সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা: আজ ফলহারিণী কালীপুজো। জৈষ্ঠ্যমাসের অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালী পুজো হয়।

  ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালী পুজোর দিন শ্রীমা সারদাদেবীকে ষোড়শীরূপে পুজো করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। আজও রামকৃষ্ণমঠ ও মিশনে এই পুজো ‘ষোড়শী’ পুজো নামে পরিচিত। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই দিনেই তাঁর সমস্ত সাধনার ফল শ্রীসারদা দেবীকে অর্পণ করেছিলেন। দেবী রূপে পুজো করেছিলেন জগৎ কল্যাণের জন্য। বাল্য সারদার মনে আধ্যাত্মিক ভাবধারার বিকাশ ঘটিয়ে এবং নিজের সাধনসঙ্গিনী হিসাবে সারদাকে গড়ে নিয়েছিলেন তিনি। কারণ তিনি জানতেন সারদা কোনও সাধারন মেয়ে নন, তিনিই ভবিষ্যতে রামকৃষ্ণের ভাবাধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।


১২৮০ বঙ্গাব্দের ১৩ই জৈষ্ঠ্য ফলহারিণী কালী পুজোর দিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমাকে সাক্ষাৎ ষোড়শী জ্ঞানে পুজো করেন। এটি পৃথিবীর অধ্যাত্মিক ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। জগতের ইতিহাসে শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনা যেমন তুলনাবিহীন তেমনি আপামর পৃথিবীবাসীর কাছে দাম্পত্যের এক যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গী রাখেন তিনি। গৃহে রমণীদের স্থান কোথায় এবং তাঁদের প্রকৃত স্বরূপ কী, তা চেনালেন শ্রীরামকৃষ্ণ।


এত বড় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শনে এবং সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থানে গভীর রেখাপাত করে, তা ঘটেছিল নিভৃতে, অনাড়ম্বরভাবে। সেই পুজোয় পূজ্য ও পূজক ছাড়া আর কারো প্রবেশের অনুমতি ছিল না।পরবর্তী কালে স্বামী সারদানন্দ রচিত 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ' এবং ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য রচিত 'শ্রীশ্রী সারদাদেবী' গ্রন্থে ষোড়শী পুজোর বিবরণ পাওয়া যায়।


'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ'


‘সন ১২৮০ সালের জৈষ্ঠ্য মাসের অর্ধেকের উপর গত হইয়াছে। আজ অমাবস্যা, ফলহারিণী কালিকাপূজার পুণ্যদিবস। সুতরাং দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে আজ বিশেষ পর্ব উপস্থিত। ঠাকুর শ্রীশ্রীজগদম্বাকে পূজা করিবার মানসে আজ বিশেষ আয়োজন করিয়াছেন। ওই আয়োজন কিন্তু মন্দিরে না হইয়া তাঁহার ইচ্ছানুসারে গুপ্তভাবে তাঁহার গৃহেই হইয়াছে। পূজাকালে দেবীকে বসিতে দিবার জন্য আলিম্পনভূষিত একখানি পীঠ পূজকের আসনের দক্ষিণপার্শ্বে স্থাপিত হইয়াছে। সূর্য অস্তগমন করিল, ক্রমে গাঢ় তিমিরাবগুণ্ঠনে অমাবস্যার নিশি সমাগতা হইল। ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদয়কে অদ্য রাত্রিকালে মন্দিরে দেবীর বিশেষ পূজা করিতে হইবে, সুতরাং ঠাকুরের পূজার আয়োজনে যথাসাধ্য সহায়তা করিয়া সে মন্দিরে চলিয়া যাইল এবং রাধাগোবিন্দের রাত্রিকালে সেবা-পূজা-সমাপনান্তর দীনু পূজারী আসিয়া ঠাকুরকে ঐ বিষয়ে সহায়তা করিতে লাগিল। দেবীর রহস্যপূজার সকল আয়োজন সম্পূর্ণ হইতে রাত্রি নয়টা বাজিয়া গেল। শ্রীমতী মাতাঠাকুরানীকে পূজাকালে উপস্থিত থাকিতে ঠাকুর ইতঃপূর্বে বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, তিনিও ঐ গৃহে এখন আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠাকুর পূজায় বসিলেন।


 পূজাদ্রব্যসকল সংশোধিত হইয়া পূর্বকৃত্য সম্পাদিত হইল। ঠাকুর এইবার আলিম্পনভূষিত পীঠে শ্রীশ্রীমাকে উপবেশনের জন্য ইঙ্গিত করিলেন। পূজা দর্শন করিতে করিতে শ্রীমতী মাতাঠাকুরানী ইতঃপূর্বে অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সুতরাং কি করিতেছেন, তাহা সম্যক না বুঝিয়া মন্ত্রমুগ্ধার ন্যায় তিনি এখন পূর্বমুখে উপবিষ্ট ঠাকুরের দক্ষিণভাগে উত্তরাস্যা হইয়া উপবিষ্টা হইলেন। সম্মুখস্থ কলসের মন্ত্রপূত বারি দ্বারা ঠাকুর বারংবার শ্রীশ্রীমাকে যথাবিধানে অভিষিক্তা করিলেন। অনন্তর মন্ত্র শ্রবণ করাইয়া তিনি এখন প্রার্থনামন্ত্র উচ্চারণ করিলেন - “অয়ি বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরসুন্দরি, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর, ইহার (শ্রীশ্রীমার) শরীরমনকে পবিত্র করিয়া ইহাতে আবির্ভূতা হইয়া সর্বকল্যাণ সাধন কর!”


 অতঃপর শ্রীশ্রীমার অঙ্গে মন্ত্রসকলের যথাবিধানে ন্যাসপূর্বক ঠাকুর সাক্ষাৎ দেবীজ্ঞানে তাঁহাকে ষোড়শোপচারে পূজা করিলেন এবং ভোগ নিবেদন করিয়া নিবেদিত বস্তুসকলের কিয়দংশ স্বহস্তে তাঁহার মুখে প্রদান করিলেন। বাহ্যজ্ঞানতিরোহিতা হইয়া শ্রীশ্রীমা সমাধিস্থা হইলেন। ঠাকুরও অর্ধবাহ্যদশায় মন্ত্রোচ্চারণ করিতে করিতে সম্পূর্ণ সমাধিমগ্ন হইলেন। সমাধিস্থ পূজক সমাধিস্থা দেবীর সহিত আত্মস্বরূপে পূর্ণভাবে মিলিত ও একীভূত হইলেন।  কতক্ষণ কাটিয়া গেল। নিশার দ্বিতীয় প্রহর বহুক্ষণ অতীত হইল। আত্মারাম ঠাকুরের এইবার বাহ্যসংজ্ঞার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা গেল। পূর্বের ন্যায় অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়া তিনি এখন দেবীকে আত্মনিবেদন করিলেন। অনন্তর আপনার সমস্ত সাধনার ফল এবং জপের মালা প্রভৃতি সর্বস্ব শ্রীশ্রীদেবীপাদপদ্মে চিরকালের নিমিত্ত বিসর্জনপূর্বক মন্ত্রোচ্চারণ করিতে করিতে তাঁহাকে প্রণাম করিলেন---“হে সর্বমঙ্গলের মঙ্গলস্বরুপে, হে সর্বকর্মনিষ্পন্নকারিণি, হে শরণদায়িনি ত্রিনয়নি শিব-গেহিণি গৌরি, হে নারায়নি, তোমাকে প্রণাম, তোমাকে প্রণাম করি”।


 পূজা শেষ হইল - মূর্তিমতী বিদ্যারূপিণী মানবীর দেহাবলম্বনে ঈশ্বরীর উপাসনাপূর্বক ঠাকুরের সাধনার পরিসমাপ্তি হইল - তাঁহার দেব-মানবত্ব সর্বতোভাবে সম্পূর্ণতা লাভ করিল।’


'শ্রীশ্রী সারদাদেবী'


‘১২৮০ সালের ১৩ই জৈষ্ঠ্য ফলহারিনী কালী- পূজার দিন ঠাকুর শ্রীশ্রীমাকে সাক্ষাৎ ষোড়শী জ্ঞানে পূজা করেন। যেভাবে সমাধিস্থ হইয়া মা সেই মহাপূজা গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা হইতেই তিনি যে কত বড় মহাশক্তির আধার কিছুটা অনুমান করা যাইতে পারে। ঘটনা এইরূপ-


ঠাকুর অন্তরের এক অপূর্ব প্রেরনায় চালিত হইয়া নিজের ঘরে জগন্মাতার বিশেষ পূজা করিতে মনস্থ করিলেন। ভাগিনেয় হৃদয় ও দীনু পূজারীর সাহায্যে দেবীর রহস্যপূজার সর্বাঙ্গসুন্দর আয়োজন করিতে করিতে রাত্রি নয়টা বাজিয়া গেল। শ্রীশ্রীমাকে পূজাকালে উপস্থিত থাকিতে ঠাকুর পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছিলেন। এই সময় তিনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও ঠাকুর পূজায় বসিলেন ।


পূজার পূর্বকৃত্যসকল দর্শন করিতে করিতে মা অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইলেন; এবং ঠাকুরের ইঙ্গিতে , পূর্বমুখে উপবিষ্ট পূজকের দক্ষিণভাগে আলিম্পনভূষিত পীঠে উত্তরাস্য হইয়া উপবেশন করিলেন । সম্মুখস্থ কলসের মন্ত্রপূত বারি দ্বারা ঠাকুর বারংবার শ্রীশ্রীমাকে যথাবিধানে অভিষিক্তা করিলেন। অনন্তর মন্ত্র শ্রবন করাইয়া তিনি এখন প্রার্থনামন্ত্র উচ্চারণ করিলেন,-“হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর; ইঁহার( শ্রীমায়ের) শরীর মনকে পবিত্র করিয়া ইহাতে আবির্ভূত হইয়া সর্বকল্যাণ সাধন কর!”


অতঃপর শ্রী শ্রীমার অঙ্গে মন্ত্রসকলের যথাবিধানে ন্যাস পূর্বক ঠাকুর সাক্ষাৎ দেবীজ্ঞানে তাঁহাকে পূজা করিলেন এবং ভোগ নিবেদন করিয়া নিবেদিত বস্তুসকলের কিয়দংশ স্বহস্তে তাঁহার মুখে প্রদান করিলেন। বাহ্যজ্ঞান তিরোহিত হইয়া শ্রীশ্রীমা সমাধিস্থা হইলেন। ঠাকুরও অর্ধবাহ্যদশায় মন্ত্রোচ্চারণ করিতে করিতে সম্পূর্ণ সমাধিমগ্ন হইলেন। সমাধিস্থ পূজক সমাধিস্থা দেবীর সহিত আত্মস্বরূপে পূর্ণভাবে মিলিত ও একীভূত হইলেন।


পূর্বপূর্ব সাধনকালে ব্যবহৃত বস্ত্র, আভরণ ও রুদ্রাক্ষের  মালাদি সমুদয় দ্রব্য, সেই সকল সাধনার ফল এবং নিজেকে দেবী পাদপদ্মে সমর্পণ করিলেন।’