কলকাতা: ‘আমার শরীর আমার জার্নাল, আর আমার প্রতিটি ট্যাটু আমার এক একটা গল্প’, উল্কি প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছিলেন হলিউড তারকা জনি ডেপ। উইকিপেডিয়া বলছে, উল্কি বিশ্বের প্রাচীনতম শিল্প মাধ্যমগুলোর একটি। যা শুরু হয়েছিল আনুমানিক ১২ হাজার বছর আগে। নব্যপ্রস্তর যুগ থেকেই এই শিল্পের প্রচলন। মূলত ইউরোপেই উল্কির আবিষ্কার হয়। সেই দৃষ্টান্তের সাক্ষ্য  বহন করছে  ৩৩৭০ থেকে ৩১০০ বিসির এক মমি। গ্রিনল্যান্ড, আলাস্কা, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চিন, ইজিপ্ট, সুদান, ফিলিপিন্স-এও উল্কির প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। ভারতে উল্কির প্রচলন অনেক পরে হলেও তা ছিল সংস্কৃতির অঙ্গ এবং কিছু ক্ষেত্রে এখনও তাই। দক্ষিণ ভারত বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে উল্কির প্রচলন ছিল সবথেকে বেশি। শরীরে আঁকা স্থায়ী উল্কিকে বলা হয় ‘গোদনা’। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে উল্কি করার রীতি ছিল এবং কিছু বিশেষ আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে আজও তা সামাজিক অঙ্গ।


বিশ্বায়নের দৌলতে সেই উল্কা সংস্কৃতিই বাঙালির হালফিলের ফ্যাশন এবং একইসঙ্গে ‘ব্রেড অ্যান্ড বাটার’-ও। যত সময় এগিয়ে যাচ্ছে চাহিদা বাড়ছে, বাজারও বড় হচ্ছে। একই সঙ্গে তফাৎ হচ্ছে শিল্প আর শিল্পীসত্ত্বার।


‘ট্যাটু আর্টিস্ট’ – এই পরিচিতিতে আজ যতটা স্বচ্ছন্দ বোধ করা যায়, আজ থেকে দশ বছর আগেও তেমনটা করা যেত না। ‘ফরএভার পোয়েট্রি’-র অনির্বাণ রায় চৌধুরীর অভিজ্ঞতা,   “কর্মাশিয়াল কাজ করলে রোজগার বেশি, তবে ‘আর্ট পিস’ হিসেবে তুলনায় আয় কম। অন্যদিকে ‘মেইন স্ট্রিম’ পেশা হিসেবে ‘ট্যাটু’ এখন যেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, প্রথমে সেটা একেবারেই ছিল না। ফিনানসিয়াল সাপোর্ট না থাকলে কাজটা কঠিন।”



‘থ্রি কিউব ট্যাটু’ – র রাজদ্বীপ পাল আবার যেমন বলছেন, “রাশিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলোতে ট্যাটু আর্টিস্টদের লাইসেন্স করাতে হয়। ট্যাটুর জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভারতে এমন কোনও প্রতিষ্ঠান না থাকায় যে কেউ চাইলেই শুধু ট্রেড লাইসেন্স বার করে ব্যবসা করতে পারে।” যার ফলে  একদিকে যেমন শিল্প এবং শিল্পভিত্তিক বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি নিয়েও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে করোনার মতো অতিমারীর সময়ে স্বাস্থ্যবিধির উপর আরও বাড়তি নজর দেওয়ার কথা বলছেন তিনি। ‘ক্রস কনটামিনেশন’ রুখতে পুনর্বার ব্যবহার করা যায় এমন পণ্য ব্যবহার না করা, একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া যায় এমন পণ্য ব্যবহার করা এবং নিয়মিত স্যানিটাইজেশনের কথা বলছেন রাজদ্বীপ। একই কথা বলছেন অনির্বাণও। যদিও তাঁদের বক্তব্য, উল্কি করার সময় স্টুডিও-র ভিতরে ক্লায়েন্ট ছাড়া কেউ থাকছেন না। যারা আসছেন প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট সময়েই আসছেন। আর ‘ওয়াক ইন ক্লায়েন্ট’ বা ‘ফ্লাইয়িং কাস্টমার’-এর কাজও সেভাবে তাঁরা করেন না। সেদিক থেকে দেখা গেলে ‘ফরএভার পোয়েট্রি’ এবং ‘থ্রি কিউব ট্যাটু’ তাদের শিল্পের মতো স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রেও কোনওরকম ‘কম্প্রোমাইজ’ করে না।



কলকাতায় এক দশক ধরে ‘ট্যাটু পার্লার’ হিসেবে কাজ করছে ‘লিজার্ডস স্কিন ট্যাটু’। সুপরিচিত এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নিলয় দাসের কথাতেও একই সুর। ‘হাইজিনকে সর্বাধিকার’। নিলয়ের কথায়, “প্যানডেমিক বলে নয়, ট্যাটুর ক্ষেত্রে যে নিডল, ইঙ্ক এবং গিয়ারস ব্যবহৃত হয়, তা  একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয়।”  


কলকাতার এই ট্যাটু জেনারেশন একমত হয়েছে, ‘উল্কির জগৎ’-এ সুযোগ রয়েছে তবে তার জন্য অবশ্যই হতে হবে সৃষ্টিশীল। কেবল মাত্র কপি পেস্ট করলে চলবে না। নিজের স্বতন্ত্রতা এবং ভাবনাচিন্তার বিকাশ আবশ্যক।


একই সঙ্গে উল্কি করানোর ক্ষেত্রেও যে নির্দিষ্ট ভাবনার প্রয়োজন সেকথাও বলছেন তাঁরা। আগে শুধু ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসেবেই ট্যাটুকে দেখা হত। এখন সেই ভাবনার বদল হয়েছে। নিজের জীবনের সঙ্গে থেকে যাবে, এই ভাবনা সবার মধ্যে না আসলেই সিংহভাগই বুঝতে পারছেন, “সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে, তবে ট্যাটু কিন্তু থেকে যাবে।”


অনির্বাণ, নিলয় কিংবা রাজদ্বীপ – অন্যের সৃষ্টি থেকে অনুপ্রাণিত হন ঠিকই তবে অনুকরণ করেন না। অনুজদের প্রতি অগ্রজদের বার্তা – স্টুডিও সিনিয়র আর্টিস্টদের থেকে শিখতে হবে। ইউটিউব, ইনস্টা, ফেসবুকে অনেক কাজ দেখলেও তা বাস্তবায়িত করার জন্য স্টুডিও ছাড়া গতি নেই। খরচ হবে ঠিকই, তবে কোনও কিছু পেতে হলে, আয়ত্ত করতে হলে বিনিময়ে কিছু দিতেই হবে। নিলয়ের কথায়, “ডাক্তার হতে গেলে একজনকে ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়, সেখানে ৬ মাস কিংবা একবছরের কোর্সের জন্য একটা স্টুডিও ২ লক্ষ টাকা নেয়। এটা তো দিতেই হবে।”