পল্লবী দে, কলকাতা: বড়দিন আসছে। বিশ্বজুড়েই সাজ সাজ রব। ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশে বরফের মধ্যেই উৎসবের প্রস্তুতি তুঙ্গে। পিছিয়ে নেই বিশ্বের বাকি মহাদেশেরাও। এমনকী প্রতিবছরের মতো এ বছরও আলোকমালায় সেজে উঠেছে পার্ক স্ট্রিট। এতকিছুর মধ্যেই বড়দিনে অপেক্ষা থাকে যার, তিনি হলেন সকলের প্রিয় সান্তাক্লজ। এমন এক 'ঐতিহাসিক' চরিত্র নিয়ে কাহিনিও কিছু কম নেই। রয়েছে নানা দার্শনিক ভাবনাও। তবে সান্তাক্লজের অস্তিত্ব নিয়ে দ্বিমত থাকলেও একাধিক গ্রন্থ, ডাচ লোককাহিনি থেকে জানা যায় সান্তাক্লজ রূপকথার গল্প নয়।



এক এক মহাদেশ, উপমহাদেশে সান্তাক্লজের এক এক কাহিনি রয়েছে। তবে এটি সত্য যে আজকের লালটুপি পরিহিত এক দাঁড়িওয়ালা বুড়ো, যিনি ছোট থেকে বড়, সকলের সান্তা, তিনি এমন দেখতে ছিলেন না। তাঁর আসল নামও সান্তাক্লজ নয়। তবে কীভাবে তিনি সকলের জন্য আনন্দের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠলেন সে কাহিনি জানতে বেশ কিছু লোককথায় ডুব দিতে হবে।    

এখনের যে এলাকা টার্কি নামে খ্যাত, চতুর্থ শতকে সেখানে এক ছোট্ট বন্দর ছিল, শহরটির নাম মায়রাহ। সেখানেই থাকতেন এক ক্রিশ্চান বিশপ সেন্ট নিকোলাস। সমুদ্র সফরের আগে নাবিকেরা তাঁর কাছে থেকেই আশীর্বাদ নিতেন, এমনকী সদ্যবিবাহিতেরা আসতেন তাঁর আশীষ পেতে। কালে কালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সন্ত নিকোলাস। লিসিয়ায় প্রকাশিত একটি বই- "Life, Works, and Miracles of our Holy Father Nicholas, Archbishop of Myra" থেকে জানা যায় তিনি ছোট থেকেই দেবত্ব স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। যদিও একটি ঘটনা যা তাঁকে 'সান্তা' তৈরি করেছে, সেটিরও উল্লেখ রয়েছে। জানা যায়, ওই শহরেই এক হত দরিদ্র পরিবার ছিল। তিন মেয়ের বিয়ের দেওয়ার মত ক্ষমতাও ছিল না সেই পরিবারের। টাকা যোগাড় করতে মেয়েদের পতিতালয়ে পাঠানোর ভাবনাও ছিল তাঁদের বাবার। সেই কথা গোপনে কানে আসে নিকোলাসের। এরপর রাতে ওই ব্যক্তির ঘরে গিয়ে নিজের টাকার ব্যাগ রেখে আসেন নিকোলাস। পরের দিন সেই টাকা পেয়ে ব্যক্তি ভাবেন বোধহয় তা ঈশ্বরের দান। যদিও তৃতীয় কন্যার বিয়ের সময় ধরা পড়ে যান নিকোলাস। মুখে মুখে ফেরে তাঁর এই আনন্দ ফেরির বিষয়টি। এরপর ধীরে ধীরে ওই এলাকার সন্ত হয়ে ওঠেন নিকোলাস।

যদিও এই কাহিনির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক ইতিহাসবিদ। তবে এই বইয়ের উপসংহারে সেন্ট নিকোলাসকেই সান্তাক্লজে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। যিনি সকলের দু:খের পরিত্রাতা। গত দেড় হাজার বছর ধরে এমনভাবেই সান্তাক্লজকে দেখা হয়। যদিও এখন আমরা রঙিন পোশাক পরা যে সান্তা ক্লজকে দেখি সেই বইতে তেমন কোনও বর্ণনা পাওয়া যায় না। ১৮২৩ সালে ক্রিসমাস ডে উপলক্ষে আমেরিকার বিখ্যাত লেখক ক্লেমেন্ট ক্লার্ক মুরের লেখা ‘A visit from St. Nicholas’ কবিতায় আজকের সান্তার রূপ দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৮৮১ সালে থমাস ন্যাসট নামের একজন আমেরিকান কার্টুনিস্টের আঁকা ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর সান্তাক্লজের এই সাজ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়।

সেই ছবিতে দেখা যায় হরিণটানা গাড়িতে চড়ে কাঁধে উপহারভর্তি ঝোলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের উপহার দিচ্ছেন সান্তাক্লজ। বড়দিনে তাই তিনি এখন 'ফাদার খ্রিস্টমাস' হয়ে উঠেছেন সকলের কাছে।লোককথা অনুসারে তিনি সন্ত নিকোলাস থেকে সিন্টারক্লস এবং শেষে সান্তাক্লজ হয়ে উঠেছেন এই বৃদ্ধ। তাঁর উপহার পেতে বড়দিনের আগের দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে বিশ্বের সব শিশুরা।

তবে সান্তাকে সন্ত বলা যেতেই পারে। কারণ তিনি এমন এক চরিত্র, যিনি কোনও ধর্মের ভেদাভেদ মানেন না, দেশ-সীমান্ত-উৎসব কোনও কাঁটাতারই আটকাতে পারে না তার হরিণটানা গাড়িকে। সান্তা রয়েছেন আমাদের সকলের জীবনেই। ভাললাগা ছড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তিরাই তো হয়ে ওঠেন সান্তা। তবে ছোটবেলার সেই সান্তার আনন্দ বড়বেলায় ম্রিয়মাণ হলেও,  উদযাপন একই থাকে। সান্তা যেমন লোককাহিনিতে রয়েছেন, সান্তা তেমনভাবেই রয়েছেন বাস্তবেও। যিনি খুশি ছড়িয়ে দিতে আসেন সকলের জীবনে, সাদা-কালো জীবনে দেন একরাশ রঙ, একছটা আলো। তিনিই বড়দিনের আনন্দের ফেরিওয়ালা।

তথ্যসূত্র- 




"Santa Claus: History, Legend, & Facts"-  Encyclopedia Britannica


The Original 1860s Thomas Nast Santa Claus Illustrations

The World Encyclopedia of Christmas