কলকাতা: ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট ও ছাত্রছাত্রীরা। সমাবর্তন কক্ষে  অভিভাষণ পাঠ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তথা বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন। মঞ্চের দিকে তখন ধীরেসুস্থে এগিয়ে গেলেন গাউন পরিহিতা এক ছাত্রী। আচমকাই তাঁর হাতে গর্জে উঠল বন্দুক। আত্মরক্ষায় মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন জ্যাকসন। অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় গুলি। সম্বিত ফিরে পেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসে ওই ছাত্রীকে ধরে ফেলেন উপাচার্য হাসান সুরাবর্দি। তখনও থামেনি বন্দুকের গর্জন। পাঁচ-পাঁচটি  গুলি বেরিয়ে যায় তাঁর বন্দুক থেকে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়নের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলার আরও একটি অদম্য বজ্রনির্ঘোষ সমাবর্তন কক্ষের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই গ্রেফতার হন ওই ছাত্রী। তাঁর নাম বীণা দাস। অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সেদিন তাঁরও শংসাপত্র নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থের কবেই বা পরোয়া করেছেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা!


আইন অমান্য আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার যখন চরমে উঠেছে, হিজলি-চট্টগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ, তখন মুখ বুজে মেনে নেননি বিপ্লবীরা। এর প্রতিবাদেই গর্জে উঠেছিল বীণা দাসের বন্দুক। আদালতে জবানবন্দীতে তিনি বলেছিলেন, দেশের প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসা থেকেই তিনি গভর্নরকে গুলি চালিয়েছিলেন। গভর্নরের প্রতি তাঁর কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা ক্ষোভ ছিল না। কিন্তু গভর্নর তো সেই নির্যাতন-ব্যবস্থার প্রতিনিধি, যা আমার ৩০ কোটি দেশবাসীকে পরাধীনতার নিগড়ে বেঁধে রেখেছে।  তিনি বলেছিলেন, I  have no sort of personal feelings against Sir Stanley Jackson, the man and Lady Jackson, the woman. But the governor of Bengal represents the system of repression which has kept enslaved 300 millions of my countrymen and countrywomen.


বীণা দাস ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসুর শিক্ষক বেণীমাধব দাসের কন্যা। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর জীবনে শিক্ষক বেণীমাধব দাসের অবদানের কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।  বীণা দাসের মা সরলা দেবী।  সমাজসেবায় তিনিও ছিলেন অগ্রণী মহিলা।  অসহায় ও দুঃস্থ মহিলাদের জন্য তিনি পরিচালনা করতেন 'পুণ্যাশ্রমে'র।  বেনীমাধব দাস ও সরলা তাঁদের সন্তানদের মনে মুক্তচিন্তার বীজ বপন করেছিলেন শৈশবেই। বীণা দাসের দিদি কল্যানী দাস (১৯০৭-৮৩) ও ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।  কলকাতা ছাত্রসংঘের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।  বিপ্লবীদের গোপন সভায় যোগ দিতেন তিনি। এমনই এক সভার  প্রচারের লিফলেট থাকার জন্য কল্যাণী দাসকে গ্রেফতার করেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। দিদির কারাবাসের দিনগুলির অবর্ণনীয় কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন বীণা দাস। একজন সাম্মানিক স্নাতক ও রাজনৈতিক কারণে বন্দি হওয়া সত্ত্বেও কল্যাণী দাসকে তৃতীয় শ্রেণীর বন্দি হিসেবে রেখেছিল ব্রিটিশ সরকার।  বীণা দাস তাঁর জবানবন্দিতে এই প্রসঙ্গেরও উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,  তৃতীয় শ্রেণীর  কয়েদিদের পোশাক,   কয়েদিদের খাবার, অপরাধজগতের সঙ্গে যুক্তদের সঙ্গে তাঁর দিদিকে থাকতে হত। এই ঘটনাকে সম্পূর্ণ অন্যায় মনে করতেন তিনি। এ সমস্ত কিছুই নিজের চোখে দেখেছেন তিনি। মেয়ের প্রতি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের অন্যায় আচরণে বাবা-মায়ের চোখের জলও দেখেছেন তিনি।আর এই সব ঘটনাই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের সিদ্ধান্তকে আরও জোরাল করে তুলেছিল। দিদির আত্মত্যাগ  অনুপ্রেরণা সঞ্চার করেছিল তাঁর মনে।


১৯১১-র ২৪ অগাস্ট কৃষ্ণনগরে বীণা দাসের জন্ম।  পরিবার ও পরাধীন দেশে ব্রিটিশ শাসনের কদর্যরূপ ও  সমসাময়িক ঘটনাবলী থেকেই জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ও দেশের জন্য আত্মবলিদানের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। বেথুন কলেজ ও ডায়সেশন কলেজে তাঁর পড়াশোনা। ১৯৩১ এ স্নাতক হয়েছিলেন তিনি।


১৯২৮-তে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে উত্তাল সারা দেশ। বীণা দাস তখন ছিলেন বেথুন কলেজের ছাত্রী। সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলনে যোগ দেন বীণা দাস। কলেজে পিকেটিং করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তিনি।  ওই বছরই কলকাতায় হয়েছিল কংগ্রেসের অধিবেশন। বীণা দাস সেখানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছিলেন। মহাত্মা গাঁধীর অহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ অন্তরে ক্ষোভের ঝঞ্ঝা তৈরি করে। অহিংস আন্দোলন থেকে সরে এসে বৈপ্লবিক পথই বেছে নেন তিনি।


বাংলা তথা সারা দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্রিটিশ পুলিশের দমন-পীড়নের প্রতিবাদ জানাতে গর্ভনর জ্যাকসনকে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আর তাঁর এই লক্ষ্য়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, বিপ্লবীদের সংগঠন যুগান্তরের সদস্য কমলা দাসগুপ্ত। কমলা দাসগুপ্ত ছিলেন বীণা দাসের দিদি কল্যাণী দাসের বান্ধবী।  বীণা যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর দৃঢ়তা ও অটুট সংকল্পের কথা বুঝতে পেরে কমলা দাসগুপ্ত বীণা দাসকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। অস্ত্র সংগ্রহের এক পুরুষ সহবিপ্লবীর দ্বারস্থ হন তিনি। ২৮০ টাকা দামে সংগ্রহ হয় একটি চোরাই রিভলভারের।  মানিকতলার কাছে রামমোহন রায় গ্রন্থাগার লুকিয়ে বন্দুক নিয়ে এসে কমলা দাসগুপ্ত তুলে দিয়েছিলেন বীণা দাসের হাতে। বন্দুক চালানোর কৌশল শিখিয়েছিলেন। কিন্তু লক্ষ্যবস্তুতে নিশানা করার অনুশীলন শেখানো যায়নি বীণা দাসকে। তাই তাঁর অপটু হাতে চালানো রিভলভারের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল।  বীণা দাসের এই  সিদ্ধান্তের কথা জেনেছিলেন তাঁরা বাবা-মাও। তাঁরা জানতেন, দেশের জন্য যে কোনও কিছুই করতে প্রস্তত তাঁদের মেয়ে।


জানা যায়., খোঁপায় রিভলভার লুকিয়ে সমাবর্তন কক্ষে ঢুকেছিলেন বীণা দাস। সমাবর্তন কক্ষ থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল বীণাকে। এরপর চলে টানা জেরা। রিভলবার কোথা থেকে পেয়েছিলেন, তা জানতে চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। কিন্তু  দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ বীণা দাসের মুখ থেকে একটি কথাও বের হল না। মেয়ের মুখ খোলাতে  তাঁর বাবা বেণীমাধবকেও বলেছিল পুলিশ। কিন্তু সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দেন তিনি। এরপর বিচারের নামে প্রহসন চলল। আদালতে দৃঢ়তার সঙ্গে গভর্নরের ওপর আক্রমণের দায় নিজের কাঁধেই তুলে নেন বীণা দাস। আর স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন নিজের উদ্দেশ্যের কথা। বলেছিলেন, ব্রিটিশ শাসনের সীমাহীন অত্যাচার ও পরাধীনতার মধ্যে গুমরে কাঁদার চেয়ে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য  আত্মবলিদানের চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।


ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর নয় বছরের কারাদণ্ডের ঘোষণা করে ব্রিটিশ আদালত। এরপর সাত বছর বাংলার বিভিন্ন জেলে কাটিয়ে ১৯৩৯-এ মুক্তি পান বীণা দাস। গাঁধীজীর চেষ্টায় অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দির সঙ্গে তিনিও মুক্তি পেয়েছিলেন।


জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বীণা দাসের সংগ্রাম থামেনি। সে সময় সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনেকেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। বীণা দাসও কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন এবং শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বস্তিবাসী দরিদ্র শ্রমিক পাশে দাঁড়িয়েছিলেন পরম মমতায়।  ১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। দক্ষিণ কলকাতার হাজরা পার্কের সভা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। আবার কারান্তরালে চলে যেতে হয় তাঁকে। রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন তিনি। ১৯৪৫-এ মুক্তি পান।


স্বাধীনতার পর কংগ্রেস সদস্য হিসেবে প্রাদেশিক সভার নিম্নকক্ষে জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু তারপর থেকে আর কখনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি তিনি। তবে উদ্বাস্তু আন্দোলন ও  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আন্দোলনে অগ্রণী সৈনিক ছিলেন বীণা দাস।  স্কুলে ইংরেজির শিক্ষকতাও করেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৬০ সালে সমাজসেবায় অবদানের জন্য পদ্মশ্রী-তে সম্মানিত করা হয়েছিল তাঁকে।


তিনি বিয়ে করেছিলেন সহসংগ্রামী যুগান্তর দলের সদস্য যতীশ ভৌমিককে। স্বামীর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান তিনি। ১৯৮৬-তে ২৬ ডিসেম্বর হরিদ্বারে  সহায়সম্বলহীন অবস্থায় অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যার মৃত্যু হয়।


 বৈপ্লবিক কার্যকলাপের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বীণা দাসকে তাঁকে স্নাতক ডিগ্রি দিতে অস্বীকার করেছিল। ৮১ বছর পর ২০১২-তে কলকাতা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় বীণা দাসকে মরণোত্তর স্নাতক শংসাপত্র তাঁর জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে প্রদান করে।