কলকাতা: বছর ঘোরে। ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টায়। বদলায় না ব্যতিক্রমী বাঙালিদের সম্মানিত করার এবিপি আনন্দের পরম্পরা। দেখতে দেখতে যা দু’দশক পূর্ণ করল। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতীদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল মঞ্চ।


তবে ২০ বছর স্পর্শ করে এবিপি আনন্দের সেরা বাঙালি সম্মানেও অভিনবত্বের ছোঁয়া। বরণ করে নেওয়া হল মোট ২০ কৃতীকে। যাঁরা বাংলার, বাঙালির জীবনের বিভিন্ন আঙ্গিকে নিজেদের বলিষ্ঠ ছাপ ছেড়ে গিয়েছেন, তৈরি করেছেন উদাহরণ, হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণা। সবচেয়ে তারপর্যপূর্ণ হল, ২০ জন বরেণ্যই মহিলা।


যাঁরা রাঁধেন, তাঁরা চুলও বাঁধেন। তাঁরা স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে নিষ্ঠা আর সংকল্পের বুননে স্বপ্নও ফেরি করেন। নারীশক্তির জয়গানই যেন এবারের সেরা বাঙালি অনুষ্ঠানের প্রাণশক্তি ধরে রাখল।


এবিপি আনন্দের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুমন দে অনুষ্ঠানের আগেই বলেছিলেন, 'ভাবালেন যাঁরা, পথ দেখালেন যাঁরা, শেখালেন যাঁরা, আলো দেখালেন যাঁরা, ২০ বছরে পা দিয়ে তাঁদের কুর্নিশ।'


সঙ্গীতশিল্পী প্রকৃতি মুখোপাধ্যায় উদাত্ত কণ্ঠে কবিগুরুর গান ‘ওই ঝঞ্ঝারও ঝঙ্কারে’ গেয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন। রবীন্দ্রনাথের সুরের ছন্দেই যেন ধরা রইল গোটা সন্ধ্যার আবহ, আয়োজনের নির্যাস।


এবিপি আনন্দের সেরা বাঙালি অনুষ্ঠান মানেই শুধু কৃতীবরণ নয়, সঙ্গে জীবনের এমন কিছু গল্প শোনানোর মঞ্চ, যে কাহিনি আমাদের বাঁচতে শেখায়। সঞ্জীবনী সুধার মতো। যা এগিয়ে চলার রসদ জোগায়।


যে ২০ কৃতীকে সম্মানিত করা হল শহরের বুকে আলোকজ্জ্বল সন্ধ্যায়, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের জীবন দিয়ে, কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা আর ইচ্ছেশক্তি দিয়ে রূপকথার গল্প লিখে চলেন প্রতিনিয়ত। সেরা বাঙালির মঞ্চে সেই গল্প শোনাও যেন সকলের কাছে পরম এক প্রাপ্তি।


সম্মানিত অনসূয়া, প্রিয়াঙ্কা, মধুরা


এবার চলচ্চিত্র ও বিনোদন বিভাগে সেরা বাঙালি পুরস্কার দেওয়া হল তিন কন্যাকে। অভিনয়ে সেরা বাঙালি পেলেন অনসূয়া সেনগুপ্ত। কলকাতার রাজপথ থেকে কান চলচ্চিত্র উৎসবের রেড কার্পেট ধরে হেঁটে পুরস্কার গ্রহণ করে গোটা বঙ্গ সমাজকে গর্বিত করেছেন যিনি। ফ্যাশন ডিজাইনার প্রিয়াঙ্কা মল্লিক ও সিনেমাটোগ্রাফার মধুরা পালিতকেও জানানো হল সম্মান। কেউ হুগলির প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ইংল্যান্ডের রাজপ্রাসাদে স্বপ্নের উড়ান মেলেছেন। কেউ আবার ‘মেয়েরা সংসার ছেড়ে ক্যামেরা হাতে তুলে কী করবে’-র ঘুণ ধরা চিন্তাভাবনাকে অস্তিত্বহীন করে দিয়েছেন ঝাঁ চকচকে সিনেমাটোগ্রাফি দিয়ে। তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায় ও সাহাবাবুর আদি ঢাকেশ্বরী প্রাইভেট লিমিটেডের কর্ণধার নিতাই সাহা।


পুরস্কৃত অনিন্দিতা, মোনালিসা


যে আর জি কর কাণ্ড গোটা রাজ্যে, দেশে, দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে বিদেশেও আলোড়ন ফেলেছিল, সেই ঘটনার প্রতিবাদে স্বকীয়তার ছাপ রেখেছিলেন চিকিৎসক অনিন্দিতা ঝা ও শিক্ষিকা মোনালিসা মাইতি। তাঁদেরও সম্মান জানাল এবিপি আনন্দ।


সমাজ চেতনায় স্বীকৃতি


সমাজ চেতনায় সেরা বাঙালি পুরস্কার পেলেন পরিবেশবিদ সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও পুরুষ অধিকার ও লিঙ্গবৈষম্য দূর করা নিয়ে আন্দোলন করা নন্দিনী ভট্টাচার্য।


সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ


পরিবহণ ব্যবস্থায় সাধারণের মধ্যে অসাধারণ কাজের জন্য পুরস্কৃত হলেন পাইলট, কমান্ডার শতভিষা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ক্যাব চালক দীপ্তা ঘোষ।


কুর্ণিশ টুম্পা ও নন্দিনীকে


জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ - এই পর্বে সম্মান জানানো হল বারুইপুরের পুরন্দরপুরে ডোমের কাজ করা টুম্পা দাস ও মহিলা পুরোহিত নন্দিনী ভৌমিককে। ক্রীড়াক্ষেত্রে সম্মানিত হলেন সাঁতারু সায়নী দাস, যোগাসনে আন্তর্জাতিক পদক জিতে ফেরা সুস্মিতা দেবনাথ ও তিরন্দাজ অঙ্কিতা ভকত।




ব্যবসায় সেরা দুই কন্যা


ব্যবসাক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী পথ ধরে হেঁটে, সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করে সাফল্যের খোঁজ দেওয়া দুই নারীকে সেরা বাঙালি পুরস্কার দিয়ে কুর্নিশ জানাল এবিপি আনন্দ। ব্যারাকপুরের বিখ্যাত দাদা-বৌদির বিরিয়ানির সন্ধ্যা সাহা ও শ্রীলেদার্সের অন্যতম কর্ণধার রচিতা দে-কে।


ত্রয়ীকে সম্মান


বিজ্ঞান ও শিক্ষায় সেরা বাঙালি হলেন ন্যাশানল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা ও এন্টেরিক ডিসিসের ডিরেক্টর শান্তা দত্ত, এস এন বসু ন্যাশানল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেসের ডিরেক্টর তনুশ্রী সাহা দাশগুপ্ত ও ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়।


সেরার সেরা বাঙালি


সেরার সেরা সম্মান প্রদানের আগে মঞ্চে উঠে এবিপি আনন্দের সম্পাদক সুমন দে বলেন, 'এত বছর ধরে আমরা সেরা বাঙালি সম্মান যাঁদের জানাতে পেরেছি, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজগুণে নজর কেড়েছেন। আবার আমাদের মধ্যে এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা একেবারে নীরবে, সবার চোখের আড়ালে কাজ করে চলেন। সমাজের শরীরে তাঁরা হলেন, শিরদাঁড়ার মত। বাইরে থেকে সবসময় দেখা যায় না। কিন্তু তাঁরাই সমাজকে সোজা রাখেন। একেবারে ঋজু রাখেন।'




সম্মান ঘোষণা করতে গিয়ে কিছুদিন আগেই তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের দাবিতে ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে রাজপথে প্রতিবাদের উল্লেখ করেন সুমন দে। উল্লেখ করেন, সমাজমাধ্যমের সেই ডাকটির কথা। বলেন, একটা পোস্টার যে কত শক্তিশালী হতে পারে, তা ১৪ অগাস্ট রাতই দেখিয়ে দিয়েছিল।


গোটা অনুষ্ঠান দেখতে ক্লিক করুন নীচের লিঙ্কে



মেয়েদের রাত দখলের সেই প্রতিবাদের প্রথম ডাক দিয়েছিলেন যিনি, এবিপি আনন্দের সেরা বাঙালি ২০২৪-এ সেরার সেরা সম্মান এবার দেওয়া হল তাঁকেই। রিমঝিম সিনহা। 


সেরার সেরা সম্মান রিমঝিম সিনহার হাতে তুলে দেন আরেক সেরার সেরা বাঙালি, প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধান অরূপ রাহা। সম্মান হাতে নিয়ে শ্রী সুমন দে-র প্রশ্নের উত্তরে রিমঝিম বলেন, 'এই সম্মান প্রত্যেক সাধারণ নারীর। এই সম্মান প্রত্যেক সাধারণ নারীর নামে লেখা থাকুক, যাঁরা প্রত্যেকদিন নিজের নিরাপত্তা নিজের স্বাধীনতা নিয়ে লড়াই করছেন এবং অন্যদের সাহস জোগাচ্ছেন।'


তিলোত্তমাকে হারিয়ে মন যখন সবার ভারাক্রান্ত, চতুর্দিকে খারাপ ঘটনা, তখন এই রাজ্যের ব্যতিক্রমী নারীদের মধ্যে আলোর সন্ধান করেছি আমরা। এবারের সেরা বাঙালি তাঁদের জন্যই নিবেদিত। 


সম্মান প্রদান অনুষ্ঠানে বসেছিল চাঁদের হাট। চলচ্চিত্র থেকে শিল্প, বিজ্ঞান, নাটক থেকে ক্রীড়া, বাণিজ্য - সব ক্ষেত্রের তারকাদেরই উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত।