম নিয়ে ৩০ জন শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে। 
তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে এক জনের। 


চিকিত্সক জয়দেব রায় জানালেন ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে এই সমস্যাগুলি নিয়ে অনেক শিশুই ভর্তি হয়েছে ঠিকই, তবে তাদের সিংহভাগই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। তবু বাড়াবাড়ি হওয়ার আগেই সতর্ক হয়ে হবে, যাতে বাড়ির ছোট্ট সদস্যটিকে আইসিইউতে ঢুকতে না হয়। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, Multi System inflammatory syndrome কিন্তু ছোঁয়াচে নয় ! 

Photo : https://pixabay.com/