কোনও রোগ থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে ওষুধের সঙ্গে প্রয়োজন সঠিক খাবার। নইলে ভিতর থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা কঠিন। একটি প্রাণ ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বাইরে থেকে পুষ্টি দিতে হয়। আর সেটা ইচ্ছেমতো হলে চলে না। একজনের শরীরের চাহিদা, তার বয়স, ওজন, পুষ্টিগ্রহণের ক্ষমতা - সবটাই দেখতে হয়। আর সেটা সঠিকভাবে বিচার করতে পারেন একজন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদই। 



১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হল National Nutrition Week । মানুষকে পুষ্টির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতেই এই জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ-যাপন। পুষ্টি নিয়ে সচেতনতা যেমন একজন প্রাপ্তবয়স্কের প্রয়োজন তেমনই দরকার সদ্যোজাতর ক্ষেত্রেও। আর সদ্যোজাতর পুষ্টির সরবরাহকারী যেহেতু তার মা-ই, তাই স্তনদায়ী মায়ের খাওয়া দাওয়া নিয়ে বিশেষ সচেতনতার প্রয়োজন আছে। 

বাচ্চা জন্মানোর পর থেকেই পরিবারের বড়রা নানারকম পরামর্শ দিতে থাকেন, যা অনেকটাই ব্যক্তিগত বা বহুযুগ ধরে চলে আসা নানারকম ধ্যানধারণার উপর নির্ভরশীল। দেখা গিয়েছে তার মধ্যে অনেকগুলি সম্পর্কেই ডাক্তার বা নিউট্রিশনিষ্টরা ভিন্ন মত পোষণ করেন। একজন সদ্যোজাত থেকে একজন সদ্য-মা কী খাবে, কী খাবে না, এই নিয়ে বিস্তারিত জানালেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অগ্নিমিতা গিরি সরকার।  


বাচ্চার ৬ মাস না হলে জল, মধু কিচ্ছু দেওয়া যাবে না
প্রথমেই একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিলেন ডা.গিরি। তিনি মনে করেন, শিশুকে ৬ মাস বয়স অবধি শুধুমাত্র মায়ের দুধই খাওয়াতে হবে। এমনকী জলটুকুও বাইরে থেকে দেওয়া যাবে না। এমনকী যাঁরা শিশুর 'মুখের কথা মিষ্টি হবে' এই বিশ্বাস থেকে মধু খাওয়ান, সেটাও করা যাবে না। মায়ের দুধের সঙ্গে ফর্মুলা মিল্ক খাওয়াতে শুরু করেন অনেকেই, সেটাও করা উচিত নয় বলেই মনে করেন তিনি। তাই এই সময় শিশুর পুষ্টির জন্য মাকেই শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকতে হবে। 


একজন সদ্য-মা কী খাবে, কী খাবে না 
তবে কি সদ্য-মা-হওয়া মহিলা বেশি বেশি করে খাবেন ? স্তন্যদায়ী মাকে সাধারণের তুলনায় বেশ কিছু ক্যালরি বেশি খাবার খেতে হয় ঠিকই, তবে ঠিক কত ক্যালরি খাবার তিনি বেশি খাবেন, তা কিন্তু ঠিক করতে একজন নিউট্রিশনিস্ট বা চিকিৎসকেরই পরামর্শ নিতে হবে। কারণ সেই মা আন্ডারওয়েট নাকি নর্মালওয়েট নাকি ওভারওয়েট, সেসব দেখেই ঠিক হবে সদ্যজাত শিশুর মায়ের খাদ্য তালিকা। 


 সারাদিনে ছোট ছোট মিল খান মায়েরা
পুষ্টিবিদরা বলছেন, সদ্যজাতর মাকে খেতে হবে বেশি করে ফল, শাকসবজি, গোটা শস্য, চর্বিহীন প্রোটিন এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি ।  বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত শক্তির । আর শক্তি আসে খাবার থেকেই। এই সময় শরীরের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন মাকে  ক্যালোরি ইনটেক প্রায় ৫০০-৭০০ ক্যালোরি বাড়াতে হবে। সন্তান জন্মের পর মায়ের ওজন, তাঁর খাবারের চার্ট সম্পর্কে একবার পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। বেশি খেয়ে ফেললে কিন্তু মা অতিরিক্ত ওজন বাড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। সারাদিনে ছোট ছোট মিল খেতে হবে, যাতে মায়ের শরীরে শক্তির মাত্রা বজায় রাখতে এবং দুধ উৎপাদনে সহায়তা করতে পারে। ডা. অগ্নিমিতা গিরি সরকার বলছেন, মায়েরা টক ফল খাবে না, তাতে সেলাই জুড়বে না - এই ধারণা এক্কেবারেই ভুল।


শিশুর ৬ মাস বয়স হলে কী খাবে, কী খাবে না 
এবার মাথায় রাখতে হবে, ৬ মাস তো শিশু মায়ের দুধ খেল। এরপর থেকে ধীরে ধীরে বাইরের খাবার দেওয়া শুরু করতে হবে। সেটাকে উইনিং ডায়েট ( weaning diet ) বলা হয়। ছোট্ট শিশু প্রথম যখন সলিড খাওয়া শুরু করল, তখন ফর্মুলা ফুড দিয়ে শুরু না-ই করা ভাল। ডা. অগ্নিমিতা গিরি সরকার বলছেন, শুরু হোক বাড়ির খাবার দিয়ে। 



  • শুরু করা হোক মিষ্টি ফল দিয়ে। আপেল, কলা ইত্যাদি নরম করে দেওয়া যেতে পারে। 

  • মুসম্বি বা কমলা লেবুর রস খাওয়াতে পারেন। 

  • এই সময় থেকে পানীয় জল খাওয়াতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে। 

  • গলা ভাতের সঙ্গে আলু সিদ্ধ, গাজর সিদ্ধ, রাঙালু সিদ্ধ, কুমরো সিদ্ধ, ইত্যাদি মিষ্টি জাতীয় সব্জি খাওয়ানো যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, বাচ্চার পাতে যেন সব রঙের সবজি থাকে। 

  • মুড়ি গুঁড়ো, চিঁড়ে সিদ্ধ ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। এরপর শিশু যত বড় হবে শিশুর খাদ্য তালিকায় যুক্ত করা যেতে পারে রুটির ফুলকা, সুজি ইত্যাদি ।

  • ডিমের কুসুম দেওয়া যেতে পারে, তবে শুরুতেই ডিমের সাদা নয়, তার থেকে অ্যালার্জি হতে পারে।

  • কাঁটা বেছে নরম মাছ খাওয়ানো যেতে পারে। 

  • শিশুর বয়স ১ বছরের কম হলে বাচ্চার খাবারে নুন-চিনি দেওয়ার দরকার নেই। কারণ বাবা-মা হয়ত মনে করেন, এতে বাচ্চার খেতে ভাল লাগবে। কিন্তু এত ছোট বাচ্চাদের মুখে স্বাদ আসে না। 

  • প্রাণিজ দুধ বা দুধজাত খাবার এড়িয়ে চলাই ভাল। কারণ ওই বয়সের একটা বাচ্চা গরুর দুধ হজম করতে পারবে না। গরুর দুধ বাছুরের জন্য হজম যোগ্য, কিন্তু সদ্যোজাত বা ১ বছরের কম বয়সী মানব-শিশুর জন্য গুরুপাক হয়ে যাবে, তা উপকারীও নয়। গরুর দুধ থেকে অনেক বাচ্চার অ্যালার্জি হতে পারে। 

  • যদি একজন বাচ্চা বাড়িতে তৈরি খাবারের থেকেই সুষম আহার পেয়ে যায়, তাহলে ফর্মুলা মিল্ক বা ফর্মুলা ফুড দেওয়ার দরকার পড়ে না। অনেক সময়ই এইসব ফর্মুলা-খাবার থেকে বাচ্চাদের অতিরিক্ত মেদ সঞ্চয় হয়। তার থেকে আসতে পারে চাইল্ড ওবেসিটি। 

    ডা. অগ্নিমিতা গিরি সরকারের মতে, একজন সদ্যোজাত আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠার পথে বারেবারে ডায়েটচার্টে পরিবর্তন হবে। সেইসঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে তার মায়ের খাদ্যতালিকাতেও। আর সেই পথ দেখাতে পারবেন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদই। তাই প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, পাড়া পড়শির পরামর্শ না শুনে সরাসরি একজন বিশেষজ্ঞের কথাই শুনুন।