নয়াদিল্লি: এক পায়ে দাঁড়াতে পারেন? শুনে সহজ মনে হলেও কখনও কখনও এই কাজটি করা বেশ কঠিন হতে পারে। ৫০ পেরোলে দেহের ভারসাম্য দ্রুত কমে আসে। সহজে পড়ে যাওয়া ঝুঁকি এবং অন্যান্য রোগের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। মধ্যবয়সী এবং তার চেয়ে বেশি বয়সের কোনও ব্যক্তি যদি ১০ সেকেন্ডের জন্য এক পায়ে না দাঁড়াতে পারেন তাহলে তার সঙ্গে পরের ১০ বছরের মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে বলে জানানো হয়েছে একটি সমীক্ষায়। যাঁরা এই গবেষণাটি করেছেন তাঁদের পরামর্শ বয়স্কদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় ভারসাম্য পরীক্ষা অন্তভুর্ক্ত করা যেতে পারে। সম্প্রতি এই গবেষণাপত্রটি ব্রিটিশ জার্নাল অফ স্পোর্টস মেডিসিন জার্নালে (British Journal of Sports Medicine) অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে।


গবেষকরা মনে করেন যে, ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত অ্যারোবিক ফিটনেস (Aerobic Fitness), পেশি শক্তি এবং নমনীয়তা একইরকম ভাবে ভাল থাকে না। তবুও অন্তত ৬০ বছর পর্যন্ত কিছুটা হলেও ঠিকঠাক থাকে শরীরের ভারসাম্য। কিন্তু তারপর থেকেই ভারসাম্য তুলনামূলকভাবে দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে।


কেন এই গবেষণা:
১০ সেকেন্ড ধরে এক পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকা না বা থাকার সঙ্গে মৃত্যুর কোনও যোগসূত্রে রয়েছে কিনা, সেই বিষয়ে তথ্য পাওয়া। পাশাপাশি, এটি কোনও ব্যক্তির শারীরিক পরিস্থিতি ঠিক কীরকম তা বোঝাতে সাহায্য করে কিনা, সেটাই দেখা উদ্দেশ্য ছিল। 


আগামী দশ বছরের মধ্যে কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে কিনা তা বোঝার জন্য কোনও ভারসাম্য পরীক্ষা করা সম্ভব কিনা, বা সেই পরীক্ষার ফল কতটা ভরসা করা যাবে তা খোঁজার লক্ষ্যে এই গবেষণা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এই ধরনের ভারসাম্য পরীক্ষা ব্যবহার করা যায় কিনা তাও খোঁজার লক্ষ্য ছিল গবেষকদের। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যেহেতু কোনও নির্ভরযোগ্য মান নেই, সেই কারণে  ভারসাম্য মূল্যায়ন (Balance Assesssmen) মধ্যবয়সী এবং তার বেশি বয়সের কোনও পুরুষ বা মহিলার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।


কীভাবে হয়েছে এই গবেষণা?
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি এবং ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে, গবেষকরা ৫১ থেকে ৭৫ বছর বয়সী ১,৭০২ জনকে পরীক্ষা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ পুরুষ ছিলেন এবং তাঁদের গড় বয়স ছিল ৬১ বছর। শারীরিক সুস্থতা বা ফিটনেসের সঙ্গে ব্যায়াম সম্পর্কিত তথ্য এবং হৃদরোগ সংক্রান্ত নানা ঝুঁকির সম্পর্ক বোঝার জন্য ১৯৯৪ সালে তৈরি হয়েছিল ক্লিনিমেক্স এক্সারসাইজ কোহর্ট স্টাডি (CLINIMEX Exercise cohort study)। গবেষকরা সেখান থেকে তথ্য নিয়ে তা পুনরা. বিশ্লেষণ করেছেন। নতুন এই গবেষণায়, অংশগ্রহণকারীদের ত্বকের পুরুত্ব, কোমরের মাপ নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের ওজনও নেওয়া হয়েছে। যাঁরা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন, তাঁদেরই সমীক্ষায় নেওয়া হয়েছিল। ওই অংশগ্রহণকারীদের এক পায়ে ১০ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়েছিল। যাতে সহজেই পরিমাপ করা যায় সেই কারণে একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় সামনে সোজা তাকিয়ে এবং পাশে হাত রেখে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল অংশগ্রহণকারীদের। 


কারা পাস, কারা ফেল?
প্রতি পাঁচজন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে একজন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। অর্থাৎ ১,৭০২ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৩৪৮ জন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি, শতকরার বিচারে ২০.৪ শতাংশ। এক পায়ে ১০ সেকেন্ড দাঁড়ানোর ক্ষমতা কমে যাওয়ার মাত্রা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গিয়েছে। প্রতি পাঁচ বছরে এই অক্ষমতা অন্তত দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে, এমনটাই দেখা গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে অংশগ্রহণকারীদের। যাঁরা  পরীক্ষাটিতে সফল হয়েছেন তাঁদের 'হ্যাঁ' শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল। যাঁরা পারেননি ,তাঁদের 'না' শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল। 
৫১ থেকে ৫৫ বছর বয়সী অংশগ্রহণকারীদের প্রায় পাঁচ শতাংশ ১০ সেকেন্ডের জন্য এক পায়ে দাঁড়াতে অক্ষম ছিলেন। ৫৬ থেকে ৬০ বছর বয়সী অংশগ্রহণকারীদের প্রায় আট শতাংশ এক পায়ে দাঁড়াতে পারেন না। এছাড়াও, ৬১-৬৫ বছর বয়সী অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৮ শতাংশেরও কম এক পায়ে দাঁড়াতে অক্ষম ছিলেন। ৬৬ থেকে ৭০ বছর বয়সী অংশগ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে তা ছিল ৩৭ শতাংশ। ৭১ থেকে ৭৫ বছর বয়সী অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকেরও বেশি (৫৪ শতাংশ) পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। গবেষণায় বলা হয়েছে, ৭১-৭৫ বছর বয়সীদের পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা তাঁদের থেকে মাত্র ২০ বছরের কম বয়সীদের তুলনায় ১১ গুণ বেশি ছিল। সাত বছরের গড় পর্যবেক্ষণ সময়কালে, ৭.২ শতাংশ লোক মারা গিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ৪.৬ শতাংশকে হ্যাঁ এবং ১৭.৫ শতাংশকে না হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছিল। গবেষকরা ভারসাম্য পরীক্ষাটি সম্পন্ন করতে সক্ষম এবং যাঁরা এটি করতে সক্ষম হননি তাঁদের মধ্যে মৃত্যুর কোনও প্রবণতা বা কারণগুলির মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাননি। তবে পরীক্ষায় ব্যর্থদের মধ্যে মৃত্যুর অনুপাত উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল। যাঁরা পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন তাঁদের মধ্যে মৃত্যুর অনুপাত ছিল ১৭.৫ শতাংশ, যেখানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মৃত্যুর অনুপাত ছিল ৪.৫ শতাংশ। 


সমীক্ষা অনুসারে, যাঁরা পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিলেন তাঁদের স্বাস্থ্য খারাপ ছিল। বিপুল সংখ্যক লোকের স্থূলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ছিল। এছাড়াও, টাইপ ২ ডায়াবেটিসের প্রবণতাও অনেক বেশি ছিল। যাঁদের এই  টাইপ ২ ডায়াবেটিস ছিল তাঁদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ পরীক্ষা পাশ করতে পারেননি।  তবে এমন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ১৩ শতাংশ পাশ করেছিলেন। গবেষকরা জানিয়েছেন যে, ১০ সেকেন্ডের জন্য একপায়ে দাঁড়াতে অসমর্থতা, পরবর্তী দশ বছরে মৃত্যুর ঝুঁকি ৮৪ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।    


সীমাবদ্ধতা:
যেহেতু এটি একটি পর্যবেক্ষণমূলক সমীক্ষা, তাই এটি দাবির স্বপক্ষে কারণ দেখাতে পারে না। তাছাড়া অংশগ্রহণকারীরা সবাই শ্বেতাঙ্গ ব্রাজিলিয়ান। অতএব, ফলাফলগুলি অন্যান্য জাতি এবং গোষ্ঠীর জন্য আরও ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে, উল্লেখ করেছেন গবেষকরা।


এছাড়াও, পড়ে আঘাত পাওয়ার ঘটনা, খাদ্যাভ্যাস, ওষুধের ব্যবহার, ধূমপান- অর্থাৎ যা যা ভারসাম্যের ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে, তার তথ্য উপলব্ধ ছিল না। যদিও যা  তথ্য পাওয়া গিয়েছে তা প্রয়োজনীয় বলেই জানিয়েছেন গবেষকরা।


আরও পড়ুন: এই খাবার পাতে রাখলে ঝুঁকি কমবে ডায়াবেটিসের, দাবি নতুন এই গবেষণায়