কলকাতা: ১০০ বছর বয়স হল বিশিষ্ট চিকিৎসক মণি কুমার ছেত্রীর। এখনও তাঁর চ্যালেঞ্জ একটাই, রোগকে হারিয়ে রোগীকে সুস্থ করে তোলা। এ কাজে তিনি মাস্টার অফ মাস্টার্স। তিনি টিচার অফ টিচার্স। তিনি  একশো বছরের তরুণ। এই বয়সেও রোজ নিয়ম করে ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠেন। ব্রেকফাস্ট সেরেই গলায় স্টোথো ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন ডাক্তারবাবু। দিনভর নিজেকে ব্যস্ত রাখেন মানুষকে সুস্থ রাখার কাজে।


অনেকে বলেন, বিধানচন্দ্র রায়ের পর পশ্চিমবঙ্গে চিকিত্‍সার বিবর্তন যেন খানিকটা থমকে গিয়েছিল। তবে, তাকে স্থায়ী হতে দেননি মণি কুমার। খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলে এনে মূল স্রোতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ছাত্র চিকিৎসক মনোতোষ পাঁজা এ বিষয়ে বলেছেন, ‘আমি ওনার ছাত্র, সব ছাত্র বরেণ্য। গবেষণা করতেন। উত্‍সাহ দিতেন। উদাহরণ দিয়ে বলেছেন- দুর্ভিক্ষ দেখে মানুষের শরীরে কী কী পরিবর্তন হয়, তা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি। উনি মাস্টার অফ মাস্টার্স। টিচার অফ টিচার্স।’

১৯২০ সালের ২৩ মে দার্জিলিঙে জন্মগ্রহণ করেন মণি কুমার। প্রাথমিক শিক্ষা দার্জিলিং মিউনিসিপ্যালিটি প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৪ সালে ডাক্তারিতে স্নাতক। ১৯৪৯-এ ডাক্তারিতে স্নাতকোত্তর করেন তিনি। এরপর চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে আরও পড়াশোনার জন্য যান বিদেশেও। ১৯৫৫ সালে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ ফিজিসিয়ানস থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯-এ আমেরিকান কলেজ অফ কার্ডিওলজি থেকে ফেলোশিপ করেন। ১৯৭২ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস থেকে ফেলোশিপ করেন। ১৯৭৩ সালে রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস থেকে ফেলোশিপ করেন।

লন্ডন থেকে ফিরে কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে শুরু মণি কুমারের কর্মজীবন। যোগ দেন রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান হিসেবে। পরবর্তীকালে বিধানচন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ান হিসেবে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে। বর্তমানে যাকে সবাই এসএসকেএম বলে চেনে। এই হাসপাতালে দীর্ঘদিন সার্জেন সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন মণি কুমার। সামলেছেন আইপিজিএমইআর তথা ইনস্টিটিউ অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের কার্ডিওলজি এবং মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর ডিরেক্টরের দায়িত্বও। বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি এবং আইপিজিএমইআরের ডিরেক্টরও ছিলেন তিনি। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তারও দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই এসএসকেএম হাসপাতালে তৈরি হয় ইনটেনসিভ থেরাপি ইউনিট তথা আইটিইউ সেটআপ। এনডোক্রিনোলজি, কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি, ডায়াবিটিস, রিউম্যাটোলজির মতো আলাদা আলাদা বিভাগ চালু হয়। যা রাজ্যের কোনও হাসপাতালে প্রথম। আজও এসএসকেএম হাসপাতালের রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ে মেডিসিন বিভাগে তাঁর নামে একটি কেবিন রয়েছে। আজও সেখানে গিয়েই রোগী দেখেন শতায়ু এই চিকিত্‍সক।

মণি কুমার সম্পর্কে চিকিত্‍সক জয়ন্ত বসু জানিয়েছেন, ‘তিনি একদিকে দক্ষ প্রশাসক, অন্যদিকে দক্ষ চিকিত্‍সক, রোগীদের উদ্ধারকর্তা। প্রচণ্ড ভারসাম্য রেখে কাজ করতেন। তিনি যথেষ্ট ডিসিপ্লিনড। খ্যাতির আগে পরে সবসময়।’

চিকিত্‍সা ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বহু সম্মান পেয়েছেন মণি কুমার। ১৯৭১ সালে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার তরফে ডক্টর বি সি রায় মেমোরিয়াল রিসার্চ প্রোজেক্ট অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় তাঁকে। ১৯৭৪ সালে পান পদ্মশ্রী সম্মান। শুধু অভিজ্ঞ চিকিত্‍সক কিংবা দক্ষ প্রশাসকই নন, তিনি একজন ছাত্র দরদীও।

প্রতিবছর ২৩ মে ঘটা করে তাঁর জন্মদিন পালন করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্ররা। ঠিক ছিল, এবার আরও ধুমধামের সঙ্গে পালন করার। কারণ, প্রিয় মাস্টারমশাই তো এবার ১০০ বছর পূর্ণ করলেন। কিন্তু, করোনা আবহে এখন তা সম্ভব হয়নি। স্বনামধন্য এই চিকিত্‍সক-শিক্ষককে তাই দূর থেকেই ছাত্রদের শুভেচ্ছা...হ্যাপি বার্থ ডে স্যর। পরিস্থিতি সাভাবিক হলেই বড় করে স্যরের বার্থ ডে সেলিব্রেশন। সেই অপেক্ষাতেই চিকিত্‍সক-পড়ুয়া থেকে অনুরাগী সকলে।