নয়াদিল্লি: বিরল অসুখে চলাফেরাটাও কঠিন ছিল তার কাছে। কিন্তু বুদ্ধির দীপ্তিতে ঝলমল করত তার চোখ। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-ই ছিলেন তার আদর্শ। স্বপ্ন ছিল সিবিএসই-র দশম শ্রেণির পরীক্ষায় র‌্যাঙ্ক করা। না, সেই স্বপ্ন ছুঁতে পারেনি সে। জীবনের অমোঘ সত্যিটাই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল-অকালে। তিনটি বিষয়ের পরীক্ষা দেওয়ার পর আর বাকি দুটি বিষয়ের পরীক্ষা দিতে পারেনি নয়ডার বিনায়ক শ্রীধর। ইচ্ছে ডানা মেলার আগেই গত মার্চে সবাইকে ছেড়ে চলে যায় সে। পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেল, যে তিনটি বিষয়ে সে পরীক্ষা দিয়েছিল বিনায়ক, সেই তিনটিতেই প্রায় একশ করে নম্বর পেয়েছে সে।
ড্যুচেন মাসকুলার ডিসট্রফিতে আক্রান্ত ছিল বিনায়ক। জেনেটিক এই রোগের লক্ষ্মণ পেশীর সঞ্চালনে সমস্যা ও দুর্বলতা।
যে তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল বিনায়ক, তারমধ্যে ইংরেজিতে ১০০, বিজ্ঞানে ৯৭ এবং সংস্কৃততে ৯৭ নম্বর পেয়েছে সে। কম্পিউটার সায়েন্স ও সোশ্যাল স্টাডিজের পরীক্ষা দিতে পারেনি সে।
ড্যুচেন মাসকুলার ডিসট্রফির কারণ ডিসট্রোফিন নামে একটি প্রোটিনের অনুপস্থিতি। পেশীকে অক্ষত রাখতে ওই প্রোটিন প্রয়োজন।
সোমবার সিবিএসই দশমের ফলাফল বেরিয়েছে।
নয়ডার অ্যামিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে সাধারণ ক্যাটাগরিতে পরীক্ষায় বসেছিল বিনায়ক, চিলড্রেন ইউথ স্পেশ্যাল নিড (সিডব্লুএসএন) ক্যাটাগরিতে নয়।
বিনায়কের মা মমতা শ্রীধর বলেছেন, ওর পেশীর সঞ্চালন খুবই সীমিত ছিল। ও খুব ধীরে লিখতে পারত। কিন্তু পরীক্ষায় একটা বাঁধা সময় রয়েছে। তাই ইংরেজি ও বিজ্ঞান পরীক্ষার জন্য একজন লেখকের সাহায্য নিয়েছিল ও। কিন্তু সংস্কৃত পরীক্ষা ও নিজের হাতে লেখার জেদ করেছিল। ওর নড়াচড়া করতে সমস্যা হত। হুইলচেয়ারে বসেই চলাফেরা করত। কিন্তু ওই মস্তিষ্ক ছিল ক্ষুরধার। আর ছিল উচ্চাকাঙ্খা। ও সবসময়ই বলত, যাই সমস্যা থাক, আমি মহাকাশচারী হতে চাই। আর বলত স্টিফেন হকিং যদি অক্সফোর্ডে যেতে পারেন ও মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বে কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেন, তাহলে আমিও মহাকাশে যেতে পারি। পরীক্ষায় ভালো র্যা ঙ্ক করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল ও। ওর এই আত্মবিশ্বাস দেখে বিস্মিত হতাম। ওকে স্বপ্ন পূরণে উত্সাহ দিতাম।
কিংবদন্তী ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মোটোর নিউরোন ডিজিজে আক্রান্ত ছিলেন।
পরীক্ষা দেওয়ার পর কন্যাকুমারীর কাছে রামেশ্বরম মন্দিরে যেতে চেয়েছিল বিনায়ক।
মমতা শ্রীধর বলেছেন, আমরা আজ রাজেশ্বরমে এসেছি, সন্ধেয় মন্দিরে যাব। এটা ওর অপূর্ণ ইচ্ছে ছিল। তাই ওর সেই পরিকল্পনা স্থগিত না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং ওর জন্যই এখানে এসেছি।

বাবা-মার মুখ একা বিনায়কই উজ্জ্বল করেনি। তার দিদিও কৃতী ছাত্রী। ইন্ডিয়ান ইন্সস্টিটিউট অফ সায়েন্সেরের প্রাক্তনী বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে ফেলোশিপে পিএইচি করছেন।
বিনায়কের বাবা একটি বেসরকারি সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর মমতা শ্রীধর নিজের ইচ্ছেতেই কোনও চাকরি করেনি, বাড়িতেই থাকেন তিনি।
মমতা শ্রীধর বলেছেন, আমার সারা দিনটা ওকে ঘিরেই কাটত। ওর দাঁত মাজিয়ে দেওয়া, খাওয়ানো সবটাই আমি করতাম। আর ওই ইচ্ছাশক্তিটাই আমাদের সব সময়ই শক্তি দেয়।
বিনায়ক আর নেই। দুরারোগ্য ব্যাধি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তার। স্বপ্ন পূরণে কতটা নিষ্ঠা ছিল তার, তা পরীক্ষার ফলাফলই বলে দিয়েছে। আক্ষেপ একটাই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও মস্তিষ্কের সঞ্চালনে বিজ্ঞানের মহাকাশ ছোঁয়ার অদম্য ইচ্ছেটা মৃত্যুর হাতছানিতে অধরাই থেকে গেল।