কলকাতা: ৩ জুলাই । একরত্তি ছেলের অন্নপ্রাশণের অনুষ্ঠান। আর তারপরই যে এতবড় একটা ঝড় অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য ভাবেননি সোমক গুপ্ত। কিন্তু সব ঝড় সামলে যে ফিনিক্স পাখির মতোই নতুন করে ওড়া যায়, তাও দেখালেন বেসরকারি ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মচারী এই মানুষটি।
হালকা জ্বর, সর্দিকাশিকে প্রথমে স্থানীয় ডাক্তার তেমন গুরুত্ব দেননি। জ্বর সারলেও কাশিটা সারছিলই না। অবশেষে চেস্ট এক্স-রে থেকে জানা যায়, তাঁর ফুসফুসের অবস্থা ভাল নয়। শরীর ভাল নয় বুঝে কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে চিকিত্সকের পরামর্শ নেন তিনি। সেখানে দেখা যায় শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশই কমছে। এরপর কোভিড টেস্টের ফল জানার আগেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। পরে করোনা-রিপোর্ট পজিটিভ আসে তাঁর।
সঙ্গে সঙ্গে হোম কোয়ারেন্টিনে চলে যান বাড়ির লোকেরা। হাসপাতালে সোমক। ফুসফুসের অবস্থা ক্রমেই যে খারাপ হচ্ছে বুঝতে পারছিলেন নিজেও। ওদিকে খবর পৌঁছচ্ছিল বাড়ির লোকের কাছেও। অবস্থা এতটাই খারাপ হয় ভেন্টিলেশনেও কাজ হচ্ছিল না। ডাক্তারা একমো চালু করার সিদ্ধান্ত নেন।
'আমরা তো ঠিকমতো জানতামই না একমো কী। শুধু মনে হচ্ছিল, যে মানুষটা হেঁটে চলে হাসপাতালে গেলেন, তাঁর এই অবস্থা হয়ে গেল! আমরাও গৃহবন্দি। বাড়িতে এতটুকু বাচ্চা। ডাক্তারদের উপর ভরসা করা ছাড়া কোনও উপায়ই ছিল না।জানলাম ফুসফুস কোনওরকম কাজ করছিলই না।'
বলছিলেন সোমক গুপ্তর স্ত্রী মৌমিতা। ভেন্টিলেশনে থাকার অর্থ সারা শরীর যান্ত্রিক সহায়তায় চলছে। তখন মাঝ-মধ্যে ভিডিও কলেই দেখতে পেতেন রোগীকে। আর ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা। এইটুকুই ছিল আশার আলো।
'একমো ছাড়া তো বাঁচার উপায় ছিল না। কিন্তু সে-যে কী যন্ত্রণা। দিনে কতবার করে সাকশন চলত। ডাক্তারবাবুরা বলতেন, যত বেশি করে সাকশন নিতে পারব, তত তাড়াতাড়ি ফুসফুস কাজ করবে।মনে পড়ত শুধু ৫ মাসের ছেলের মুখটা। মনকে বোঝাতাম ফিরতেই হবে ওর কাছে। সেলসের কাজে আছি তো। তাই মনে মনে ওটাই ছিল আমার টার্গেট।' বলছিলেন জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ফিরে আসা বছর ৪০-এর সোমক।


কিন্তু এই বয়সের মানুষকে করোনা এভাবে কাবু করল কীভাবে?মেডিকা সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের একমো বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট  ডা. দীপাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় জানালেন, সোমক গুপ্তর ডায়াবেটিস ছিল। তাছাড়া উনি মরবিডলি ওবিস, অর্থাত্ ওজন বেশ বেশি। এধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে করোনার দাপট অনেকটাই বেশি হয়।

একমো হল এমন একটা সাপোর্ট সিস্টেম, যা ফুসফুসকে একে বারে বিশ্রাম দেয়। শরীরের বাইরে থেকেই ফুসফুসের কাজ করে। ততদিনে সেরে ওঠার সময় পায় আসল ফুসফুস। এই পদ্ধতিটা এতটাই কঠিন, বেশিরভাগ সময় রোগীকে তন্দ্রাচ্ছন্নই রাখা হয়। জানালেন চিকিত্সক দীপাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।

৭-৮ দিন পর থেকে সাড়া দিতে শুরু করে ফুসফুস। একটু ভাল অবস্থায় আসার পর যখন ভিডিও কলে নিজের ছেলে-স্ত্রীকে দেখতেন, তখন বারবার আঙুল চাইত ওদের ছুঁতে।বলছিলেন করোনাজয়ী সোমক।

১২টি দিন একমো-সাপোর্টে ছিলেন তিনি। তারপরও করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসেনি। অবশেষে ২০ জুলাই তাঁর কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।

এমন লড়াকু মানুষকে অভিবাদন তো জানাতেই হয়। তাই ২৬ জুলাই হাসপাতালেই হয় জন্মদিন পালন। সেদিনই বাড়ির লোকের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয় তাঁর।



'মুখ দিয়ে নল ঢোকানো। সারা শরীর অবসন্ন। কথা বলতে চাইছি, কিন্তু পারছি না। সিস্টারদের ডাকতে চাইছি, পারছি না। কী যে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা! মনে করলে মনে হয়, কীভাবে এতবড় লড়াইটা জিতলাম।' বলছিলেন সোমক গুপ্ত।

আর তাঁর স্ত্রী মৌমিতার কথায়, 'ভয়ে রাতের পর রাত ঘুমোতেই পারতাম না। বাড়ির অন্যদের কথা ভেবে চোখের জলও ফেলতে পারতাম না। গলা দিয়ে আমারও খাবার নামত না। কিন্তু ৫ মাসের ছেলের দেখাশোনা তো করতে হবে। তাই খেতেই হত। এই লড়াইটা কিছুতেই সম্ভব হত না, ওর অফিস, ছোটবেলার বন্ধুরা, সহকর্মীরা পাশে না থাকলে। কোভিড আতঙ্ক ভুলে ওরা কিন্তু সবসময় ছুটি এসেছে। রক্ত দিয়েছে প্রয়োজনে। এগুলো ভোলার নয়।'

জ্বর হলে দেরি না করেই করোনা কিনা দেখে নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন বিশিষ্ট চিকিত্সকরা। তাহলে সেভাবেই চিকিত্সা শুরু করা দরকার। পজিটিভ হলে পরিবারের মানুষদের থেকে রোগীদের আলাদা রাখা যায়। আর ওজন বেশি হলে তো আরও বেশি সচেতন থাকা জরুরি।