সুব্রত মুখোপাধ্যায় : জয়পুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন নামলাম তখন ঘড়িতে সময় বলছে সাড়ে ছ’টা। বিকেল সাড়ে ছ’টা। বিকেল শব্দটা ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হলো ডিসেম্বরের শেষে আমাদের কলকাতায় যখন দিনের শেষে সন্ধ্যের ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে, তখনও জয়পুর (Jaipur) শহরে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে মাত্র। অস্ত যেতে আরও কিছুক্ষণ বাকি।  


এয়ারপোর্ট আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ডক্টর রমাকান্ত চতুর্বেদী। আদতে উত্তর ভারতের লোক হলেও দীর্ঘদিন প্রশাসনিক কর্তা হিসাবে জয়পুর শহরে তাঁর বাস। আমাদের নিতে তিনি স্বয়ং যে উপস্থিত হবে তা কল্পনাতেও আসেনি। অমায়িক এই প্রবীণ ভদ্রলোক এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল যাওয়ার পথে  গাড়িতে শোনালেন জয়পুর শহরের ইতিহাস।


মহারাজ মানসিংহ, আমের ফোর্ট, যন্তর মন্তর (Jantar Mantar) , হাওয়া মহল (Hawa Mahal), জলমহল, এসবের কাহিনী তো প্রায় প্রত্যেকেরই কম বেশি জানা।  কিন্তু চমকে গেলাম সেই অজানা কথা শুনে যা রাজস্থান বা জয়পুরে ঘুরতে গেলে কোন বাঙালি হয়তো জানতে পারেন না।  আধুনিক জয়পুর শহরের স্থপতি কোন রানা বা রাজপুত নয়, এক বঙ্গ সন্তান। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, এক ভটচাজ বামুনের হাতে তৈরি আজকের জয়পুর। শহরের দ্রষ্টব্য কী কী দেখার জিনিস কী আছে আর তার কী ইতিহাস প্রায় সকলেই অল্পবিস্তর জানেন।  বরঞ্চ শোনা যাক,  জয়পুর শহরের এক অজানা কাহিনী, জয়পুর তৈরীর ইতিহাস।




অম্বর ফোর্ট


রাজস্থানে ঘুরতে গেছেন অথচ জয়পুর যাননি এমন পযর্টক খুজে পাওয়া মুশকিল। প্রতিবছর জয়পুর ঘুরতে যান বহু বাঙালি। রাজধানী জয়পুর তার অপূর্ব নির্মাণ শৈলী ও আতিথেয়তায় অনবদ্য। অম্বর ফোর্ট, হাওয়া মহল, জলমহল, সিটি প্যালেস দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের পর্যটকের ঢল নামে। আধুনিক জয়পুর শহর নির্মাণের পিছনে রয়েছে বিদ্যাধর ভট্টাচার্য নামে এক বঙ্গসন্তানের অবদান। বস্তুত তাঁর পরিকল্পনাতেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম পরিকল্পিত শহর বা প্ল্যানড সিটি জয়পুর।


জয়পুর শহরের রূপকার হিসাবে মহারাজ জয় সিংহকে যতটা কৃতিত্ব দেওয়া হয় ঠিক ততটাই প্রাপ্য বিদ্যাধরের। নৈহাটি ভাটপাড়ার ভটচাজ বামুন বিদ্যাধর ছিলেন মহারাজ জয় সিংহর দেওয়ানজি বা মন্ত্রী। একজন জুনিয়ার অডিটর বা হিসাবরক্ষক হিসাবে  তিনি যোগ দিয়েছিলেন, কালক্রমে মেধা ও বুদ্ধির জোরে হয়ে ওঠেন মহারাজার ডানহাত।




সিটি প্যালেস


 


ভাটপাড়ার সন্তোষরাম  ভট্টাচার্যর ছেলে বিদ্যাধরের জন্ম ১৬৯৩ সালে। গণিত, জ্যোতিষ, বাস্তু, পূর্তবিদ্যায় দক্ষ বিদ্যাধর চাকরি করতে রওনা হন সুদূর রাজপুতানায়। অম্বর ফোর্ট বা আমের দুর্গের শাসক তখন মহারাণা দ্বিতীয় সওয়াই জয়সিংহ। ভাটপাড়া থেকে সুদূর রাজপুতনায় চাকরি করতে যাবার কারণ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়না। কবে বা কেন তিনি রাজস্থান গিয়েছিলেন তাও অজানা। তবে একটি মতে, মহারাণা দ্বিতীয় সওয়াই জয়সিংহর এক পার্ষদ  ছিলেন কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য। বিদ্যাধর কৃষ্ণরামের ভাগ্নে। ভট্টাচার্য পরিবার অম্বর ফোর্ট বা আমের দুর্গে বসবাস শুরু করে মহারাজ মানসিংহের আমল থেকে। ১৬০৪ সালে মানসিংহ বাংলা জয় করে ফেরার সময় আধুনা বাংলাদেশের যশোর থেকে শিলামাতা যশোরেশ্বরী বা বাংলার কালীমূর্তি অম্বর দুর্গে এনে প্রতিষ্ঠা করেন।


কথিত আছে, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে যুদ্ধে  হারিয়ে কালীমূর্তি অম্বরে আনলেও তা পুজো করার পুরোহিত ছিলনা। মা কালী মানসিংহকে স্বপ্নাদেশে বাংলা থেকে তাঁর  নিত্যপুজোর পুরোহিত আনতে আদেশ দেয়। স্বপ্নাদেশ শিরোধার্য করে, মানসিংহের আদেশে, যশোর থেকে হাতির পিঠে করে অম্বর দুর্গে আসে ভট্টাচার্য পরিবার । হাতির পিঠ থেকে যেখানে তারা নামেন, সেই জায়গা এখনও হাতিবাবুর বাজার নামে পরিচিত। মানসিংহর কাল থেকে ভট্টাচার্য পরিবার অম্বর দুর্গের বাসিন্দা।




অম্বর প্যালেস থেকে জয়পুর


ডক্টর রমাকান্ত চতুর্বেদী বলছিলেন, মহারাণা দ্বিতীয় সওয়াই জয়সিংহ ছিলেন মোগল সম্রাট ঔরাঙ্গজেবের ছেলে আজম শাহের ঘনিষ্ঠ। সম্রাট ঔরাঙ্গজেবের মৃত্যুর পর  যখন দিল্লির সিংহাসন দখল নিয়ে তার ছেলেদের  মধ্যে রেষারেষি শুরু হয়, তখন জয়সিংহ ছিলেন আজমের পক্ষে। কিন্তু ঔরাঙ্গজেবের অন্য ছেলেদের পিছনে ফেলে দিল্লির তখ্তে বসেন বাহাদুর  শাহ। ক্রদ্ধ আজম শাহ ব্যর্থতার জন্য জয়সিংহকে দায়ী করে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চান। কিন্তু অন্য মোগলদের সমর্থনে নিজের রাজ্য অটুট রাখেন দ্বিতীয় সওয়াই জয়সিংহ । এই সাফল্যের পর দ্বিতীয় সওয়াই জয়সিংহ অম্বরের রাজধানী পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেন। অম্বরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আর জলের অভাবও ছিল  রাজধানী পরিবর্তন করার অন্যতম কারণ। আরাবল্লী পাহাড়ের ঢালে মাওটা লেকের পাশে অম্বর প্যালেস থেকে বারো কিলোমিটার দূরে সমতলে এক নতুন নগর আর রাজধানী তৈরির কথা ভাবলেন তিনি। ডেকে পাঠালেন বিদ্যাধরকে। বললেন খুব কম সময়ের মধ্যে তৈরি করতে হবে ভারত সেরা এক শহর ও নতুন রাজধানী। নিরাপত্তা এবং শিল্পে যা হবে দেশের সেরা।




জল মহল


নতুন শহর পরিকল্পনায় ঝাপিয়ে পড়লেন বছর তিরিশের বাঙালি যুবক । প্রাচীন ভারতের সাহিত্য, বাস্তুশাস্ত্র থেকে শুরু করে টলেমি এবং ইউক্লিডের রচনার সারাংশ তুলে পরিকল্পনা করেন এক গ্রিড ভিত্তিক শহরের। যে শহরে থাকবে ভারতীয় শিল্পকলার নমুনা অথচ তা হবে আধুনিক মানের উন্নত শহর। শহরের নাম জয়পুর। জয়পুর মানে বিজয়নগরী।


কেমন ছিল জয়পুর শহরের পরিকল্পনা ? জয়পুর শহরের পরিকল্পনা, সেযুগের নিরিখে অনবদ্য। বিদ্যাধর পরিকল্পিত শহরের মোট জমিকে সাতটি ভাগে ভাগ করলেন। মাঝের একভাগ রইল নতুন রাজপ্রাসাদের জন্য। শহরের নিরাপত্তার জন্য তৈরি হল সাত দরজা সহ শহর ঘিরে বিরাট দুর্গ-প্রাচীর। শহরে প্রধান রাস্তা তিনটি। প্রতিটি রাস্তা সোজা, একেবারে নাক বরাবর । যেন ম্যাপে স্কেল বসিয়ে দাগ টেনে তৈরি রাস্তার মত। চওড়া সোজা রাস্তা অন্য রাস্তাকে কাটাকুটি করেছে নিঁখূত সমকোণে। বিদ্যাধর শহর পরিকল্পনা করেন ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্রকে মাথায় রেখে। সিটি প্যালেসকে বাদ দিয়ে পুরোশহর ছ’টি  সমান মাপের আয়তকার জমিতে ভাগ করা। শহরের তিনটি প্রধান দ্বার। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম। পূব দিকের দরজার নাম সূরজ পোল বা সূর্যদ্বার। পশ্চিম দিকে চাঁদপোল বা চন্দ্রদ্বার এবং অম্বর কেল্লার দিকে মুখ করা উত্তরের দরজা। প্রতিটি রাস্তা ৩৪ মিটার বা ১১১ ফুট চওড়া।  সিটি প্যালেস বা রাজবাড়ির কাছে হাওয়া মহল, বাগান ও একটি ছোট জলাশয়। মহারাজ দ্বিতীয় সওয়াই জয়সিংহের নামে  নতুন শহরের নাম রাখা হয় জয়পুর। মোগলদের কূট চাল বানচাল করে রাজপুতের জয়ের নিদর্শন জয়পুর।




মাওটা লেকের পাশে অম্বর প্যালেস


১৭২৭ সালের ১৮ নভেম্বর মহারাজা জয়সিংহ  ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন নতুন শহর জয়পুরের। নতুন রাজধানী তৈরি করতে সময় লাগল ছয় থেকে আট বছর। ১৭৩৪ সালে অম্বর বা আমের কেল্লা থেকে রাজধানী নেমে এল জয়পুর শহরে। এত কম সময়ে এমন আধুনিক শহর নির্মাণ  এখনও বাস্তুকারদের কাছে বিস্ময়।শুধু নগর পরিকল্পনাতেই থেমে থাকেননি বিদ্যাধর। স্যামুয়েল জ্যাকবের সঙ্গে পরামর্শ করে পরিকল্পনা করেন রাজপ্রাসাদ  সিটি প্যালেসের।  সিটি প্যালেস বা প্রধান প্রাসাদ, রাস্তাঘাট করতে সময় লেগেছিল চার বছর। তাঁর তত্বাবধানে তৈরি হয় জয়পুর মানমন্দির বা যন্তর মন্তর । 
শহরের প্রাসাদ ও অন্যান্য নির্মাণে ব্যবহৃত হয় স্যান্ডস্টোন বা বেলেপাথর। বড় রাস্তার দু’ধারের বাড়ি ও দোকানপাট একই মাপ এবং ডিজাইনের। পরবর্তিকালে শহর আলোকিত হত গ্যাসের আলোয়। 
শহর জয়পুর গড়ার সময় আরও কিছু বাঙালি বিদ্যাধরের সঙ্গে ছিলেন। তেমনই একজন সংসারচন্দ্র সেন। তিনি ছিলেন জয়পুরের দেওয়ান। এখনও তার নামে সংসার চন্দ্র রোড আছে জয়পুরে।




সিটি প্যালেসের অন্দরমহল


দেশের প্রথম পরিকল্পিত শহর জয়পুর হলেও ইতিহাস বলে খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে নির্মিত তক্ষশীলা ছিল তৎকালীন ভারতের প্রথম পরিকল্পিত নগর। কিন্তু আজকের জয়পুর শহর কি মনে রেখেছে তার স্থপতিকার বিদ্যাধর ভট্টাচার্যর কথা ? 
জয়পুর শহর তার স্থপতিকারকে মনে রাখার জন্য বানিয়েছে বিদ্যাধর গার্ডেন। ১৯৮৮ সালে জয়পুর-আগ্রা হাইওয়ের পাশে গড়ে ওঠে বিদ্যাধর গার্ডেন। শহরের অন্যতম অভিজাত এলাকার নাম বিদ্যাধর নগর।


বিদ্যাধর ভট্টাচার্য মারা যান ১৭৬১ সালে। তাঁর মৃত্যুর পরেও এগিয়ে চলেছে বিদ্যাধরের সাধের শহর জয়পুর। অনেক চেষ্টা করেও বিদ্যাধর ভট্টাচার্যর কোনও ছবি জোগাড় করতে পারিনি শহরের মহাফেজখানা থেকে। শহরে এখনও রয়েছেন বিদ্যাধরের বংশধরেরা। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাঁদের সন্ধান করাও হয়নি।


দ্বিতীয় রামসিংহ যখন জয়পুরের রাজা হলেন, পুরো শহর তিনি রাঙালেন মেটে গোলাপী রঙে। শহরের প্রতিটি বাড়ি, দোকান, প্রাসাদ, অট্টালিকা ; বাদ গেলনা কোনোটাই। ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডের প্রিন্স অব ওয়েলস্ ঘুরতে আসেন জয়পুর শহর। মুগ্ধ হন গোলাপী শহর দেখে। সেই থেকে জয়পুর পিংক সিটি বা গোলাপী শহর নামেও বিখ্যাত। 




মানমন্দির


১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলে নবগঠিত রাজস্থানের রাজধানী হল জয়পুর। পিংক সিটি জয়পুরের মুকুটে আরও পালক যোগ হয় ২০১৯ সালে যখন ইউনেস্কো হেরিটেজ কমিটি জয়পুর শহরকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিটি হিসাবে ঘোষণা করে। অম্বর কেল্লা আর যন্তর মন্তর অবশ্য আগেই হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষিত হয়।


দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে শহরও নিজের কলেবর বাড়িয়েছে। শহরে চলছে মেট্রোরেল। রাজস্থানের প্রবেশদ্বার জয়পুর সেজে উঠেছে নতুন নতুন হোটেল, দোকান, বাজার নিয়ে। বর্ধিত শহরের অংশ পিংক সিটির ঐতিহ্য মেনে গোলাপী রঙে সাজেনি। পুরানো জয়পুর শহর রয়েগেছে মেটে গোলাপী রঙে ঐতিহ্য বুকে নিয়ে। 


(নিবন্ধটি লেখকের চোখে জয়পুর শহর দেখা ভিত্তি করে লেখা। এর কোনও অংশ বা পুরো অংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত নয়।)


আরও পড়ুন- হিমালয় দর্শনের বাসনা, সঙ্গে পুণ্য অর্জন চান? এবার ভ্রমণ হোক কেদারনাথ