কলকাতা: দেশে বেশিরভাগ করোনা আক্রান্তের চিকিৎসাই চলছে বাড়িতে থেকে। করোনা রিপোর্ট পাওয়ার পর অবস্থা বুঝে চিকিৎসকরাই পরামর্শ দিচ্ছেন বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করা প্রয়োজন নাকি হাসপাতালে ভর্তি হতেই হবে। হোম আইসোলেশনে থাকা রোগীর সংখ্যাই এদেশে প্রচুর। তাঁদের অনেকের শরীরেই করোনার কোনও লক্ষণ নেই। অল্পস্বল্প জ্বর থাকলেও শ্বাসকষ্টের সমস্যা অনেকেরই হয় না। তাবলে, তাঁরা যে বিপদের বাইরে, তা একেবারেই নয়। যে কোনও সময়ই শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যেতে পারে। তখন দেরি না করেই হাসপাতালে ভর্তি হতেই হবে। বাড়িতে থাকা করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে কোন লক্ষণ মারাত্মক হতে পারে? ঠিক কখন সতর্ক হতে হবে। জানালেন একমো কেয়ারের সিনিয়র কনসাল্ট্যান্ট ডা. অর্পন চক্রবর্তী


১. করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে এমন অনেক পরিস্থিতি আসে, যখন রোগী বুঝতেই পারেন না তাঁর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা মারাত্মক হারে কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় 'হ্যাপি হাইপক্সিয়া' বলে। যখন শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকলেও তা জানান দেয় না। শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা প্রথমেই হয় না। কিন্তু হঠাৎ হয়ত দেখা গেল শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৮৮তে নেমে গেল। তখনই শুরু হয়ে যায় শ্বাসকষ্ট, তা মারাত্মক আকার নিতে সময় লাগে না।

২. এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতেই দিনে দুবার অক্সিমিটারে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা মেপে দেখা প্রয়োজন হয়। অক্সিমিটারের রিডিং যদি ৯৫ এর নীচে নেমে যায়, তখনই দুবার না ভেবে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

৩. শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হচ্ছে বুঝবেন কী ভাবে? করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর যদি হঠাৎ বেশি ক্লান্ত বোধ হয়, হঠাৎ মাথা ঘুরতে শুরু করে, শরীর অতিরিক্ত অবসন্ন লাগে,  ঝিমুনি বোধ হয়, তাহলে দেরি না করে সতর্ক হওয়া উচিত।

৪.  অনেক অ্যাস্থমা, সিওপিডি-র রোগীদের শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা সাধারণ অবস্থাতেই ৯৪ থাকে, তখন তাদের ক্ষেত্রে ৯০ এর নীচে রিডিং নামলে বিপজ্জনক।

৫. জ্বর, খুব কাশি, ডাইরিয়া, শ্বাসের সমস্যা, গা-হাত পা ব্যথা, গন্ধ না-পাওয়া এগুলি প্রত্যেকটিই করোনার উপসর্গ। কিন্তু কোনওটিই বেশিমাত্রায় হলে ঝুঁকি না নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া জরুরি।

৬. বয়স্কদের ক্ষেত্রে কথাবার্তা অসংলগ্ন হতে শুরু করলে মারাত্মক। এই উপসর্গ খুবই দেখা যাচ্ছে।  এইসময় মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। তাই বয়স্কদের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধান হতে হবে।  লক্ষণগুলি অবহেলা করা মারাত্মক হতে পারে। কখন শ্বাসকষ্ট বাড়বে, তখন হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে, এমন ভেবে গা-ফিলতি করে থাকেন অনেকেই। যা একজনের মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।  করোনার প্রভাবে ইউরিনেশন কমে যাওয়াও খুব সাধারণ সমস্যা।বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে নজর রাখতে হবে সুগার-প্রেসারের ওঠানামাতেও। তাই বাড়িতে সুগার বা রক্তচাপ মাপার যন্ত্র রাখলে ভাল।

৭. বয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশি সতর্ক হতে গিয়ে অনেকসময়ই কমবয়সীরা নিজেদের শারীরিক সমস্যাগুলির দিকে শুরুতেই নজর দেন না। ফলে বিপদ বাড়তে থাকে তলায় তলায়। করোনা আক্রান্ত হলে রোগীকে দেখাশোনা করার অবশ্যই কাউকে থাকতে হবে।সেই সঙ্গে কোনও ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগে থাকতে হবে। দেখা যায়, অনেক সময় প্যারাসিটামল খেয়েও জ্বর কমছে না। সেক্ষেত্রে সাবধান হওয়া আবশ্যক।

8. খেয়াল রাখা আবশ্যক, করোনা আক্রান্ত হলে শরীরে জলের পরিমান উল্লেখ যোগ্য ভাবে কমে যায়। ডিহাইড্রেশনের আশঙ্কা বাড়ে। তাই যে কোনও করোনা আক্রান্তকেই সারাদিনে প্রচুর জল খেতে হবে। বেশি ক্লান্ত লাগলে জল, ওআরএস, ফ্রুটজুস খেতে হবে ঘনঘন।

চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে অনেক সময় হঠাৎ‍ই রক্তে কমে যায় অক্সিজেনের মাত্রা। রোগীকে তৎক্ষণাৎ বাইরে থেকে অক্সিজেন সাপোর্ট না দিলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিপদ কখন আসবে কেউ জানে না! করোনা রোগীর হঠা‍ৎ শ্বাস নিতে কষ্ট হলে, হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে কিনা, তাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না! তাই সঙ্কটের এই মুহূর্তে পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং অক্সিজেনের ক্যানের চাহিদা বেড়েছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা আক্রান্তদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন নিরবিচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ। একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার শেষ হওয়ার পর, আরেকটি সিলিন্ডার লাগাতে যে সময় লাগবে, সেই সময়টুকুও একজন করোনা আক্রান্তের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী হতে পারে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।  চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের মতে, বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রেখে নিশ্চিন্তে থাকাটা ভয়ঙ্কর। আগুন নিয়ে খেলা হবে। পেশেন্ট কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মারা যেতে পারেন। অক্সিজেন কমলে হাসপাতাল ছাড়া উপায় নেই।

বিশেষজ্ঞদের কথা অনুযায়ী, বাজারে যা দেখে চটজলদি সমাধান মনে হচ্ছে, তা আসলে সমাধান তো নয়ই। উল্টে ডেকে আনতে পারে আরও বড় বিপদ। তাই আলোচিত উপসর্গগুলি দেখা দিলেই সাবধান হতে হবে । দেরি করা চলবেই না।