সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা: আজ শিবরাত্রি (Mahashivratri)। ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি ব্রত পালন করা হয়। গৃহীরা যেমন শিবের পুজো করেন তেমনি সন্ন্যাসীদের কাছেও শিবরাত্রি এক মহোৎসব। একদল পন্ডিত মনে করেন শিব হলেন অনার্য দেবতা। দক্ষযজ্ঞ করে তিনি আর্য সমাজে স্থায়ী আসন করে নেন। বেদে শিবের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে সেখানে রুদ্র নামের উল্লেখ রয়েছে। পন্ডিতদের মতে বৈদিক রুদ্র এবং পৌরাণিক শিব আসলে অভিন্ন। শিব কৈলাসবাসী হলেও হিমালয়ের কোলে যেমন ছড়িয়ে রয়েছে পঞ্চকেদার, তেমনই ভারতের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে শিবের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে কোন জ্যোতির্লিঙ্গ না থাকলেও আমাদের পড়শি রাজ্য ঝাড়খন্ডে রয়েছে বৈদ্যনাথ ধাম।


দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধাম (Baidyanath Dham) একই সঙ্গে সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম সতীপীঠ, আবার দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। শিবপার্বতীর মিলনগাথায় সমৃদ্ধ এই দেবস্থান। এখানে শিব-পার্বতী মুখোমুখি বসে আছেন। তাই ভক্তরা দুই মন্দিরের মাথার ওপরে লাল সুতো বেঁধে দিয়ে নিজের মনস্কামনা পূরণের জন্য মানত করেন। 


শিব এখানে বৈদ্য অর্থাৎ চিকিত্‍সকদের দেবতা। রাখাল বালক বৈজু তাঁর দেখাশোনা করতেন বলে তিনি বৈজনাথ। আবার পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে রাবণ তাঁকে এখানে এনেছিলেন বলে তিনি রাবণেশ্বর। 


রাবণের নিত্যপুজোয় খুশি হয়ে শিব স্বয়ং তাঁর সঙ্গে কৈলাস ছেড়ে লঙ্কায় যেতে রাজি হন। শর্ত একটাই মাথায় করে নিয়ে যেতে হবে আর পথে কোথাও রাখা যাবে না। শিব কৈলাস ছেড়ে যাচ্ছেন শুনে পার্বতী এক ফন্দি করলেন। পার্বতীর নির্দেশে স্বয়ং বরুণদেব আচমনের জলে রাবণের উদরস্থ হলেন। এবার সেই গঙ্গাজল প্রস্রাবরূপে বের হতে চাইলে, রাবণ পড়লেন মহাবিপদে। এবার শ্রীবিষ্ণু রাখাল সেজে হাজির রাবণের সামনে। তাঁকে শিলাটি ধরতে দিয়ে রাবণ বসলেন শৌচকর্মে। রাবণ যতক্ষণে শৌচ সেরে ফিরে এলেন, ততক্ষণে বালক আর শিবকে ধরে রাখতে পারেননি। রাবণও আর শিবকে সেখান থেকে তুলে লঙ্কায় নিয়ে যেতে পারলেন না। রাবণ শিবকে মাটি থেকে তুলতে না পেরে তাঁর মাথায় আঘাত করলেন। আজও এখানে শিবের মাথায় হাত বোলালে রাবণের আঙুলের চিহ্ন অনুভূত হয়। 


আরও পড়ুন, শিবরাত্রির চারপ্রহরে চারবার পূজায় তুষ্ট হন মহাদেব, না করতে পারলে কী উপায় ? কোন মন্ত্র


প্রতিদিন ভোর চারটেয় মন্দির খোলে। প্রথমে পান্ডারা শুধুমাত্র জল দিয়ে পুজো করেন। এরপর ষোড়শোপাচারে সরকারি পুজো হয়। ষোড়শ উপাচারের পুজোর পর সাধারণ ভক্তরা মন্দিরে ঢুকে নিজের মতো করে পুজো করতে পারেন। দুপুরে হয় রুদ্রাভিষেক।বিকেলে মন্দির চত্বরের প্রতিটি মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে গোটা চাতাল জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়। সাঁঝের বাতি জ্বলে উঠলে বৈদ্যনাথ-পার্বতী-সহ সমস্ত মন্দিরে শুরু হয় সন্ধ্যারতি। সেই দৃশ্য চাক্ষুষ করতে ভক্তের স্রোত উপচে পড়ে মন্দির চত্বরে।             


পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে পার্বতী একবার শিবের কাছে জানতে চান কোন ব্রত পালনে শিব সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। তার উত্তরে শিব ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণচতুর্দশী তিথির উল্লেখ করেন। 


শিবরাত্রি আসলে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত রাতের চার প্রহরের পুজো। প্রত্যেক প্রহরে আলাদা আলাদা জিনিস দিয়ে শিবের স্নান করানো হয় এবং আলাদা আলাদা মন্ত্রের সঙ্গে অর্ঘ্য প্রদান করা হয়।


শিবরাত্রির প্রথম প্রহরে শিবকে দুধ দিয়ে স্নান করানো হয়। যার মন্ত্র-
‘ইদং স্নানীয়দুগ্ধং ওঁ হৌঁ ঈশানায় নম:’
দ্বিতীয় প্রহরে দই দিয়ে শিবকে স্নান করানো হয়। যার মন্ত্র-
‘ইদং স্নানীয়ং দধি ওঁ হৌঁ অঘোরায় নম:’
তৃতীয় প্রহরে শিব কে ঘি দিয়ে স্নান করানো হয়। যার মন্ত্র-
 ‘ইদং স্নানীয়ং ঘৃতং ওঁ হৌঁ বামদেবায় নম:’
চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে স্নান করানো হয়। যার মন্ত্র-
 ‘ইদং স্নানীয়ং মধু ওঁ হৌঁ সদ্যোজাতায় নম:’ 
চার প্রহরের পুজো শেষে শিবমহিম্ন স্তোত্র পাঠ বিধেয়।