তোর্ষা ভট্টাচার্য্য, কলকাতা: সিনেমার সংলাপেই রয়েছে, এই খেলা খেলতে বসলে নাকি ঘুম পায়। সুতরাং ক্রিকেটই এর চেয়ে ভাল। কথাটা বাস্তবও। যে খেলার হাতিয়ার ব্যাট-বল নয়, ফুটবল নয়, ব়্যাকেট নয়... কেবল বুদ্ধি, সেই সাদা-কালো বোর্ডের গল্প দিয়ে একটি গোটা সিনেমা তৈরি করা মুখের কথা নয়। বলতেই হবে, সেই পরীক্ষায় লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করেছেন পরিচালক পথিকৃৎ বসু (Pathikrit Basu)। নন্দিতা রায় (Nandita Roy) ও সঞ্জয় আগরওয়ালের (Sanjay Agarwal)-এর প্রযোজনায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (Shiboprosad Mukherjee)-এর ক্রিয়েটিভ প্রযোজনায় মুক্তি পেল 'দাবাড়ু' (Dabaru)। সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত এই ছবির গল্প গোটাটাই আবর্তিত হয়েছে দাবার ওই চৌকো, সাদা-কালো বোর্ডকে ঘিরেই। বাংলা ছবির দুনিয়ায় বায়োপিকের সংখ্যা এমনিই হাতে গোনা, সেখানে দাবার মতো একটি বিষয়কে বায়োপিকের বিষয়বস্তু হিসেবে তুলে আনতে পরিচালক ও প্রযোজক দুক্ষেত্রেই সাহসের প্রয়োজন ছিল। 


কাহিনি


গল্পের শুরুটা হয় ফ্ল্যাশব্যাকে, বেশ সিনেম্যাটিক ভাবেই। কিশোর নায়কের পিছনে ছুটছে বেশ কয়েকজন গুণ্ডা। আর সেই কিশোর কেবল বুদ্ধির জোরে, তাদের হাত ফস্কে গিয়ে পৌঁছচ্ছে এক দাবা প্রতিযোগিতায়। তারপরেই সংলাপ, 'গুলিয়ে যাচ্ছে? চলুন শুরু থেকে খেলাটা দেখা যাক'। এরপরে শুরু হয় মূল গল্প। দূরন্ত সৌরকে সামলাতে যখন হিমশিম মা, তখন এক অভিনব পন্থা বের করেন দাদু। বছর পাঁচেকের ছেলেকে বসিয়ে দেন, দাবার বোর্ডের সামনে। সাদা কালো বোর্ডে হাতি, ঘোড়া, রাজা, রানি নিয়ে খেলা। ছোট্ট সৌরর প্রথমটা মনে হয়েছিল, এ যেন মহাভারতের মতোই। খেলা শিখতে চাইলেও, দাবার বোর্ডের থেকে তাকে ঢের বেশি টানে পাড়া-ক্রিকেট। সেই পাড়া-ক্রিকেটের বল উদ্ধার করতে গিয়ে, এক বৃদ্ধকে দাবায় ৩ বার হারিয়ে সন্দেশ খাওয়ার টাকা পায় সৌর। সেই শুরু। প্রথমে পাড়ার বিভিন্ন টুর্নামেন্ট, ধীরে ধীরে ক্লাব, তারপর জাতীয়-আন্তর্জাতিক... শিরোনামে থাকা সৌরর স্বভাবে থাকলেও, জীবনের গতি মসৃণ ছিল না ততটা। পরিবার থেকে শুরু করে খেলা, সৌরর জীবনে ওঠাপড়া এসেছে। তাঁর ভাষায়, 'জীবনটা  জুগজ়ুয়া হয়ে গিয়েছে।' সেই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পেরোতে, সৌরর জীবনে 'ক্ষিদ্দা' হয়ে রয়ে গিয়েছেন, তার কোচ রথীন্দ্র। এই ভূমিকায় দেখা গিয়েছে চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীকে (Chiranjeet Chakraborty)।


এই ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায়, ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়া 'কোনি'-র কথা। একজন ক্রীড়াবিদের জীবনে যে তার কোচের ভূমিকা কতটা, সেই সম্পর্কের ছবি ভারী সুন্দরভাবে আঁকা হয়েছিল 'কোনি' ছবিতে। প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে বসে সৌর আর তার রথীন্দ্র স্যর যেন বারে বারে মনে করিয়ে দিচ্ছিল কোনি আর ক্ষিদ্দার এক অদ্ভূত সম্পর্কের কথা। তবে এই ছবি কেবল কোচ আর ছাত্রের সম্পর্ককে আঁকেনি, পাশাপাশি তুলে ধরেছে, সাফল্যের পিছনে পরিবারের অবদানও। এই ছবিতে সৌরর মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত (Rituparna Sengupta)। দাদুর ভূমিকায় দীপঙ্কর দে (Dipankar De) ও বাবার ভূমিকায় শঙ্কর চক্রবর্তী (Shankar Chakraborty)। প্রত্যেকের অবদানকেই সৌরর জীবনে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন পরিচালক। সবশেষে, এই গল্পের মধ্যে যে বিষয়টার কথা না বললেই নয়, সেটা হল অনুপ্রেরণা। ইতিবাচক সংলাপ থেকে শুরু করে একাধিক মন ভাল করা দৃশ্যই এই ছবির এক্স-ফ্যাক্টর। 


অভিনয়


এই ছবির নায়ক মূলত দুই অভিনেতা। একজন নেহাতই খুদে, আরেকজন কিশোর। সমদর্শী সরকার ও অর্ঘ্য রায় বসু। ইতিমধ্যেই অর্ঘ্য 'উইন্ডোজ'-এর সঙ্গে একটি কাজ করে ফেলেছেন। 'পোস্ত' ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনিই। আর এবার, কিশোর 'দাবাড়ু'-র ওঠাপড়াকে ফুটিয়ে তোলার গুরুদায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধেই। ছবির পরতে পরতে, তাঁর চরিত্রকে যে সুরে পরিচালক বেঁধেছেন, সেখানে অভিনয়ের অনেক জায়গা রয়েছে। বলতেই হবে, সেই প্রত্যেকটা জায়গারই সঠিক সদ্ব্যবহার করেছেন অর্ঘ্য। যদিও ছবির প্রথমার্ধের অনেকটা অংশই কেটে যায় মিষ্টি সমদর্শীর অভিনয়ে মজে থেকে। ছোট্ট বয়সেও তার কাটা কাটা সংলাপ, মাপা আবেগ বেশ নজর কাড়ছে। সংলাপের সাবলীল ছন্দে কোথাও মনে হয়েনি, তা শেখানো। বরং নিজের ছন্দেই কথা বলেছে সমদর্শী। তবে অভিনয়ের তুলনামূলক অনেক বেশি জায়গায় পেয়েছেন অর্ঘ্য, অভাব, অভিযোগ, আবেগ, কিশোর বয়সের জেদ, প্রেম, প্রতিবাদ... সমস্ত সুরেই বাঁধা হয়েছে তার চরিত্রকে। তবে গুণ্ডাদের সঙ্গে মারামারির নায়কোচিত সিকোয়েন্স একটু চড়া দাগের বলেই মনে হয়েছে। ছবি যত গড়িয়েছে, সৌরর মায়ের ভূমিকায় নিজেকে যেন নতুন করে প্রমাণ করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। বিশেষ করে কানে ফোন ধরেও অভিমানে কথা না বলার দৃশ্য, ছেলের ওপর অভিমান-রাগ ফুটিয়ে তোলার দৃশ্যে ঋতুপর্ণা যেন ফের একবার নতুন করে নিজের অভিনয়ের জাত চিনিয়ে দিলেন। তবে ছবির একেবারে ক্লাইম্যাক্সে চিত্রনাট্যে ছেলের ম্যাচ চলাকালীন ঋতুপর্ণা দৌড়ের দৃশ্যকে একটু অতিনাটকীয় বলেই মনে হয়েছে। 'দাবাড়ু'-তে দীর্ঘদিন পরে দীপঙ্কর দে-কে একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে পেলেন দর্শক। যাঁর হাত ধরে সৌরর দাবা খেলা শুরু, তিনি দীপঙ্কর। ছোট্ট সৌরকে ধৈর্য্য ধরে খেলা শেখানো থেকে শুরু করে কিশোর সৌরর অবলম্বন হয়ে ওঠা, দীপঙ্করের তুখোড় অভিনয় মাঝে মাঝে ফিকে করে দিয়েছে অন্যান্যদেরও। দীপঙ্করের মুখে সেরা সংলাপ, 'বড় প্লেয়ারের আসল পরীক্ষা জিতে আসা নয়, ফিরে আসায় হয়', যেন এক মুহূর্তে একমুঠো অনুপ্রেরণা জুগিয়ে দিয়ে যায় দর্শকদের মনে। নিজের ভূমিকায় অনবদ্য শঙ্কর চক্রবর্তীও। প্রথমার্ধের থেকে দ্বিতীয়ার্ধে অনেক বেশি নজর কেড়েছেন তিনি। চিত্রনাট্য দ্বিতীয়ার্ধে পৌঁছলে বোঝা যায়, পরিচালক প্রথম দৃশ্যে শঙ্করকে কিছুটা নিষ্প্রভ রেখেছিলেন দ্বিতীয়ার্ধে তাঁকে সম্পূর্ণ ব্যবহার করবেন বলেই। যেখানে রুপোলি পর্দায় এখনও 'স্নেহ' শব্দটার ওপরে মায়েদেরই একাধিপত্য রয়েছে, সেখানে শঙ্কর ছবির দ্বিতীয়ভাগে দেখিয়ে দিয়েছেন বাবাদের মনের ভিতরেও থাকতে পারে ফল্গুধারা। সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁর প্রতিভাকে আগলে রাখার মতো ছাতা যে বাবারাও হতে পারেন, সেটাই মাপা অভিনয়ে ভারী সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শঙ্কর। ছবিতে যাঁর অভিনয়ের কথা উল্লেখ অবশ্যই করতে হবে, তিনি চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। পর্দায় সৌরর কোচ। সৌরর ট্যালেন্টকে খুঁজে বের করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে নিজের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন যে চিরঞ্জিৎ, তাঁকে নতুনভাবে যেন আবিষ্কার করবেন দর্শকেরা। জেদ, ছাত্রের জন্য নিজের ব্যক্তিগত জীবন তুচ্ছ করা, খুশি, আনন্দ, কান্না.. চিরঞ্জিৎ এককথায় এই ছবির প্রাণ।


ছবির মধ্যে একমাত্র ধূসর চরিত্র কৌশিক সেন (Kaushik Sen)। চরিত্র ছোট হলেও, তিনি দর্শকদের মনে দাগ কেটে যান কেবল সূক্ষ্ম অভিনয়েই। শরীরী ভাষা, কথা বলার ধরন.. কৌশিক নিজস্ব ভূমিকায় অনবদ্য। মাত্র মিনিট ২০ সময় নিয়ে, পর্দায় থেকে কৌশিক বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, কেন তিনি না থাকলে চিত্রনাট্য অসম্পূর্ণই থেকে যেত। এছাড়াও আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় খরাজ মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ বসু, সংঘশ্রী সিংহ মৈত্রের কথা। নিজের নিজের চরিত্রে তাঁরা প্রত্যেকেই যথাযথ। এই ছবিতে পুরুষ চরিত্রের যে স্নেহের দিকটি প্রকাশ পেয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছেন বিশ্বজিৎও। ছবির প্রথমদিকে একটু কমিক রিলিফ হলেও, দ্বিতীয়ভাগে স্ত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে ছেলের ইচ্ছার পাশে দাঁড়ানোর দৃশ্য অবশ্যই গভীর। সৌরর প্রেমিকার চরিত্রে ক্লাস ১০-এর কিশোরীকেও বেশ মানিয়ে গিয়েছে। তার পরিশিলীত অভিনয়ে দাগ কেটেছে দর্শকদের মনে।


মিউজিক


ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন বনি চক্রবর্তী ও প্রসেন। ছবির মেজাজের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়েছে প্রত্যেকটা গানই। 'দাবাড়ু'-র টাইটেল ট্র্যাক থেকে শুরু করে, 'তাহলে একটু ঝগড়া করি চল'.. প্রত্যেকটা গানই সিনেমার প্রতি সুবিচারই করেছে। 


সব মিলিয়ে 'দাবাড়ু' যে বিভাগে একশোয় একশো পেয়েছে, তা হল অনুপ্রেরণা। মুঠোফোনে বন্দি জীবনে প্রত্যেকদিন যখন মানুষকে আরও একটি বেশি করে গ্রাস করছে হতাশা, মনে হচ্ছে আর বুঝি ফেরা হল না 'সব পেয়েছি-র দেশে', সেখানে এক 'দাবাড়ু' বলছে... 'বড় প্লেয়ারের আসল পরীক্ষা জিতে আসা নয়, ফিরে আসায় হয়'।


আরও পড়ুন: Dona Ganguly : "সানাকে শুনতে হয়েছে, 'সৌরভের মেয়ে চাকরি করে কী হবে"


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।