কলকাতা : ব্রেইন টিউমার মানেই আতঙ্ক ... মৃত্যু ভয় ... চিকিত্সা খরচ নিয়ে আশঙ্কা। কিন্তু বর্তমান চিকিত্সা পদ্ধতিতে ব্রেইন টিউমার সারিয়ে তোলা আগের থেকে অনেকটাই সহজ। সৌজন্যে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও চিকিত্সা ব্যবস্থা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের টিউমরের অপারেশনে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকারও প্রয়োজন পড়ে না। এই বিষয়ে সবিস্তারে জানাচ্ছেন, ডা. শুভমিত্র চৌধুরী (Assistant Professor, Neurosurgery, IPGME&R Kolkata and Bangur Institute of Neurosciences)। 

চিকিত্সার পরিভাষায়, মস্তিষ্কের টিউমারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।ম্যালিগন্যান্ট ও বিনাইন। ম্যালিগন্যান্ট টিউমার আবার প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি হয়। সেকেন্ডারি অর্থাত্ শরীরের অন্য অঙ্গ থেকে এসে মস্তিষ্কে ছড়ায় যে টিউমার। এক্ষেত্রে  শরীরের অন্য কোথাও ক্যান্সার হয়েছে তার থেকেই কর্কট রোগের সেল ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কে । প্রাইমারি অর্থাত্ যে টিউমর ব্রেইনেই তৈরি হয়। নন ক্যান্সারাস ব্রেইন টিউমারে ভয় কম।


এছাড়া আরও দুটি ভাগে ব্রেইন টিউমারকে ভাগ করা হয় । এক, ইনট্রিনসিক ব্রেইন টিউমার, যার উত্পত্তি মস্তিষ্কেই । আরেকটি হলো এক্সট্রিনসিক ব্রেইন টিউমার যা মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযুক্ত স্থানে হয়ে থাকে (cranial nerve, pituitary or meninges)। ইনট্রিনসিক  ব্রেইন টিউমার এর মধ্যে যেগুলি GLIOBLASTOMA  প্রকৃতির, সেগুলি সব থেকে বেশি ভয়ঙ্কর এবং সে ক্ষেত্রে রোগীর সেরে ওঠা বেশ কঠিন । তবে কোনও ব্রেন টিউমারের চিকিৎসা তা কতটা জটিল,  সারিয়ে তুলতে কী পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন তা একেবারেই মাথার খুলির মধ্যে টিউমার ঠিক কোন জায়গায় হয়েছে এবং প্রকৃতি কেমন তার উপরেই নির্ভর করে।

চিকিৎসকদের পরামর্শ,  উপসর্গ দেখলে  তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করানো দরকার। বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তরে টিউমার ধরা পড়লে তা সারিয়ে তোলা সম্ভব। আবার কিছু টিউমার পুরোপুরি অপারেশন করে বাদ দিলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় প্রভাব পড়তে পারে , এতে করে তাঁর বাকি জীবনটা খুবই অস্বাভাবিক হতে পারে । তাই এ ধরনের টিউমারের কিছুটা অংশ  অপারেশন করে বাদ দেওয়া যায়। তাতে কিছুটা অন্তত উপকার হয়। 

টিউমার অপারেশনের অনেকগুলি নতুন পদ্ধতি এসেছে যাতে, চিকিত্সা অনেক সহজ হয়েছে। যদি ব্রেইন টিউমার মস্তিষ্কে এমন একটি জায়গায় হয় যা অস্ত্রোপচার করা সম্ভব, সে ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা হয় ।সব ধরনের টিউমারের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব নয়। যদি সেটা মস্তিষ্কের খুবই গভীরে হয়, তাহলে অপারেশন করা কঠিন হয় ।

টিউমার থেকে মুক্তির নানা উপায় : 

কিছু কিছু ক্ষেত্রে টিউমার হয় খুবই ছোট এবং সহজেই তা কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া যায় । যা বাদ দিলে মস্তিষ্কের অন্যান্য টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।  অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক থেকে টিউমার বার করে আনা কঠিন ।  সে ক্ষেত্রে অন্য চিকিৎসা পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে । অনেক সময় টিউমারের একটা অংশও যদি কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া যায় তাহলেও অনেক উপসর্গ এবং ক্ষতি হ্রাস পায়।

অত্যাধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র গুণে, নয়া  প্রযুক্তি ব্যবহার করে, খুব কম কাটাছেঁড়ার মাধ্যমে টিউমার অস্ত্রোপচার করে বাদ দিয়ে দেওয়া সম্ভব ( Minimally Invasive Scarless Brain Surgery )। এই ধরনের অস্ত্রোপচারে হাসপাতালে থাকতে হয় কম সময়। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারে রোগী।  সর্বোপরি এ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা নিতান্তই কম।


এছাড়াও আছে রেডিয়েশন থেরাপি (Radiation therapy) । হাই এনারজি বিম ব্যবহার করা হয় এতে। যেমন X-rays or proton টিউমারের টিস্যুগুলিকে নষ্ট করে দেয়। বাইরে থেকে রেডিয়েশন মস্তিষ্কের ভিতরে দেওয়া যায়।  যেখানে টিউমারটি রয়েছে সেই জায়গাটিতেই এসে পৌঁছায় রেডিয়েশন, কোষগুলিকে ধ্বংস করে। শরীরে অন্য কোথাও থেকে ক্যান্সার যদি মাথায় ছড়ায় তাহলে এই ধরনের রেডিয়েশন থেরাপির মারফত টিউমার নিষ্ক্রিয় করা যেতে পারে ।

এছাড়া আছে রেডিও সার্জারি (Stereotactic radiosurgery ) পদ্ধতি। স্টিরিওট্যাকটিক রেডিও সার্জারি এক ধরনের পদ্ধতি, যা খুব ছোট্ট জায়গায় থাকা টিউমারের কোষগুলিকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে।  রেডিও সার্জারির বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে যেমন Gamma Knife,  cyberknife  , X knife ,    linear accelerator  প্রভৃতি পদ্ধতি ব্যবহার করে রেডিও সার্জারি করা যায়। এছাড়াও কিছু কিছু টিউমারের কোষ ধ্বংস করতে কেমোথেরাপির সাহায্য নিতে হয় । বেশ কিছু ব্রেইন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি এখন একটা ট্যাবলেট খেলেই হয়ে যায়, Temozolomide। কেমোথেরাপির সাইডএফেক্ট নির্ভর করে টিউমারের ধর্ম এবং কতটা ডোজ রোগীকে দেওয়া হল,  তার উপরে । কেমোথেরাপি ফলে বমির প্রবণতা বা চুল পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। 


একটি ভাবনার সব সময় মাথার মধ্যে খেলা করে ব্রেইন টিউমার মানে কি মৃত্যু ? ডাক্তাররা বলছেন না একেবারেই নয় । অনেক সময়ই টিউমার বিনাইন হয়।   তাই যত তাড়াতাড়ি টিউমার ধরা পড়বে , ততটাই তাড়িতাড়ি সারিয়ে তোলা যাবে রোগীকে। তবে মস্তিষ্কই যেহেতু শরীরের পরিচালক, তাই এর যে কোনও সমস্যাই যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন।